এবিএম মূসার বর্ণনায় সেই সময়: ‘লাঠিচার্জ হয়নি তবে ১০ জন আহত’

বিলেতের টমসন ফাউন্ডেশন থেকে ১৯৬৪ সালে একজন প্রশিক্ষক পাঠানো হলো, যিনি বৃটিশ কাউন্সিলে সাংবাদিকতার বিষয়ে একটি সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ কোর্স নেবেন। সব সংবাদপত্রে চিঠি দেয়া হলো তাতে দুজন করে তরুণ সাংবাদিক পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে। সেই চিঠি নিয়ে প্রশিক্ষক এলেন আমার, মানে বার্তা সম্পদকের সঙ্গে কথা বলতে। আমি তাকে পরিহাস করে বললাম, ‘কী শেখাবে তুমি আমাদের? সামরিক বাধানিষেধের বেড়াজাল টপকানো শেখাতে পারবে? ইউ সুইম ইন ক্লিন ওয়াটার, তোমরা পরিস্কার পানিতে সাঁতরাতে জানো। আমাদের হাঙর আর কুমিরকে পাশ কাটিয়ে সাঁতার কাটতে হয়।’
প্রয়াত সাংবাদিক এবিএম মূসা তার ‘আমার বেলা যে যায়’ গ্রন্থে পাকিস্তান আমলে সংবাদমাধ্যমের ওপর আরোপিত নানা বিধিনিষেধের বর্ণনা দিয়েছেন। প্রখ্যাত এই সাংবাদিক ‘বিধিনিষেধের বেড়াজালে সাংবাদিকতা’ শীর্ষক অধ্যায়ে লিখেছেন, ১৯৫৮ সালের ৬ অক্টোবর রাতে বার্তা বিভাগে হাজির হলেন এক সামরিক কর্মকর্তা। আমাকে একটি সামরিক ফরমান দেখিয়ে তিনি গাড্ডা মেরে বসলেন। তাকে না দেখিয়ে কোন সংবাদ-মন্তব্য ছাপানো যাবে না। মার্শাল ল’ অর্ডিন্যান্স জারি হলো। গ্রেপ্তার হলেন সব রাজনৈতিক নেতা। শুধু হক সাহেব টিকাটুলির বাড়িতে গৃহবন্দী হলেন, যেমন ছিলেন ১৯৫৫ সালে গভর্নর শাসনামলে। কিছুদিন পর সামরিক কর্মকর্তারা সব সংবাদপত্রের দপ্তর ছেড়ে চলে গেলেন। একের পর এক সংবাদ প্রকাশের বা নিষিদ্ধকরণের বিধিমালার নির্দেশ সংবলিত সামরিক ফরমান জারি হতে লাগল।
এবার সামরিক ফরমানের ‘হাঙর আর কুমির‘ এড়িয়ে সাঁতার কাটার একটি মজার কাহিনী বলছি। পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৫৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, যাকে তখন শহীদ দিবস বলা হতো, পালন নিষিদ্ধ করা হলো। সেই নিষেধ অমান্য করে ছাত্রছাত্রীদের নগ্ন পায়ের মিছিল বের হলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, বাহান্নতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে তারা যেমনটি করেছিল। সেই মিছিলে লাঠিচার্জ করল পুলিশ। ১০-১২ জন আহত হলো। সামরিক নির্দেশ এলো প্রাদেশিক তথ্য কর্মকর্তা সাদেকুর রহমানের মাধ্যমে। শহীদ দিবস বলা যাবে না, লাঠিচার্জের কথা বলা যাবে না। তবে মিছিলের কথাটি একটু আধটু বলা যাবে। চিন্তায় পড়লাম এই হাঙরকে পাশ কাটাবো কীভাবে!
পরদিন বিশাল শিরোনামে ছাপা হলো ‘টোয়েন্টি ফার্স্ট ফেব্রুয়ারি অবজারভড। স্ট্রুডেন্টস ট্রাই টু ব্রিং আউট প্রসেসন। নো লাঠিচার্জ, টেন ইনজিউরড। অর্থাৎ একুশে পালন, ছাত্রদের মিছিল করার চেষ্টার সময় লাঠিচার্জ হয়নি, তবে ১০ জন আহত হয়েছে। পরদিন সাদেক সাহেবের টেলিফোন, এ কী করছেন? আমি বললাম, কেন আপনার আদেশ যথারীতি পালন করেছি। বরং লাঠিচার্জ হয়েছে বলে যে গুজব রটেছে, তা ও খ-ন করেছি।
এরইমধ্যে সামরিক গোয়েন্দা প্রধান, এরআগে যখন একটি বার্তা সংস্থার সাংবাদিক থাকা অবস্থায় যার সঙ্গে একটুখানি ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল, সেই ব্রিগেডিয়ার আবদুর রহমান সিদ্দিকী টেলিফোন করলেন, ‘মূসা ভাই বড্ড চালাকি করেছেন। আমার অনুরোধ, ভবিষ্যতে ডোন্ট ট্রাই টু বি ক্লেভার, অতি চালাকি করবেন না।’
দ্বিতীয় চালাকিটা করেছি ১৯৬৮ সালের শেষে। গভর্নর মোনায়েম খান গেছেন সিরাজগঞ্জ সফরে। তখন আইয়ুবের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন চলছে। সিরাজগঞ্জে মোনায়েম খানকে কালো পতাকা দেখানো হলো। টিয়ার গ্যাস, লাঠিচার্জ হলো, জনতার তাড়া খেয়ে গভর্নর পালিয়ে এলেন। সেই খবর পাওয়ার তখনকার দিনের একমাত্র বাহন টেলিগ্রাম বা টেলিফোন। সিরাজগঞ্জ থেকে টেলিফোন-টেলিগ্রাম পাঠানো বন্ধ করে দেয়া হলো। কোন যোগাযোগ নেই। অস্থির হয়ে রমনার কেন্দ্রীয় টেলিফোন অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তারা জানাল, সিরাজগঞ্জের সঙ্গে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। সেই সময় তো সব বাঙালি আইয়ুবের বিরুদ্ধে এককাট্টা। অবজারভার অফিস থেকে টেলিফোন, তাই তারা জানাল, একমাত্র এসডিও সাহেবের ফোনটি খোলা আছে। বললাম, ঠিক আছে, তাঁকেই ধরেন। সিরাজগঞ্জের মহকুমা হাকিম রাশিদুল হাসান ওরফে বীরু নানা কারণে আমার স্নেহভাজন ছিল, তাকে ফোনে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন আছ, বীরু? গভর্নর সাহেবকে কেমন খাতির-যত্ম করলে?’ বীরু তো আর লাইন বন্ধের কথা জানে না। বলল’ ‘আরে বলবেন না মূসা ভাই, বড় ঝামেলায় আছি। গভর্নর সাহেবকে নিরাপত্তা দিতে হিমশিম খেয়েছি।‘ কথায় কথায় কালো পতাকা মিছিল, লাঠি-চার্জ গুলি ইত্যাদি সম্পর্কে সব খবরই গড়গড় করে বলে দিল। পরদিন বীরুর নাম উল্লেখ না করে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে বলে খবর পাঠানো বন্ধ করা থেকে গভর্নরের সফর বিভ্রাটের বিশদ বিবরণ ছেপে দিলাম।

No comments

Powered by Blogger.