‘গাড়ি থামাও, আমরা প্রশাসনের লোক’ by ওয়েছ খছরু

আলমপুরের স্কয়ারের কাছাকাছি যাওয়া মাত্র তিন যুবক বলে উঠলো, ‘গাড়ি থামাও। আমরা প্রশাসনের লোক। গাড়ি তল্লাশি করব। সব নেমে পড়।’ একথা বলে তিন যুবকের হাতে থাকা প্যাকেট থেকে তারা গাড়িতে গান পাউডার ছিটানো শুরু করলো। সামনেই ছিল  তিনটি মোটরসাইকেল। গান পাউডার ছিটিয়ে দেওয়ার পরপরই আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপর সামনে থাকা মোটরসাইকেলে গিয়ে ওঠে। চলে যায় গোলাপগঞ্জের দিকে। গতকাল সিলেটের শ্রীরামপুর স্কয়ারে এভাবেই যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এক বাসে আগুন দেয়ার পরপরই অদূরে আলমপুরেরও একটি বাসে একই কায়দায় আগুন দেয়। এরপর মোটরসাইকেলে আসা দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। সিলেট-জকিগঞ্জ সড়কের আলমপুর ও শ্রীরামপুরে দুটি বাসে আগুন দেয়ার পর যাত্রীরা এসব কথা সাংবাদিকদের জানান। এর আগে যাত্রীরা ওই এলাকায় দুটি লেগুনা গাড়িতেও আগুন দেয়। এতে করে চারটি গাড়িই চালকদের চোখের সামনে ভস্মীভূত হয়ে গেছে। সিলেটের আলমপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই জয়ন্ত  কুমার দে জানান, যাত্রীবেশী দুর্বৃত্তদের অভিনব এ সন্ত্রাসের ঘটনা সিলেটে এবার প্রথম। তিনি জানান, ঘটনার পর থেকে দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তার করতে পুলিশ অভিযান শুরু করেছে। তবে বিকাল পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি বলে জানান। সিলেট কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের পরিবহন চালকরা জানিয়েছেন, অবরোধ হলেও সিদ্ধান্ত নিয়েই তারা সিলেট-জকিগঞ্জ সড়কে যানবাহন চলাচল শুরু  করেছেন। বুধবার হরতাল হওয়ার কারণে তারা গাড়ি বের করেননি। তবে, গতকাল সকাল থেকে সিলেট থেকে বিভিন্ন রুটে চালকরা গাড়ি চলাচল শুরু করেন। তেমনিভাবে সকাল ৯টার দিকে সিলেট-কদমতলী টার্মিনাল থেকে একটি বাস (সিলেট ব-১১-০০৪৩) জকিগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছাড়ে। বাসটি দক্ষিণ সুরমার মোগলাবাজার থানাধীন শ্রীরামপুর এলাকায় যাওয়ার পর যাত্রীবেশী কয়েকজন দুর্বৃত্ত চালকের মাথায় অস্ত্র  ঠেকিয়ে গাড়ি থামাতে বলে। এ সময় তারা গাড়ি তল্লাশির কথা বলে। এবং নিজেদের প্রশাসনের লোক বলেও পরিচয় দেয়। সব যাত্রী গাড়ি থেকে নেমে এলেও চালক নামছিলেন না। এ সময় চালককে ধমক দিয়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়া হয়। পরে তিন যুবকই হাতে থাকা গান পাউডারের প্যকেট থেকে পাউডার ছিটাতে শুরু  করে। একপর্যায়ে তারা বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। যাত্রীরা জানিয়েছেন, সিলেট কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে বাসে তিন যাত্রী উঠেছিল। তারা যাত্রীবেশে গাড়িতে উঠলেও মূলত দুর্বৃত্ত। শ্রীরামপুর স্কয়ারের কাছে যাওয়া মাত্র তারা চালকের মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে ধরে। বলে গাড়ি থামাও। এরপর যাত্রীদের নামিয়ে দেয়া হয়। তারা জানান, দুর্বৃত্তদের মধ্যে তিনজন গাড়িতে উঠলেও বাকি ৩টি মোটরসাইকেলে তিনজন যাত্রীবাহী বাসের পিছু পিছু সেখানে যায়। পরে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে তারা আগুন দিয়ে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যায়। গাড়ি চালক ও সিলেটের গোলাপগঞ্জের বাসিন্দা আবদুস সালাম খান জানিয়েছেন, ওরা কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে গাড়িতে ওঠে। ফাঁকা জায়গায় এসে জোরপূর্বক গাড়ি থামিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় তাদের সঙ্গে আরও কয়েকজন এসে যুক্ত হয় বলে জানান তিনি। সিলেট থেকে ছেড়ে যাওয়া বাসে আগুন দেয়ার  পর একই কায়দায় গোলাপগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেয়া হয়। পরিবহন শ্রমিকরা জানিয়েছেন, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে গোলাপগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসে একটি যাত্রীবাহী বাস। ওই বাসে প্রায় ২৫ জন যাত্রী ছিলেন। এর মধ্যে হিলালপুর এলাকায় আসা মাত্র গাড়িতে থাকা ছদ্মবেশী তিন দুর্বৃত্ত অস্ত্রের মুখে গাড়ি থামায়। এরপর তারা একই কায়দায় গান পাউডার ছিটিয়ে আরও একটি বাসে (সিলেট-ব-১১-০০১৩) আগুন দেয়। বাসে আগুন দেয়ার দুর্বৃত্তরা গোলাপগঞ্জ অভিমুখে চলে যায়। এদিকে, দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যাওয়ার পর স্থানীয় লোকজন প্রথমে গাড়ির আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চালায়। পরে সিলেট থেকে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে  আনে। আগুনে দুটি বাসের প্রায় ৯০ ভাগ অংশ পুড়ে গেছে। পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা জানান, আগুনে দুটি বাস পুড়ার খবর শুনে তারাও এলাকায় ছুটে যান। গিয়ে দেখেন দুটি বাসই আগুনে পুড়ে গেছে। দুর্বৃত্তরা গান পাউডার দিয়ে অগ্নিসংযোগ করে বলে জানান তারা। এদিকে, দুটি বাসে আগুন দেয়ার আগে বাইপাস এলাকায় দুটি লেগুনাতে গানপাউডার ছিটিয়ে আগুন দেয় দুর্বুত্তরা। তবে, চারটি যানবাহনে আগুন দেয়া হয় মূলত ৩০ মিনিটের মধ্যে।
ডেঞ্জার জোন আলমপুর: দুটি বাসে আগুন দেয়ার  পর ডেঞ্জার জোন হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে সিলেটের শ্রীরামপুর ও আলমপুর এলাকা। শ্রীরামপুর স্কয়ার ও আলমপুর এলাকা থেকে সিলেটের মোগলাবাজার ও গোলাপগঞ্জ থানার মাঝামাঝি এলাকা। গতকাল এই স্থানে দুটি বাস ও দুটি লেগুনাতে আগুন দেয়ার পর ওই সড়কে  যাত্রীবাহী বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ জানিয়েছে, দুটি থানার মধ্যবর্তী এলাকা হওয়ায়  এখানে সব সময় পুলিশের টহল থাকে না। এর ফলে অনেকটা ফাঁকা স্থানেই দুর্বৃত্তরা বাসে আগুন দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। ঘটনার পর থেকে পুলিশ সিলেট-জকিগঞ্জ রোডের বেশ কয়েকটি স্থানে চৌকি বসিয়ে তল্লাশি চালায়। তবে, বিকাল পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
উপপুলিশ কমিশনার ফয়সল মাহমুদের উদ্যোগ: সিলেটে গতকাল থেকে মোটরসাইকেলে একজনের অধিক ব্যক্তির চলাচল নিষিদ্ধ করেছে মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রশাসন। গতকাল থেকে গোটা দেশেই এ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে পুলিশ হেড কোয়ার্টারের পক্ষ্য থেকে। তবে, সিলেটে এ নিষেধাজ্ঞা চলছে ৯ই সেপ্টেম্বর থেকে। এ তথ্য জানিয়েছে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি মিডিয়া মো. রহমতুল্লাহ। গতকাল তিনি মানবজমিনকে জানিয়েছেন, নাশকতা ঠেকাতে সিলেটে মোটরসাইকেলে একাধিক ব্যক্তিকে চলাচলের নিষেধাজ্ঞা চালু করেছিলেন সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার ফয়সল মাহমুদ। এরপর তিনি পুলিশ সদর দপ্তরকে এ ব্যাপারে লিখিত দিয়ে জানিয়েছিলেন। পুলিশ গতকাল থেকে গোটা দেশেই এ নিষেধাজ্ঞা চালু করেছে। তিনি বলেন, নাশকতাকারীরা বর্তমানে গাড়িতে আগুন দেয়ার জন্য মোটরসাইকেলকে সহজ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে। মোটরসাইকলে দুই জন কিংবা তিনজন বসে সহজে পেট্রোলবোমা ও গান পাউডার বহন করতে পারে। এ কারণে একাধিক ব্যক্তিকে মোটরসাইকেলে যাতায়াতের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। অবশেষে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এ প্রস্তাবনাকে গোটা দেশে চালু করেছে পুলিশ সদরদপ্তর।

No comments

Powered by Blogger.