ছাত্রলীগ না ওরা ভিসি লীগ

‘চবি ছাত্রলীগ কর্মী ও সাধারণ ছাত্র তাপস সরকারকে যারা হত্যা করেছে তারা ছাত্রলীগ নয়; তারা ভিসি লীগ। ভিসির আশ্রয়-প্রশ্রয় পাওয়ার কারণেই চবির ক্যাম্পাসে সদ্য প্রবেশ করা একটি তরতাজা ছেলেকে অকালে প্রাণ হারাতে হয়েছে। তাই চবিতে শান্তি ফিরিয়ে আনতে এই ভিসির পদত্যাগ ছাড়া বিকল্প নেই।’ চবি ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম-সম্পাদক ও শাটল ট্রেনের বগিভিত্তিক সংগঠন সিএফসি গ্র“পের অন্যতম নিয়ন্ত্রক সুমন মামুন সোমবার যুগান্তরকে এমন কথা বলেন। এই দাবিতে তারা সোমবার দুপুরে ভিসিকে অন্তত এক ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখেন প্রশাসনিক ভবনের কার্যালয়ে। এদিকে যার গুলিতে নিহত হয়েছেন ছাত্রলীগ কর্মী তাপস সরকার চবি ছাত্রলীগের সেই ক্যাডার আশরাফুজ্জামান আশা রোববার দুপুরের মধ্যে ক্যাম্পাস ত্যাগ করেছেন বলে জানা গেছে। ঘটনার পর পুলিশ শাহজালাল হলসহ বিভিন্ন হল তল্লাশি করে ও ক্যাম্পাসে অভিযান চালিয়ে আশার সেকেন্ড ইন কমান্ড রুবেলসহ ৩২ জনকে আটক করলেও বিকালে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আশাকে গ্রেফতার করতে পারেনি। চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার একেএম হাফিজ আক্তার যুগান্তরকে বলেন, ‘আশাকে ধরতে আমাদের অভিযান চলছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছাত্র হিসেবে মেধাবী হলেও দু-তিন বছর আগে থেকেই আশা ক্যাম্পাসে পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও নিয়োগ-বাণিজ্যে ভিএক্স গ্রুপের অগ্রভাগে থাকায় তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। সর্বশেষ পরিণতি হিসেবে চবির সাধারণ ছাত্র তাপস সরকারের মৃত্যুতে আশা গতকাল ক্যাম্পাস ত্যাগ করে।
আশার বন্ধু-বান্ধব ও চবির প্রশাসনিক বিভাগ সূত্র জানায়, আশরাফুজ্জামান আশার বাড়ি রাজশাহী জেলা সদরে। সে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করার পর ২০০৭-০৮ সেশনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে অনার্সে ভর্তি হয়। ৩.৩০ মার্ক নিয়ে অনার্স পাস করে আশা। বর্তমানে সে মাস্টার্সের রেজাল্টের অপেক্ষায়।
সূত্র জানায়, মূলত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বগিভিত্তিক সংগঠন ছিল চ্যুজ ফ্র্যান্ড উইথ কেয়ার- সিএফসি। এটির মূল নেতা ছিলেন ছাত্রলীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি রিয়েল তার জুনিয়র হিসেবে আসেন ব্ল্যাক জুয়েল, অমিত কুমার বসু। ২০০৮ সালের দিকে সিএফসি থেকে বের হয়ে ভার্সিটি এক্সপ্রেস-ভিএক্স নামে নতুন বগিভিত্তিক সংগঠন গড়ে তোলে ব্ল্যাক জুয়েল। তার জুনিয়র হিসেবে এই গ্রুপে যোগ দেন রাকিব-সাকিব। রাকিব-সাকিবই আশরাফুজ্জামান আশা, জালাল রবিনদের ভিএক্স গ্রুপে টানে। এদিকে ২০১১ সালে ঘোষিত চবি ছাত্রলীগের কমিটিতে মামুনুল হককে সভাপতি ও এমএ খালেদকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। ভাইস প্রেসিডেন্ট করা হয় সাকিবকে। ১৫ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে ব্ল্যাক জুয়েল ও রাকিবের স্থান না হওয়ায় তারা ঘোষিত কমিটির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তাছাড়া দল ক্ষমতায় থাকায় নেতৃত্ব কাজে লাগিয়ে মামুনুল হকের গ্রুপ চবিতে নিয়োগ বাণিজ্য ও টেন্ডারবাজিসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ায় তাদের ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করা হয়। ভিএক্স গ্রুপ ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণ করে। এর মধ্যে সরাসরি সিনিয়র রাকিবকে বের করে দিয়ে ভিএক্সের নিয়ন্ত্রণ নেন আশরাফুজ্জামান আশা, জালাল, রবিন রূপনরা। প্রায় তিন বছর ধরে সিএফসি গ্র“প ক্যাম্পাস থেকে এক প্রকার বিতাড়িত থাকে। এরই মধ্যে আশার নেতৃত্বে জালাল, রবিন, রূপনরা পুরো ক্যাম্পাসে রাজত্ব করে। এই চারজনই শাহজালাল হলের তিনতলায় থাকতেন এবং তারা সবাই চবির উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের ছাত্র। সূত্র জানায়, আশা সাম্প্রতিক সময়ে তার গ্রুপ নিয়ে ক্যাম্পাসে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। চবির কোটি কোটি টাকার টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, দোকান বাণিজ্য, মাদক বাণিজ্য ও নিয়োগ বাণিজ্য করতে থাকে তারা। সূত্র জানায়, দু’মাস আগে চবির ৬টি দোকানের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করে মোটা অংকের টাকা আয় করে আশা। এই টাকায় টিভিএস ব্র্যান্ডের একটি মোটরবাইক কিনে সে। এছাড়া চবির কলাভবন নির্মাণসহ ৪০ কোটি টাকার কাজের টেন্ডার পান চবি ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা। হাটহাজারীর মদনহাটভিত্তিক চবি ছাত্রলীগের সাবেক ওই নেতার টেন্ডার তদারক করতে থাকেন আশা ও তার সহযোগীরা। চবি ভিসি প্রফেসর আনোয়ারুল আজিম আরিফও তাদের নানাভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতে থাকেন বলে ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষ গ্রুপ অভিযোগ তোলে। সূত্র জানায়, মূলত এসব কারণে অমিত বসু, সুমন মামুন ও রাকিবরা এক হয়ে পুনরায় ক্যাম্পাসে ঢুকতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। তারা নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি মহিউদ্দিন চৌধুরীকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, চবি ভিসির প্রশ্রয়ে ছাত্রলীগের নামে ক্যাম্পাসে সব ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি ও সন্ত্রাস করছে আশা-জালাল-রবিন-রূপন গ্র“প। ভিসি ছাত্রলীগের নামে ক্যাম্পাসে শিবির তোষণ করছে। এ পর্যন্ত চবির শিক্ষকসহ বিভিন্ন বিভাগে যেসব নিয়োগ হয়েছে তার অধিকাংশ নিয়োগই পেয়েছে জামায়াত-শিবির। ভিসির আত্মীয়স্বজনও রয়েছেন এই তালিকায়। আশা-জালাল গ্রুপের পরামর্শেও অনেক নিয়োগ হয়েছে। সূত্র জানায়, মূলত এরপর মহিউদ্দিন চৌধুরী অমিত বসু-সুমন মামুনদের নেতৃত্বাধীন সিএফসি গ্রুপকে ২৪ দিন আগে ক্যাম্পাস ও হলে ঢোকানোর ব্যবস্থা করেন। হলে দুই গ্রুপের সহাবস্থানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে মহিউদ্দিন চৌধুরী এ উদ্যোগ নেন। কিন্তু এর এক মাস না পেরোতেই রোববার মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী দুই গ্রুপ রোববার ক্যাম্পাসে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। গুলিতে প্রাণ হারান ছাত্রলীগের একজন সাধারণ কর্মী তাপস সরকার। চবি ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম সম্পাদক সুমন মামুন গতকাল যুগান্তরকে বলেন, ‘অতীতে পুলিশকে মারধর, টেন্ডার বক্স ছিনতাই, মুরগি চুরি থেকে শুরু করে এমন কোনো অপকর্ম নেই যা আশা-জালাল গ্রুপ করেনি। এজন্য ওই গ্র“পের ৫ কর্মী রুবেল, শুভ, সোহেল, আসিফ ও মেরাজকে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে। এর মধ্যে রুবেল রোববারের ঘটনার পর পুলিশি অভিযানে অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়।’ তার অভিযোগ ‘এরপরও চবি ভিসি ওই গ্রুপটিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন। যার পরিণতিতে একজন সাধারণ নিরীহ ছাত্রলীগ কর্মী খুন হয়েছে। এদের অপকর্মের দায় ভিসি এড়াতে পারবেন না।’
চবি ভিসি প্রফেসর আনোয়ারুল আজিম আরিফের বক্তব্য : সোমবার সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিটে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালেয়র ভিসি প্রফেসর আনোয়ারুল আজিম আরিফ যুগান্তরের সঙ্গে তার বিরুদ্ধে আনীত বিভিন্ন অভিযোগ প্রসঙ্গে কথা বলেন। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরা ভিসির প্রশ্রয় পেয়েছে এবং এরা ‘ভিসি লীগ’ হিসেবে পরিচিত- এমন অভিযোগ সঠিক নয় দাবি করে তিনি বলেন, ‘একজন ভিসি হিসেবে আমি চাই সব সময় ক্যাম্পাস শান্তিপূর্ণ থাকুক। ক্যাম্পাসে বা হলে কে থাকবে কে থাকবে না তা রাজনৈতিক দলের বিবেচনার বিষয়। কখনও এই গ্রুপ শক্তিশালী, হয়তো কখনও অন্য গ্র“প। কিন্তু ক্যাম্পাসে রোববার যেভাবে অস্ত্রের মহড়া হয়েছে, একজন ছাত্র নিহত হয়েছে সেটা তো কারও কাম্য ছিল না। বরং ক্যাম্পাসে সহিংসতা হলে, সংঘর্ষ হলে ভিসিকে, প্রক্টরিয়াল বডিকে তা সামাল দিতে হয়। পুলিশ ডাকতে হয়। তাই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কাউকে প্রশ্রয় দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। গতকাল যুগান্তরে ভিসির পেছনে দাঁড়ানো অবস্থায় তাপসের হত্যাকারী হিসেবে আশার গোল চিহ্নিত যে ছবি ছাপানো হয়েছে তা নিয়েও খানিকটা উষ্মা প্রকাশ করেন ভিসি আনোয়ারুল আজিম আরিফ। তিনি বলেন, ‘আমার পেছনে কখন কে বা কারা দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে, সে সন্ত্রাসী না ভালো ছাত্র তা আমার জানার কথা নয়। আমার অগোচরেই হয়তো এমন ছবি তোলা হয়েছে। একজন ভিসি হিসেবে আমার সেই ছবিটি ছাপানো ঠিক হয়নি।’
মঞ্জু-এরশাদের বক্তব্য : হাটহাজারীর মদনহাটভিত্তিক ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মঞ্জু-এরশাদের অনুসারী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত আশরাফুজ্জামান আশা- দৈনিক যুগান্তরে রোববার প্রকাশিত এমন সংবাদের ব্যাখ্যা দিয়েছেন চবি ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এরশাদ হোসেন। লিখিতভাবে যুগান্তরে প্রদত্ত এক ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আমার গ্রামের বাড়ি হওয়ায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা অনেক সময় আমার কাছে বিভিন্ন পরামর্শ নিতে আসেন। প্রকৃতপক্ষে আমি কোনো গ্র“পের নেতৃত্ব দিই না।’
হল থেকে অস্ত্র উদ্ধার-মামলা : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত শাহজালাল হল থেকে দুটি পিস্তলসহ বিপুল অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। রোববার রাতে হাটহাজারী থানায় এ মামলা করা হয়। মামলায় ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির উপ-সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক আশরাফুজ্জামান আশা ও ছাত্রলীগ ক্যাডার রুবেল দেসহ ৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ৬০ জনকে আসামি করা হয়েছে। হাটহাজারী থানার ওসি মো. ঈসমাইল মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। থানার উপপরিদর্শক (এসআই) হাবিবুর রহমান বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করেছেন বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, রোববার বিশ্ববিদ্যালয়ে শাহজালাল হলে দফায় দফায় তল্লাশি চালিয়ে ২টি পিস্তল, ৬ রাউন্ড গুলি, ২০টি রামদা এবং অন্তত ২০টি লোহার রড ও চাপাতি উদ্ধার করে পুলিশ।
এদিকে শাহজালাল হল থেকে আটক ২৪ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে সোমবার আদালতে পাঠিয়েছে পুলিশ। পরে কোনো রিমান্ডের আবেদন না করায় তাদের জেলহাজতে পাঠানো হয় বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম কোর্ট ইন্সপেক্টর অনু মং মারমা।
চবিতে যুগান্তরের ফটোকপি বিক্রি : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গতকাল দৈনিক যুগান্তরের ফটোকপি বিক্রি হয়েছে। বিশেষ করে চবি ছাত্র তাপস সরকারের হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত ছাত্রলীগ ক্যাডার আশরাফুজ্জামান আশার সঙ্গে চবি ভিসি প্রফেসর আনোয়ারুল আজিম আরিফের ছবি প্রথম পৃষ্ঠায় ফলাও করে প্রকাশ এবং আশাকে নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার কারণে এই নিউজ ও ছবির প্রতি ছিল চবির সাধারণ ছাত্র এবং পাঠকদের কৌতূহল। শাটল ট্রেনে ও চবির নির্ধারিত স্টলে যুগান্তরের সব কপি শেষ হয়ে যাওয়ায় ফটোকপি বিক্রি হয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.