প্রতিহিংসার বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ!

প্রতিদিনের মতো গত শনিবারও অটোরিকশা নিয়ে বেরিয়ে ছিলেন সিদ্দিকুর রহমান। বাড়িতে অসুস্থ মা, স্ত্রী ও দুই সন্তান আছে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী তিনি। ময়মনসিংহ শহরে সিএনজি চালিয়ে যে কয়টি টাকা আয় হয় তা দিয়েই পরিবারের খরচ মেটান ত্রিশোর্ধ্ব সিদ্দিকুর। কিন্তু তিনি কি জানতেন দুর্বৃত্তদের ছোঁড়া পেট্রলবোমায় ঝলসে যাবে দেহ? জানতেন কি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের সাদা বিছানায় শুয়ে দগ্ধ ঘায়ের তীব্র যন্ত্রণায় কাতরাতে হবে তাকে? জানলে হয়ত বের হতেন না। আবার হয়ত শঙ্কা নিয়েই দুরু দুরু বুকে উপার্জনে নেমেছিলেন। বিরোধীদল বিএনপির ডাকা টানা অবরোধ কর্মসূচিতে সিদ্দিকুরের মতো ভাগ্যবরণ করতে হয়েছে কয়েক শ নিরীহ মানুষকে। প্রাণ দিয়েছেন অন্তত ২৩ জন। যাদের বেশির ভাগই খেটে খাওয়া কম আয়ের মানুষ। তারা হয়ত কল্পনাও করেননি কাজের তাগিদে রাস্তায় নামলে এভাবে বর্বরতার শিকার হতে হবে। রাজনৈতিক সহিংসতায় এমন প্রাণহানির ঘটনা নতুন নয়। অতীতেও হয়েছে। এখনও হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বলি হয়েছে বরাবর জনগণই। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জনগণের কল্যাণে রাজনীতির কথা বললেও রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন জনগণই। রাজনৈতিক সহিংসতায় যারা স্বজন হারান তারাই বোঝেন স্বজন হারানোর বেদনা কেমন হতে পারে। যে পরিবারে নিহত ব্যক্তিটিই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি থাকেন তাদের ভোগান্তি কোথায় গিয়ে পৌঁছতে পারে, তা কেবল ভুক্তভোগীরাই ভালো বলতে পারবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী বলেন, ‘দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন হঠাৎ করেই অশান্ত হয়ে ওঠায় সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। যারা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে বা দামি গাড়ি হাঁকিয়ে কর্মস্থলে যান তাদের জন্য যতটা না ভোগান্তি হয়েছে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে নগরীর মধ্য ও স্বল্প আয়ের মানুষদের।’ তিনি বলেন, ‘রাজনীতিকরা জনগণের কল্যাণের কথা বলেন। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে পুরোপুরি উল্টো। হামলার যত আঘাত সবই আসে জনগণের ওপর। ভাঙচুর করা হয়, আগুন দেওয়া হয় গণপরিবহনে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষই। এ ধরনের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে জনগণের কল্যাণ মুখে মুখেই থাকবে, বাস্তবে মিলবে না কিছুই।
গত ৫ জানুয়ারি বিএনপিকে রাজধানীতে জনসভা করতে দেওয়া হয়নি। পাশাপাশি গুলশানের কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয় বিএনপি চেয়ারপারসনকে। ওই ঘটনার প্রতিবাদে ৬ জানুয়ারি থেকে টানা অবরোধ করে যাচ্ছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। তবে ৪ জানুয়ারি থেকেই শুরু সংঘাতের। এই দিনটি থেকে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত ১২ দিনে সংঘর্ষ-সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ২৩ জন। আহত অন্তত ৩৫০ জন। এই কয়দিনে আগুন দেওয়া হয় ১৭৮টি যানবাহনে। ভাঙচুর করা হয় অন্তত ২৫১টি যানবাহন। ঢাকা মহানগরে আগুন দেওয়া হয়েছে ৩৪টি গাড়িতে। অবরোধ কর্মসূচির মধ্যেই বৃহ¯পতিবার সকাল-সন্ধ্যা হরতালও করেছে বিএনপি। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমানের ওপর হামলার প্রতিবাদে এই হরতাল ডাকা হয়।
ঢাকাসহ ১৬ জেলায় সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে রংপুরের মিঠাপুকুরে। গত ১৪ জানুয়ারি মিঠাপুকুরের ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে যাত্রীবাহী একটি বাসে পেট্রলবোমা হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। পুলিশের ভাষ্য, ১৪ জানুয়ারি রাত সোয়া ১২টার দিকে রংপুর শহরের মডার্ন মোড় এলাকা থেকে ঢাকাগামী যাত্রীবাহী ৩০টি বাস পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল পুলিশ ও বিজিবি। ওই বাস বহরের সামনে ছিল পুলিশের গাড়ি, পেছনে বিজিবির গাড়ি। বহরের ২৩ নম্বরে ছিল পেট্রলবোমা হামলার শিকার হওয়া খলিল এন্টারপ্রাইজ নামের যাত্রীবাহী বাসটি। পুলিশ-বিজিবির প্রহরায় বাসের বহর মিঠাপুকুর উপজেলার বাতাসন এলাকায় এলে মহাসড়কের পাশের বাঁশঝাড়ের ভেতর থেকে বাস লক্ষ্য করে পেট্রলবোমা ছুঁড়ে মারে দুর্বৃত্তরা। খলিল এন্টারপ্রাইজ নামের বাসটিতে পেট্রলবোমা এসে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে পুরো বাসে আগুন ধরে যায়। বাসের ভেতরে পুড়ে মারা যায় চারজন। গুরুতর দগ্ধ হয় ১০ জন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থান আরও একজন মারা যান। রংপুরের পুলিশ সুপার আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমরা কোন দেশে বাস করছি? এ কেমন বীভৎসতা! কোনো মানুষ কী করে এমনভাবে মানুষ হত্যা করতে পারে?’
এ ঘটনায় জামায়াত-শিবিরের শতাধিক নেতা-কর্মীকে আসামি করে মামলা করে পুলিশ। এ পর্যন্ত জামায়াত-শিবিরের বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।
রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণহানি নতুন নয়
রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণহানি নতুন নয়। অতীতেও দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর পাল্টাপাল্টি সহিংসতায় ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। অথচ এতকিছুর পরও বন্ধ হচ্ছে না সংঘাতের রাজনীতি।
আওয়ামী লীগের সময়ে
২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মারা গেছেন ৫৬৪ জন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের দলীয় কোন্দলেই মারা গেছেন ১৩০ জন। নির্দলীয় সরকারের দাবিতে গত বছরের ২৭ থেকে ২৯ অক্টোবর বিএনপি-জামায়াতের ডাকা ৬০ ঘণ্টার হরতালেই ১৫ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এর আগে গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসের সহিংসতায় ২৮৯ জন প্রাণ হারান।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৫৫ জন মারা গেছেন হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে। আর ১৮ জন মারা গেছেন জামায়াত-পুলিশ সংঘর্ষে। হরতালের মধ্যে রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা গেছেন ১৩৮ জন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংঘর্ষে ১৩ জন এবং আওয়ামী লীগ ও জামায়াত-শিবিরের সংঘর্ষে আরও পাঁচজন মারা গেছেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দলে ১৫ জন এবং বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলে  ৬ জন মারা গেছেন।
এর আগে ১৯৯৬ সালের জুনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। সে সময় থেকে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮৯৮ জনের প্রাণহানি ঘটে। এর মধ্যে ২০০১ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় ছিল। ওই দুই মাসে ১৩১ জনের প্রাণহানি ঘটে।
বিএনপির সময়ে
২০০১ সালের অক্টোবরে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসে। সে সময় থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় ৮৭২ জন প্রাণ হারান। এর মধ্যে সন্ত্রাসী হামলায় আওয়ামী লীগের ২০০ নেতা-কর্মী মারা যান। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় মারা যান ২৪ জন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ-বিএনপি সংঘর্ষে ৭৫ জন, বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ৭৫ জন, বিএনপি-জামায়াত সংঘর্ষে ১০ জন ও আওয়ামী লীগের কোন্দলে ১৪ জন মারা যান। বাকিরা হরতাল ও অবরোধসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে মারা গেছেন। সেবার ক্ষমতার শেষ সময়ে ২০০৬ সালে ১২০ জন প্রাণ হারান। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংঘর্ষে প্রাণ হারান ৩৬ জন। হরতাল ও অবরোধে প্রাণ হারান ৩৫ জন। এ ছাড়া ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সালের মে পর্যন্ত বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে রাজনৈতিক সংঘর্ষে ১৭৪ জন প্রাণ হারান।
কম সহিংসতার নজিরও আছে
বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট প্রকাশিত সংবাদপত্রে হরতালচিত্রের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯১ থেকে ১৯৯৮ সালের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সে সময় হরতাল, অবরোধ ও অসহযোগের মতো আন্দোলন হলেও রাজনৈতিক সহিংসতায় খুনোখুনি তুলনামূলকভাবে কম হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ১৯৯৫ সালের ১৬ থেকে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত সারা দেশে ৯৬ ঘণ্টার হরতালে দুজনের প্রাণহানি ঘটে। এরপর একাধিকবার হরতাল দিলে সে সময় মারা যান আরও ছয়জন। ১৯৯৬ সালের ৯ মার্চ থেকে টানা ১৭ দিন অসহযোগ আন্দোলন হয়েছে দেশে। সে সময়ও খুব বেশি মানুষ মারা যাননি।
সহিংসতা থামার আলামত নেই
হঠাৎ অশান্ত হয়ে ওঠা রাজনৈতিক অঙ্গন কবে শান্ত হবে তার কোনো ঠিক নেই। সরকার ও বিরোধী পক্ষের ‘অনড়’ অবস্থানের কারণে সহসাই সংঘাতময় পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার কোনো সম্ভাবনাই দেখছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। দুই দলের নেতাদের মুখেও নেই স্বস্তির বাণী। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার শর্ত মেনে বিএনপি যে সংলাপের দাবি জানাচ্ছে তাতে আওয়ামী লীগের থোরাই কেয়ার। বরং বিএনপি-জামায়াত জোটের আন্দোলনে জ্বালাও-পোড়াও ঠেকাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে সরকার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও কঠোর অবস্থানে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যারাই সহিংসতায় জড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি তো আছেই।
সরকারের কঠোর এই অবস্থানেও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। যে করেই হোক সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করার কর্মসূচি নিয়ে নেমেছে দলটি। তবে গ্রেপ্তার ও হামলা আতঙ্ক পিছু ছাড়ছে না বিএনপি নেতাদের। কেউ গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে বাঁচছেন। আর কেউ গ্রেপ্তার হয়ে কারা অন্তরীণ আছেন।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে সরকারকে নমনীয় হতে হবে। এভাবে পুলিশ-বিজিবি দিয়ে অতীতেও কেউ ক্ষমতায় থাকতে পারেনি, আওয়ামী লীগও পারবে না।’
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতারাও অনড় নিজেদের অবস্থানে। দলটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, ‘বিএনপি মনে করছে সন্ত্রাসী কায়দায় সরকারের কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু তাদের মনে রাখতে হবে বর্তমান সরকার সংবিধান রক্ষায় গণতান্ত্রিকভাবেই ক্ষমতায় এসেছে। সরকার তার মেয়াদপূর্ণ করেই ক্ষমতা ছাড়বে। এর আগে কোনো নির্বাচনের প্রশ্নই আসে না।’ তিনি বলেন, বিএনপি দেশের উন্নয়ন দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েছে। তারা আবারও দেশকে এক শ বছর পেছনে ঠেলে দিয়ে দুর্নীতি ও জঙ্গিবাদকে ফিরিয়ে আনতে চাইছে। কিন্তু তাদের এই নীলনকশা কখনই বাস্তবায়ন করতে দেওয়া হবে না। এ জন্য যা করার তাই করা হবে।’ সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।

No comments

Powered by Blogger.