দর্শনের দারিদ্র্যে বই by খান মাহবুব

কয়েক মাসের ব্যবধানে চলে গেলেন বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, কবি আবুল হোসেন, ইতিহাসবিদ প্রফেসর সালাহ্উদ্দীন আহ্মদ, দার্শনিক সরদার ফজলুল করিম, প্রফেসর জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, নজরুল-সঙ্গীতশিল্পী ফিরোজা বেগম, ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন, সাংবাদিক এবিএম মূসা, স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন ও চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, শিশুসাহিত্যিক এখলাসউদ্দিন আহমেদ, কবি অরুণাভ সরকার। প্রতিটি মৃত্যুই চারপাশের মানুষগুলোকে সংকুচিত করে। তারপর যদি হয় বরেণ্য ব্যক্তিত্ব, তাহলে সমাজযন্ত্র মানিক-রতন হারানোর যন্ত্রণায় কাতর হয়। মানুষের দেহনাশ হবে, এটা চিরন্তন। কর্মগুণ নির্ধারণ করে প্রাণ গেলে বায়বীয় মানুষটি কতটা প্রাসঙ্গিক থাকবে। তবে আমাদের চারপাশের নক্ষত্রগুলোর একটা একটা করে খসে পড়ায় আমি কাতর হচ্ছি এই ভেবে যে, আমাদের শিল্পসংস্কৃতির জগতে নতুন নক্ষত্র সেভাবে সৃষ্টি হচ্ছে না। একটু আগে যাঁদের নাম বললাম- ভবিষ্যতে কি এ রকম কৃতী মানুষ তৈরি হবে? স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে- উত্তর অনেক রকম হতে পারে তবে আমার কাছে মনে হয় আগামী প্রজন্ম এ রকম কৃতী মানুষ আর আসবে না। চলমান সময়ে সর্বক্ষেত্রে নিষ্ঠা, দায়িত্ববোধ, একাগ্রতা, দৃঢ়তা ও প্রত্যয়ের বড় অভাব। আর একটি বড় কারণ হচ্ছে- যে ধরনের চর্চার ভেতর দিয়ে আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম শক্ত ভিতের জমিনে দাঁড়িয়েছে- সে ধরনের নিবেদন বা চর্চার মধ্য দিয়ে আমরা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে এগুতে পারছি কি?
ইন্দ্রিয়জাত চাওয়া-পাওয়ার হিসেব-নিকেশ, নাকি প্রযুক্তি-নির্ভর জীবন, নাকি অন্য কিছু সব এলোমেলো করে দিচ্ছে! জানি না। তবে একটা সংকীর্ণতা আমাদের সবাইকে কুড়ে-কুড়ে খাচ্ছে। সেটা হচ্ছে আমাদের পাঠ-বিমুখতা। আজকাল সামগ্রিকভাবে আমরা পাঠ-বিমুখ। ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী, বিজ্ঞাপনের এমন ভাষা শত ভাগ সত্য হিসেবে ঘড়ির কাঁটার মতো ঠিক ঠিক করছে। মিনি শ্যাম্পু, মিনি স্ক্যাটের মতো মোবাইলের মিনিবার্তা কিংবা ফেসবুকে লেখা ৩/৪ শত শব্দের কোনো গল্পে বা অন্য কিছুতে আমরা অভ্যস্ত। এক রাতে দুই মলাটের পুরো বই পড়ার গল্প আজকাল গর্ব করে খুব একটা কারও কাছে শুনি না। পাঠ-বিমুখতা আমাদের দুর্বল মানসিক ভিতের একটা বড় কারণ। দেশীয় শিল্প-সংস্কৃতির ভুবনে বুঁদ হয়ে থেকে আগে নিজের দেশকে জানার অপার আগ্রহ নতুন প্রজন্মের নেই। পড়ার অভ্যাসের সুযোগ-সুবিধাও নেই। ষাটের দশকের মতো মধ্যবিত্তের বাড়ির বুক-সেলফ, পাড়ার ক্লাবের বইয়ের সেলফ কিংবা শহরের পাঠাগার- সব দিন দিন উধাও হয়ে যাচ্ছে।
দিন দিন বিবর্ণ ও উৎসাহহীন হচ্ছে বইয়ের ভুবন। উদাহরণ দিয়ে বলতে পারি-
(১) ১৩৩৫ বঙ্গাব্দে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় ৬০/৭০টি লাইব্রেরি ছিল [সূত্র সৌরভ ১৩৩৫ ১৬বর্ষ ৭ম সংখ্যা ১৩৩৫ বঙ্গাব্দ]। এ ধরনের সমৃদ্ধ পাঠাগার কেন এখন গড়ে উঠছে না। ময়মনসিংহ জেলায় এখন মানসম্মত ৫০টি পাঠাগারও নেই। তাহলে কি বইয়ের প্রয়োজন কমেছে, নাকি আমরা মননের দারিদ্র্যে বইয়ের থেকে দূরে চলে গেছি।
(২) কুমিল্লার রামমালা (স্থাপিত ১৯১২) লাইব্রেরিতে জার্মান দার্শনিক জারমুরালের ৫০টি বইসহ অনেক দুষ্প্রাপ্য বইসহ ৮ হাজার পুঁথি আছে। এই পাঠাগার রবীন্দ্রনাথেকে সংবর্ধনা দিয়েছিল। এ ধরনের পাঠাগার এখন তৈরি হচ্ছে না কেন?
(৩) টাঙ্গাইলের সাদত কলেজে (স্থাপিত ১৯২৬) করটিয়ার জমিদাররা গরুর গাড়ির বহরে করে কলেজ লাইব্রেরিতে বই দিয়েছিলেন। সে কারণে বঙ্গের আলিগড়খ্যাত এ কলেজ পূর্ববঙ্গের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরি সংগ্রহশালার মধ্যে অনন্য ছিল। আজও টাঙ্গাইলের ধনবাড়ির জমিদারদের দান করা বই আলমারিতে তালাবদ্ধ করে ঢাকার কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি গৌরাবান্বিত বোধ করে। অথচ এত ডিজিটালাইজেশন, এত অটোমেশিনের পরও আমাদের পাঠাগারগুলো ধুলায় ঢাকা জীর্ণ। পাঠকের হাত কম স্পর্শ করে বইয়ের পাতার জমিনকে।
সরকার ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত সময়ে ৯১৭টি লাইব্রেরিকে ৪৫৪ দশমিক ৫০ কোটি টাকার আর্থিক ও গ্রন্থ সহায়তা দেয়। বর্তমান সরকার ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৭২০টি লাইব্রেরিকে ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা দেয়। ২০১৪ সালে ২৩৮৭টি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও ২২৬২টি পাঠাগারকে সরকার অনুদান প্রদান করেছে। সহায়তা বৃদ্ধি হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় কম।
অনেক নিরাশার মধ্যেও একটু একটু আলো আছে। সম্প্রতি দেশের জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত একটি খবরে আছে-
কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম মোল্লারহাট। গ্রামের কয়েকজন তরুণ গড়ে তুলেছেন সচেতন শিক্ষার্থী সংঘ (সশিচ) তারা একটি পাঠশালাও প্রতিষ্ঠা করেছেন। গ্রামের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বই কিনে দেন। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির পরামর্শ, ভর্তির জন্য যাতায়াতের অর্থের ব্যবস্থা করেন।
৬০-এর দশকে মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা যে ধরনের গান শুনত, যে ধরনের সিনেমা দেখত, যে ধরনের বই পড়ত এবং তার মাধ্যমে যে ধরনের রুচি তৈরি হতো, এখন তা হচ্ছে না। কারণ রুচিবোধ ও মানসিকতা সৃজনে যে ধরনের ইনপুট চারপাশ থেকে বেড়ে ওঠার সময় যোগ হতো আজকাল তেমন হয় না। ফলে আজকের ছেলেমেয়েদের জীবনযাপন, ভাব-ভাবনা রবীন্দ্র-নজরুল বলয়ের বাইরে। কিন্তু আবহমান বাঙালির তো গর্ব- রবীন্দ্র-নজরুল বলয়ের আকাশ।
আমরা কথায় কথায় উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার কথা বলি। কিন্তু উন্নত দেশের মানুষের ব্যস্ততার মধ্যেও যে পাঠ্যাভ্যাস আছে, তা আমাদের নেই। এই দৈন্য, আমাদের মানসিকতার। তা সমাজের সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান। যে দেশের আইনপ্রণেতাদের ব্যবহারের জন্য ৮৫ হাজার বইয়ের সংগ্রহের জাতীয় সংসদের পাঠাগার মাত্র ২২ দশমিক ৮৫ শতাংশ ব্যবহার করে। তাও বেশির ভাগ সদস্য যায় কেবল সংবাদপত্র পড়ার জন্য- এ ধরনের সংবাদ পীড়াদায়ক।
সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের ১৬ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখের খবরে প্রকাশ- রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘরের নিবন্ধিত প্রকাশনার সংখ্যা ১৩ হাজার ৫৭৬টি। সম্প্রতি তিন হাজার ৫২টি প্রকাশনার হদিস নেই। এ অবস্থা আমাদের জন্য কোনো সুখবর বয়ে আনে না।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী প্রতি তিন হাজার মানুষের জন্য একটি লাইব্রেরি প্রয়োজন। সেই হিসেবে বাংলাদেশে ১৭৯৪৭টি পাঠাগার থাকা প্রয়োজন। কিন্তু দেশে সচল গ্রন্থাগারের সংখ্যা হাজারের বেশি নয়।
বাংলাদেশের মানুষের দর্শনের মন্দাদশায় বইকে একটু নেড়েচেড়ে দেখার সুযোগ করে দেয় অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বাঙালি জাতীয়তাবাদের জাগরণের ভ্রুণ প্রোথিত আছে একুশের মধ্যে। তবে একুশে মেলার বাইরেও বড় পরিসরের বইমেলা প্রয়োজন। কারণ একুশের বইমেলা বাঙালিদের জন্য এক বিশেষ আয়োজন। এ কথা বললেই আবার পশ্চিম বাংলার বাঙালিরা তাদের অংশগ্রহণের দাবির ঝাণ্ডা তুলে ধরে। সম্প্রতি পশ্চিম বাংলার পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ডের সম্পাদক ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন- অবশ্যই একুশে বইমেলায় বাংলা ভাষায় লেখা সব বইকেই স্থান দিতে হবে। যেমন কলকাতা বইমেলায় শিলচর, ত্রিপুরা, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের প্রকাশনা স্থান পায় তেমনি বাংলাদেশের প্রকাশনা স্থান পায়। তিনি আরও বলেন, একুশে বইমেলা বলে এই আবেগকে সামনে এনে একটি স্বার্থান্বেষী মহল বাংলা ভাষার এই দ্বিতীয় রাজধানীর লেখক-প্রকাশকদের ওই মেলায় ঢুকতে দিচ্ছে না।
ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় যাই বলুন না কেন- বাংলাদেশ একটা ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র। অন্য ভাষাভাষীদের স্বীকৃতি থাকলেও এ দেশের প্রায় শতভাগ মানুষ বাংলায় কথা বলে। তাছাড়া বাংলা ভাষাকে রক্ষা করতে ৫২তে রক্ত দিয়েছিল এ জাতি। তাই আমাদের বর্ণমালা শহীদের রক্তে ভেজা বারুদের গন্ধমাখা। তবে একুশে বইমেলায় নয়, বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাদের কলকাতা বইমেলার মতো বড় পরিসরে বহুভাষিক বইমেলার আয়োজন প্রয়োজন। আর একুশে বইমেলা গত বছর থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যে সম্প্রসারিত রূপ পেয়েছে সেই বর্ধিত জায়গায় সুযোগ-সুবিধার সুযোগ নিয়ে মেলা হতে হবে আরও নান্দনিক, হৃদয়গ্রাহী ও পাঠকবান্ধব।

No comments

Powered by Blogger.