রাজনৈতিক সুপারিশ by ড. মুহাম্মাদ সিদ্দিক

দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। এভাবে দেশ চলতে পারে না। দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার মনে হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার কিছু দেশের বর্তমান ‘সিনড্রোম’ যেন এখন বাংলাদেশকেও স্পর্শ করবে। এখনই যৌক্তিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে দেশ ও জাতির সমূহ ক্ষতি হতে পারে।
আমরা যেহেতু দেশকে ভালবাসি, তাই কয়েকটি পরামর্শ দেয়ার প্রয়াস নিচ্ছি-
১. যেহেতু সমস্যাটা রাজনৈতিক, কাজেই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতেই এর সমাধান বের করতে হবে। অন্য তরিকা অবলম্বন ব্যর্থ হবে।
২. সমস্যাটিতে দেশের দুটি বৃহত্তম রাজনৈতিক দল জড়িত। উভয়কেই কিছু কিছু ছাড় দিতে হবে।
৩. দুই পক্ষের ভেতর দৌত্যকার্যে দেশের নিরপেক্ষ অরাজনৈতিক সিভিল সোসাইটিকে কাজে লাগানো যেতে পারে। সেই গ্রুপে দু’পক্ষের দুজন প্রতিনিধি থাকতে পারেন।
৪. যেহেতু সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাদের নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নে সীমা লঙ্ঘন করে দেশের দুই প্রধান দলের নেতৃবৃন্দ ও একজনের দুই পুত্রকেই হেনস্তা করেছিল, এই রূপ সন্দেহ ও ভীতি কারও কারও মনে থাকা স্বাভাবিক। তাই বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব অনুযায়ী তাঁকে প্রধানমন্ত্রী রেখেই কিছু শাসনতান্ত্রিক-প্রশাসনিক পরিবর্তন এনে নির্বাচন করার প্রচেষ্টা নেয়া যেতে পারে। যেহেতু বর্তমান সংসদও বেশকিছু শাসনতান্ত্রিক-প্রশাসনিক-আইনি পরিবর্তন এনেছে, তাই রাজনৈতিক সমাধানে আর একটি পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। বিএনপি যেসব মন্ত্রণালয় চায়, তা দিতে হবে।
৫. নির্বাচন পরিচালনার জন্য সর্বদলীয় সরকার গঠন করা যেতে পারে। অথবা পূর্ববর্তী পার্লামেন্টের উভয়পক্ষের নির্বাচিত সমসংখ্যক সদস্যদের নিয়ে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার করা যেতে পারে নির্বাচন পরিচালনার জন্য।
৬. নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে ও তাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে আইন করে। যেহেতু বর্তমান প্রধানমন্ত্রীই প্রধানমন্ত্রী থাকছেন, তাই প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিএনপির নমিনি হতে পারেন।
৭. নির্বাচনে জাতিসংঘকে জড়িত করতে হবে।
৮. নির্বাচন পরিদর্শনে বিদেশী ‘অবজারভার’দের আহ্বান করতে হবে।
৯. উভয়পক্ষকে বক্তৃতা-বিবৃতিতে শালীনতা অবলম্বন করতে হবে। মরহুম নেতাদের নিয়ে চরিত্র হনন বন্ধ করতে হবে। আমরা জানি, না বঙ্গবন্ধু প্রো-ইন্ডিয়া ছিলেন, না শহীদ জিয়া প্রো-পাকিস্তান ছিলেন। উভয়েই প্রো-বাংলাদেশ ছিলেন।
১০. সমস্ত রাজবন্দিকে ছেড়ে দিতে হবে। রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক মামলা সমূহ প্রত্যাহার করতে হবে।
১১. উভয়পক্ষকে জাতির কাছে অঙ্গীকার করতে হবে যে, নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেয়া হবে।
১২. এ-ও অঙ্গীকার করতে হবে, বিজয়ী পক্ষ কোন বিজয় র‌্যালি করবে না, কোন প্রকার রাজনৈতিক প্রতিশোধ নেবে না, অতীতের ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখা হবে।
১৩. পরিস্থিতির উন্নয়নে আরও কিছু সুপারিশ/প্রস্তাব যোগ করা যেতে পারে, যেমন বন্ধ পত্রপত্রিকা ও স্যাটেলাইট চ্যানেল খুলে দেয়া।
সমাধানের ব্যর্থতায় পরিণাম
১. যদি সমাধানে ব্যর্থতা আসে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধের মহান চেতনার মূলে ছিল গণতন্ত্র। উন্নয়ন কখনই গণতন্ত্রের বিকল্প নয়। গণতন্ত্র ও উন্নয়নের সহাবস্থানই কাম্য।
২. এভাবে চললে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন ঘটবে চরমভাবে।
৩. রাজনৈতিক সমাধান না এলে, দেশের অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে পড়বে, বিশেষ করে পোশাক শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন মুখ থুবড়ে পড়বে।
৪. ব্যর্থ হলে, বাংলাদেশ এত দিন যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল, তা শেষ হয়ে যাবে।
৫. সন্ত্রাস বৃদ্ধি পাবে। গুম-খুন বৃদ্ধি পাবে।
৬. আমাদেরকেও মধ্যপ্রাচ্যের ব্যর্থ রাষ্ট্রের কাতারে ধরা হবে।
৭. ‘সুজন’ ও আরও কেউ কেউ যেমন এবনে গোলাম সামাদ গৃহযুদ্ধের ভয় করছেন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী ও ৭১ টিভির সঞ্চালক পরিস্থিতিকে ‘যুদ্ধ’ বলেছেন।
উপসংহার: আমাদের অকৃত্রিম অনুরোধ, উভয়পক্ষ কিছু কিছু ছাড় দিয়ে দেশ ও জাতিকে এই চরম সঙ্কট থেকে উদ্ধার করুন। এমন কিছু আমাদের করা উচিত হবে না, যাতে আমাদের স্বাধীনতাই ধূলিসাৎ হয়ে যায়।
(লেখক: ইতিহাসবিদ ও সাবেক কূটনীতিক)

No comments

Powered by Blogger.