নির্জনতার মডার্নিটি

কবিতা ভাষা নির্মাণে নিজেকে নগ্ন করে, লাল হলুদ সবুজবাতি জ্বালিয়ে অনেক ভেতরে, অনেক দূরপথে যাত্রা করে সে সৃজন-উল্লাসে। তারিক সুজাতের কবিতায় এ হল স্বাভাবিক উৎরাইয়ের দূরযাত্রা। চেতনের পথ ধরে অজানায় বয়ে যাওয়া, তবে পথের দুধারে চেনা-সব মুখ আর উপাদান, চেনা প্রকৃতি ও বাস্তবতা। কখনও জাগতিক চৈতন্যের অনুপুঙ্খ যাপনের প্রাত্যহিক ঘটনাই তার প্রধান উপজীব্য। সমকালীন রাজনৈতিক উপাদান কিংবা ভিন্ন চোখে সময়কে দেখার মাধ্যমে কবিতার শরীর ও মন-নির্মাণে তার যে ভাষাদর্শন, তাও ব্যক্তি তারিক সুজাতের নিজস্ব। ফলে সাবজেক্টিভ ও অবজেক্টিভের মধ্যে দিয়ে যে কাব্য-সুরধারা, তা সরল বাক্যগঠন, শব্দচয়নের এক যুক্তিক্রম-পথের নির্দেশ দেয়- যা তারিক সুজাতের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের পরিচয় বহন করে। কবিতার শৈলী, দৃশ্যগত ও বোধগত আমাদের প্রায়শ আলোচ্য হয়, তার চেয়ে বেশি অন্তর্গত চেতনের ইঙ্গিত কত দূর পাঠককে টেনে নিয়ে যায়।
এই প্রচল মূল্যায়নের বাইরে গিয়ে কাঠামোবাদি দৃষ্টির নিরিখে নয় কেবল, ডাইলেক উপস্থাপনের নিরিখেও তারিক সুজাত অ্যান্টিডাইলেক কিংবা পলিটিকেল হেজিমনি-অ্যান্টিহেজিমনির সমন্বয় সাধন করতে পেরেছেন। ক্ষয়িষ্ণু নাগরিক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর যাপনের টানাপোড়েন চমৎকারভাবে উপস্থিত তার কবিতায়।
আশির দশকের অগ্রজ কবি তারিক সুজাতের কাব্যপ্রতিমা পড়ুয়া-মনোবিদের পঠনে-মননে এমনই এক আশ্চর্য নবনির্মিতি তৈরি করে দেয়; অক্ষরের রেখায় রেখায় মডার্ন ফর্ম ও এক্সেপ্রেশনে ক্ল্যাসিকাল মানুষের আভিযাত্রিক সাহসকে উসকে দিয়ে, তার পর অব্যর্থ অন্বয়ে গড়া বৈশ্বিক-বিস্তারকে সুসহ-সুষমায় কিংবা চারু-নন্দময়তায় ভরিয়ে তোলে। প্রান্তরের সহজিয়া অভিপ্রায় সব নিস্পৃহ নিরক্তিম সাধুতায়, কখনও বা দৃপ্তবিপ্লবী রক্তিমতায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। তিনি প্রজানীতি কিংবা রাষ্ট্রনীতির যথা সুন্দরের সিম্পনিটি মগ্নগহন কবিতাকলার আলতো ছোঁয়ায় এমন এক অনিন্দ্যসুরের তানপুরায় গেয়ে তোলেন যে, মৃদুকণ্ঠ নমনীয়তার আশ্লেষে সিদ্ধ সবচেয়ে বজ -উচ্চারণটিও তখন তার তুলিতে স্বতঃই মানিয়ে যায়। তার ‘বাংলাদেশ’ কবিতাটি এক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল উপমাই শুধু নয়, বিরলপ্রয়োগ সৌন্দর্যে এক মহা-উচ্চারী ইতিহাস হতে পারে।
পথের চোখেও আজ পথচলার ক্লান্তি/পথের পা স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছে না কোথাও/পথ এসে থমকে দাঁড়িয়েছে পথিকের পায়ে।/পথের মোড়ে রক্তচোখে সিগন্যালগুলো/রাগী গলায় বলছে : এদিকে এসো না/পথের পাশের যাত্রীছাউনিটিও/ সূর্যের দিকে মুখ তুলে ভাবছে :/ কোথাও শান্তির মতো শীতল ছায়া নেই।/একটি বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো/জেব্রাক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে আছে তের কোটি মানুষ।/পথের মাঝখানে গোল আইল্যান্ডে দাঁড়িয়ে/ট্রাফিকের ভূমিকায় একঘেয়ে অভিনয় করে যাচ্ছে/প্রতিদ্বন্দ্বী ছায়া।/মত ও পথের পার্থক্য নিয়েও যে/যাত্রা হয়-/সেই কথাটি কেউ বলছে না/পথ এসে থমকে দাঁড়িয়েছে পথিকের পায়ে।
স্বপ্ন এবং সত্য। মত ও পথ। প্রকৃতি ও মানুষ। গতি ও গান। দুঃখ ও ক্লান্তি। নিন্দা ও ঘৃণা, স্মৃতি ও বিষাদ- এসব উপাচার ব্রহ্মারে পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে। কবি কিন্তু এগুলোকে বাজাতে চান জরাহীন এক ভাষাভঙ্গিমায়। নির্জন লাবণ্যে জ্বালাতে চান অন্তর্লোকের প্রদীপ শিখা। কবিতা তখন আর স্বয়ং কবির নাগালে থাকে না, ঐন্দ্রজালিক স্পর্শসত্যে কিংবা পাঠসত্যে সে অনায়াসে পৌঁছে যায় পড়–য়ার মর্মমূলে। তখন বাদ-বিবাদ কিংবা প্রতিবাদ ডিঙিয়ে সে কবিতা পেয়ে যায় এক অবিসংবাদিতের রূপ।
‘কবিতা’ কবিতাটি একবার পড়া যাক :
মৌন, হে ব্যবধান/নির্লিপ্ত দহনে তবু কী করে পোড়াও!/আলোতে উত্তীর্ণ মুখ, আলোকিত অমা;/ ঐ আলোর দিকে, ঐ উত্থিত অলৌকিক/ সিঁড়িটির দিকে হেঁটে যায়, কে সে?/কতটা পথের শেষ দিগন্তকে ছোঁয়/ কত ধাপ নামা হলে পতনের শুরু/পথিক জানে না তবু দ্বিধাহীন যায়!/ যে যায় সে যায়। পথ-সিঁড়ি চিনে/যাওয়াটাই মৌলিক;/ না হলে পরাস্ত হতে হয়, বিনাশে ফুরায় নীড়/অযথা ক্লান্তিতে পরিণামহীন হেঁটে/জীবন জয়ের নামে যৌবন খরচ।/মৌন, হে প্রজ্ঞাপারমিতা,/হে সুন্দর সর্বনাশ!/তুমুল তোমার দিকে মন্দ্র আলোড়ন/অনন্তের ঘরে অমরতা নিলয় নিখিল/মৌন, হে ব্যবধান!
বাঙালি জাতির অস্তিত্বের গৌরব ‘একাত্তর বা স্বাধীনতা’ যে মহান প্রাতিস্বিক-মানবের হাত দিয়ে এসেছে, আলোকস্তম্ভ তথা উচ্চমান মিনারের মতো যিনি এ জাতিকে অনন্তকাল ধরে আশা, সাহস ও প্রেরণা জুগিয়ে যাবেন, সেই চিরভাস্বর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা কি তিনি বিস্মৃত হতে পারেন? না, তিনি কখনোই জাতির এ মহান নায়ককে বিস্মৃত হতে পারেন না। স্মরণ-মাধুর্যে তাই তিনি প্রভাতের প্রার্থনা সঙ্গীতের মতো অকপটে গেয়ে ওঠেন :
মুখর মিনার/যেন সে ভোরের পাখি/অমল আঘাতে/দ্রুত ছিঁড়ে গেলে ঘুম/পার হয়ে রাত/আঁধার অতনু তিথি/প্রিয়তম রোদ/প্রতীক আলোতে দেখা/ সে তো বাঙালির পিতা মুজিবেরই মুখ।
এভাবে মহামানব বঙ্গবন্ধু কিংবা মৃত্যুঞ্জয়ী একাত্তরের চেতনাসঞ্জাত উচ্চারণ তার কবিতায় ফিরে ফিরে আসে। যেমন ফিরে ফিরে আসে যাযাবরী শৈশবের সাহসিকতা কিংবা যুদ্ধপথের দগ্ধস্মৃতি। আমাদের এ প্রিয় মাতৃভূমিকে হানাদারি প্রেতাত্মারা বারবার ছোবল মেরে বিকৃত করার স্পর্ধা দেখায়, ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তাক্ত স্মৃতিকে যারা নিমিষেই মুছে ফেলতে চায়। মুক্তিযুদ্ধের এই দেশে এও কি সম্ভব? ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বারবার বেপথু হওয়াকে কবি তাই কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না। তার মানবিক সত্তা প্রতিবাদের বহুবিধ প্রতীকে ফুঁসে ওঠে উচ্চকণ্ঠে উচ্চারণ করে :
আমার সময়কে আমি/উল্টো পায়ে হেঁটে যেতে দেখেছি!/ ভূতগ্রস্ত সময়ের পদচ্ছাপ অনুসরণ করে/জরাগ্রস্ত জাতি কখন পৌঁছে গেছে/গভীর খাদের কিনারায়/ জানলে না, তুমি জানলে না।/হে আমার তিরিশ-বয়সী যুবা/রক্তাক্ত স্বদেশ/ তোমাকে টেনেহিঁচড়ে মর্গের দিকে/নিয়ে যাচ্ছে কারা?...
...প্রিয় নেতৃবৃন্দ!/ ইতিহাসের কালো কফিনে / শেষ পেরেকটি ঠোকার আগে/ মুক্তবাতাসে আমাদের একটু / নিঃশ্বাস নিতে দিন
নিজেরই ভেঙে যাওয়ার শব্দে/ জেগে ওঠো বাংলাদেশ/ জাগো শেষবার
আততায়ী হন্তারক সময়ের প্রতিধ্বনি তুলে/আসে দুঃস্বপ্নের রাত/ বারবার...
কবিতা তো মানুষের আশ্রয়-নিদান। বিপুল এই মহাবিশ্বে মানুষ খুঁজে-ফেরে তার স্বস্তিকা-পুরাণ। মাটি ফুঁড়ে আকাশছোঁয়া বৃক্ষপাখালির মতো কবিতাও তাই পল্লবিত হয় কবির কল্পচেতনার রঙ ছুঁয়ে ছুঁয়ে। এই রঙ কখনও গাঢ়, কখনও আর্দ্র, কখনও কোমল, কখনও রুদ্র, কখনও রুক্ষ, কখনও নিরস, কখনও বা তীক্ষè, সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত। স্বপ্নে-জাগরণে অতিচেতন মানুষের মন এভাবে উড়ে উড়ে যায়, দিগন্ত থেকে দিগন্তরেখায়... নীল আকাশের তারায় তারায়। কবি তারিক সুজাতের বর্ণিল কাব্যচ্ছটা এভাবে পাঠককে মুহূর্তেই পৌঁছে দেয় আবিলতাহীন এক স্বপ্নাদ্য জগতের চির-সবুজের প্রান্তরে। মাসুদ পথিক

No comments

Powered by Blogger.