ওবামার ভারত সফর- চলছে লাভ-ক্ষতির চুলচেরা হিসাব by সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

২৫ জানুয়ারি থেকে শুরু হতে যাওয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার তিন দিনের ভারত সফরে কার কতটা লাভ হতে চলেছে—এ নিয়েই আপাতত চুলচেরা হিসাব চলছে। দিন কয়েক আগে ভারতের রাজস্থান রাজ্যের রাজধানী জয়পুরে এক আন্তর্জাতিক সমাবেশে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফ্রাঙ্ক ওয়াইজনার ও ভারতের সাবেক কূটনীতিক সতীন্দর লামবা স্বীকার করলেন, ওবামার সফর দুই দেশের কাছেই সম্পর্কের একটা নতুন দিক খুলে দেবে। তবে তা কতটা বিস্তৃত, তা নিয়ে শুরু হয়েছে জল্পনা। এটা ঠিক, কিছু না নিয়ে যেতে পারলে ওবামা এই সফরে আসতে চাইতেন না। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট, যিনি দ্বিতীয়বার ভারত সফর করছেন। পাশাপাশি এটাও ঠিক, মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে কিছু আদায় করতে না পারলে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকেও দাঁড়াতে হবে নানা প্রশ্নের মুখে। স্রেফ ছবি তোলার স্বার্থে এই ভ্রমণ যে নয়, তা সবাই অনুধাবন করছেন। প্রশ্ন হলো, কোন কোন ক্ষেত্রে দুই দেশ লাভবান হতে চলেছে?
মাত্র কদিন আগে ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাট’ সম্মেলনে অংশ নিতে এসে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি তিনটি ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ওবামার সফরের পর এই ক্ষেত্রগুলোতে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা অনেকখানি বেড়ে যাবে। সেগুলো হলো বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রতিরক্ষা সম্পর্ক। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ এ মুহূর্তে ১০০ বিলিয়ন ডলার, যা চীন-আমেরিকা বাণিজ্য বহরের এক-চতুর্থাংশ। ওবামার সঙ্গে অধিকাংশ বড় বড় মার্কিন কোম্পানির বড় কর্তারা আসছেন। একাধিক চুক্তি সম্পাদিত হবে তাঁদের বাণিজ্যের স্বার্থে। ইতিমধ্যেই শোনা যাচ্ছে, মোদির ‘স্মার্ট সিটি’ প্রকল্পে সাড়া দিয়ে আমেরিকার ব্যবসায়ীরা ভারতে তিনটি শহর তৈরি করবেন। উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদ, রাজস্থানের আজমির ও সীমান্ধ্র প্রদেশের বিশাখাপট্টনাম। সিসকো, আইবিএম, জিই, ওটিসসহ ১০-১২টি মার্কিন কোম্পানির এক কনসোর্টিয়াম রাজ্য সরকারগুলোর সঙ্গে কথা শুরু করেছে।
ওবামার সফর আরও গুরুত্ব পেয়ে যাচ্ছে বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক রিপোর্টে। তাতে বলা হয়েছে, আগামী দুই বছরের মধ্যে চীনকে পিছিয়ে দিয়ে ভারতই হয়ে উঠবে পৃথিবীর দ্রুততম অর্থনীতি। মার্কিন কোম্পানিগুলো অবশ্যই সেই সুযোগ নিতে চাইবে। মোদি সরকারের সাম্প্রতিক কিছু সংস্কারের সিদ্ধান্ত পশ্চিমা দেশগুলোকে আগ্রহী করছে। এ সিদ্ধান্তগুলোর অন্যতম বিমা, কয়লা ও জমি অধিগ্রহণ অর্ডিন্যান্স, প্রতিরক্ষা খাতে বিদেশি বিনিয়োগ ৪৯ শতাংশে নিয়ে আসা এবং শিল্প বিকাশে পরিবেশকে প্রয়োজনের বেশি গুরুত্ব না দেওয়া। এই সিদ্ধান্তগুলো শিল্প বিকাশে সহায়ক হবে বলে শিল্পোদ্যোগী মহলের বিশ্বাস। পৃথিবীর ধনী দেশগুলোর প্রতিষ্ঠিত ‘মানি ম্যানেজারদের’ প্রায় ৫০ শতাংশ মনে করছেন, আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই ভারত হয়ে উঠবে লগ্নির সেরা দেশ। ভারতের পরেই তাঁরা স্থান দিয়েছেন ইন্দোনেশিয়াকে। এই প্রথম কোনো ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক ভারতে রাষ্ট্রদূত হলেন। রিচার্ড ভার্মা। ওবামার সফরকে তিনি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের এক অনন্য সন্ধিক্ষণ বলে অভিহিত করেছেন। এই অনন্যতার মধ্যে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন, নবায়নযোগ্য শক্তি, পরমাণু শক্তি, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং প্রতিরক্ষা সহযোগিতা। ওবামার গলায় খচখচ করছে পরমাণু দায়বদ্ধতা নিয়ে ভারতের ভূমিকা। এই বিতর্কের মীমাংসা শেষ পর্যন্ত কীভাবে হবে, তা নিয়ে দুই পক্ষেই কিছুটা উদ্বেগ রয়েছে। মোদি চাইছেন, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে প্রযুক্তির হস্তান্তর বাধ্যতামূলক করে বেশ কিছু সমরসম্ভার ভারতেই উৎপাদিত হোক। মোদির সেই চাহিদা ওবামার এই সফরে পূর্ণ হতে পারে। ১০ বছর আগে তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রণব মুখার্জি আমেরিকার সঙ্গে ১০ বছরের জন্য প্রতিরক্ষা চুক্তিতে সই করেছিলেন। সেই চুক্তি এবার আরও ১০ বছরের জন্য বাড়তে চলেছে। ওয়াইজনার ও লামবা দুজনেই মনে করেন, ওবামার এই ভারত সফর দুই দেশের কাছেই ‘উইন উইন’ মুহূর্ত হতে চলেছে।

No comments

Powered by Blogger.