নৌপথ স্থায়ীভাবে বন্ধ করুন -প্রথম আলোর গোলটেবিলে সুন্দরবনকে বাঁচাতে প্রস্তুতি দাবি বিশেষজ্ঞদের

(সুন্দরবনের শ্যালা নদীর তীরে পড়ে আছে পাখিটি। গায়ে তেল-কাদা। গতকাল তোলা ছবি। জাহাজ ডুবে তেল ছড়িয়ে পড়ায় হুমকির মুখে পড়েছে সুন্দরবনের ওই এলাকার প্রাণিকুল l ছবি: এএফপি) সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে স্থায়ীভাবে নৌপথ বন্ধ করতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে আরেকটি নৌ-দুর্ঘটনায় যে আরও বেশি তেল সুন্দরবনে ছড়িয়ে পড়বে না, তার নিশ্চয়তা নেই। তা ছাড়া গত মঙ্গলবারের বিপর্যয়ের পর তাৎক্ষণিক করণীয় সম্পর্কে সরকারি সংস্থাগুলোর কোনো প্রস্তুতি ছিল না। এ ক্ষেত্রে ওরা যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, তার যেন পুনরাবৃত্তি না হয়, সে জন্য এখন থেকে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি নিতে হবে।
‘মহাদুর্যোগে সুন্দরবন: জরুরি করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে সুন্দরবন গবেষক ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেছেন। গতকাল রোববার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো তার কার্যালয়ে এ বৈঠকের আয়োজন করে। বক্তারা তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের দুর্ঘটনা মোকাবিলায় এখন থেকে উদ্যোগ নিতে সরকারকে পরামর্শ দেন। তেল ছড়িয়ে পড়ায় সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না—নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের এমন বক্তব্যের সমালোচনা করে বক্তারা বলেন, যাঁরা দুর্ঘটনার পর সুন্দরবন এলাকা ঘুরে এসেছেন, তাঁদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী কাঁকড়া, ডলফিনসহ অন্যান্য প্রাণী মরতে শুরু করেছে। এই দুর্ঘটনায় সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য এবং জেনেটিক সম্পদের ওপর দীর্ঘ মেয়াদে প্রভাব পড়বে। তাই এই মহাবিপদে যাতে সুন্দরবন আর না পড়ে, সে জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। এ দুর্ঘটনায় বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের কী ক্ষতি হলো, তার প্রভাব মূল্যায়নে সরকারকে পরামর্শ দেন তাঁরা।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, দুর্ঘটনার পরপরই ‘বুম’ ব্যবহার করে এ তেল সহজেই অপসারণ করা যেত। ফাঁপা প্লাস্টিকের পাইপের সঙ্গে দু-তিন ফুট জাল দিয়ে সহজেই বুম তৈরি করা যায়। আমাদের উপকূলের জেলেদের দিয়েই এটি তৈরি করা যেত। এর মাধ্যমে তেল এক জায়গায় সংকুচিত করে পরে তা তুলে নেওয়া যেত। কিন্তু সরকারি সংস্থাগুলো এটা না করায় তেল ছড়িয়ে ক্ষতি বেড়েছে। আইনুন নিশাত সংবিধানের ১৮ এর (১) অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে বলেন, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা সরকারের দায়িত্ব। এ ছাড়া সুন্দরবন জাতিসংঘের রামসার বা সমৃদ্ধ জলাভূমি এলাকা এবং ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত। ফলে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকাকে রক্ষায় সরকারের উদ্যোগে যথেষ্ট অবহেলা ছিল। এ সংকট মোকাবিলায় সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীকে ব্যবহার করার দরকার ছিল। সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে নৌযান চলাচল বন্ধেরও দাবি জানান তিনি।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্স স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক আতিক রহমান মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে কেন বুম থাকবে না, তা জানতে চান। কচুরিপানা দিয়ে তেলের বিস্তৃতি রোধ করে পরে বুম এনে তা দিয়ে তেল আটকানো যেত বলেও মনে করেন তিনি। শুধু মানুষের জীবিকায় নয়, বরং এ দুর্ঘটনায় বিশ্ববাসীর সামনে বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে। তাই এ মুহূর্তেই নৌপথটি বন্ধ করে দিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল বাশার সুন্দরবনকে পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকা উল্লেখ করে বলেন, মোট সাত ধরনের প্রতিবেশব্যবস্থা সুন্দরবনের মধ্যে রয়েছে। প্রতিটি ব্যবস্থায় আট স্তরের বাস্তুসংস্থান রয়েছে। এখন প্রতিটি প্রতিবেশব্যবস্থা এবং বাস্তুসংস্থান চক্র দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হলো। এই ক্ষতিকে টাকার অঙ্কে বিবেচনা করা যাবে না। এমন দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সরকার কতটুকু প্রস্তুত, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।
গোলটেবিল বৈঠকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক প্রতিবেশবিষয়ক গবেষক তানজিম উদ্দিন খান তেল ছড়িয়ে পড়ার পরপর সুন্দরবন এলাকা পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, যে নৌযানটি থেকে দুর্ঘটনায় তেল ছড়িয়েছে, তা দেখে তেল ট্যাংকার মনে হয়নি। বড়জোর সিমেন্ট বা বালু পরিবহনের যান মনে হয়েছে। এমন একটি নৌযানকে তেল নিয়ে সুন্দরবনের মতো গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকা দিয়ে কীভাবে যেতে দেওয়া হলো, সেই প্রশ্ন তোলেন তিনি।
রানা প্লাজা ও তাজরীন গার্মেন্টসের মতো সুন্দরবনেও রাষ্ট্রের অবহেলায় এত বড় একটি ক্ষতি হয়ে গেল বলে অভিযোগ করেন তানজিম উদ্দিন খান। তাঁর মতে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হলে এই পথ দিয়ে আরও বেশি জাহাজ যাবে। তখন দুর্ঘটনা হলে কয়লা ছড়িয়ে পড়বে। তেল যেমনটা দেখা যাচ্ছে, কয়লা দেখাও যাবে না কিন্তু সুন্দরবনের জন্য মারাত্মক ক্ষতি করবে।
বিশ্বব্যাংকের পরিবেশবিষয়ক পরামর্শক ইশতিয়াক সোবহান বলেন, ১৯৭৩-৭৪ সালে একবার এই নৌপথটি চালু হয়েছিল। তখনো সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচল নিয়ে বিতর্ক ওঠায় তৎকালীন সরকার তা বন্ধ করে দেয়। তখন সরকার খুলনা থেকে মংলায় আসার জন্য ঘষিয়াখালী নামে একটি খাল খনন করে সেখান দিয়েই নৌযানগুলো চলত। কিন্তু দীর্ঘদিন ঠিকমতো খনন না করায় এই খালটি ভরাট হয়ে গেলে ২০১১ সালে তা আবারও শ্যালা নদী দিয়ে নৌযান চলাচল শুরু হয়।
ইশতিয়াক সোবহান বলেন, সরকার একদিকে বঙ্গোপসাগরের এ এলাকাকে বন্য প্রাণীর জন্য সামুদ্রিক সুরক্ষিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করল। আবার অন্যদিকে ওই এলাকা দিয়ে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা পরিবহনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। সোনাদিয়া দ্বীপকে যেমন বিপন্ন পাখিদের আবাসস্থল এবং প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হচ্ছে। আবার অন্যদিকে এখানে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তাহলে সরকারের কোন পরিকল্পনা ঠিক?
প্রধান বন সংরক্ষক ইউনুস আলী বলেন, বন বিভাগ সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে স্থায়ীভাবে নৌপথ বন্ধের প্রস্তাব করেছে। শ্যালা নদীসহ সুন্দরবনের অন্যান্য নদী দিয়ে নৌযান চলাচল বন্ধ করা হবে, তবে পর্যায়ক্রমে। তেল অপসারণের জন্য মোট ৫০০টি নৌযান, অপসারণকারীদের জন্য গ্লাবস ও গামবুট সরবরাহ করা হবে।
নদীতে জোয়ার-ভাটা না হলে এ দুর্ঘটনায় আরও ক্ষতি হতো এমন শঙ্কা করে ইউনুস আলী বলেন, ছড়িয়ে পড়া তেলের আস্তরণে পানি দূষিত হয়েছে। এতে কাঁকড়া, চিংড়ি, ডলফিনের মতো ধীরে চলাচলকারী জলজ প্রাণীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রাথমিকভাবে কিছু জলজ প্রাণী মারা যাবে। এ ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে ১০ বছরের মতো লাগতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
গোলটেবিল বৈঠকের সঞ্চালক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ভবিষ্যতে সুন্দরবনে যাতে এ ধরনের দুর্ঘটনা না ঘটে, সে জন্য বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী সরকারের উচিত হবে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌপথ স্থায়ীভাবে বন্ধ করা।

No comments

Powered by Blogger.