দুর্নীতির কারণে নষ্ট হচ্ছে স্বাধীন জাতির আর্থ-সমাজিক সম্ভাবনা by ইকতেদার আহমেদ

নীতির বিপরীত শব্দ দুর্নীতি। যে কোনো ধরনের অনিয়মই দুর্নীতি হলেও এমন একটি ধারণা প্রচলিত যে, দুর্নীতি বলতে শুধু ঘুষকে বোঝায়। ঘুষ অবশ্যই দুর্নীতি; তবে ঘুষের পাশাপাশি অন্যায় ও অনিয়মও দুর্নীতি। একজন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ বা স্কুল শিক্ষক যদি কোনো কারণে একটি ছাত্র বা ছাত্রীকে দুর্বল বিবেচনায় তাকে পরীক্ষায় ভালো নম্বর দিয়ে অতি মূল্যায়িত করেন সেক্ষেত্রে এটি দুর্নীতি। অনুরূপভাবে সরকারের কোনো বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সততা, দক্ষতা ও যোগ্যতাকে অবমূল্যায়ন করে যদি কনিষ্ঠ কাউকে বিভাগের সর্বোচ্চ পদে বসানো বা পদোন্নতি দেয়া হয় সেটিও দুর্নীতি। ঘুষ বা উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে চাকরি দেয়া যেমন দুর্নীতি, তেমনি নিজের আত্মীয়স্বজন বা নিজ গ্রামের বা নিজ জেলার কোনো ব্যক্তিকে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে চাকরি দেয়াও দুর্নীতি। একজন সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অর্থ দ্বারা যদি জীবনযাপন করেন তাও দুর্নীতি। আবার একজন সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী কর্তৃক সরকারি সম্পদের যে কোনো ধরনের অপব্যবহারও দুর্নীতি; যেমন গাড়ির অপব্যবহার, টেলিফোনের অপব্যবহার। অফিসে কাজ ফাঁকি দিয়ে গল্পগুজবের মাধ্যমে সময় অপচয় করাও দুর্নীতি।
সহজ ভাষায়, নীতিবহির্ভূত যে কোনো কিছুই দুর্নীতি।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় দেশ ও সমাজের সব পর্যায়ে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয় বিধায় এ ব্যবস্থায় দুর্নীতি কম হয়। এক সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্ম। আমাদের মুক্তিসংগ্রামের মূল চেতনা ছিল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণ করা, যেখানে দেশের সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হবে।
বাঙালি জাতি ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা পরিচালনার অধিকার অর্জন করলেও পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা সেই গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ফলাফলকে অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করে বাঙালিদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের বাঙালি জাতির প্রতি এ অন্যায়ও দুর্নীতি।
বাঙালি জাতি গণতন্ত্র হরণের জন্য মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল, মুক্তিসংগ্রামের পর এ দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা স্থায়ী রূপ পাবে, যার মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দেশটি উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর বিজয়ের মাসে আজ হিসাব নেয়ার সময় এসেছে আমাদের গণতন্ত্র ও শোষণমুক্ত সমাজের অবস্থান কোথায়।
যে সংস্থাটি বিভিন্ন দেশের দুর্নীতির মাত্রা পরিমাপপূর্বক মান নির্ধারণ করে সেটির নাম ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)। এ সংস্থাটির কার্যক্রম রয়েছে বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই। এ সংস্থার ধারণা সূচকে বাংলাদেশ ২০০০ থেকে ২০০৪ সাল- এ পাঁচ বছর পরপর বিশ্বের সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। এরপর ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি হতে থাকলেও বিগত বছরের চেয়ে এ বছর দু’ধাপ নেমে বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিক থেকে ১৪তম হয়েছে। অতীতে দেখা গেছে, যখনই বাংলাদেশ টিআই কর্তৃক শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে অথবা দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান নিুমুখী হয়েছে, তখনই ক্ষমতাসীনরা একে সহজভাবে নেয়নি। এ বছরও বাংলাদেশের অবস্থান ১৬তম থেকে ১৪-তে নেমে এলে সরকার এটিকে সহজভাবে নেয়নি এবং সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে বলা হল, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) দেশের রাঘব বোয়ালদের দুর্নীতিকে অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করে ছোটখাটোদের দুর্নীতি নিয়ে বেশি ব্যস্ত।
টিআইবি কর্তৃক দেশের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বিষয়ে অতীতে যেসব জরিপ পরিচালিত হয়েছে তা পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশের প্রধান বিভাগগুলোর মধ্যে ভূমি প্রশাসন, রাজস্ব, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থাপনা, জনপ্রশাসন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির যে কোনো একটি বা একাধিক কোনো না কোনো বছর শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত বিভাগ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। যে বছর এক বা একাধিক বিভাগ শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, সে বছর দেখা গেছে, টিআইবির প্রতিবেদন যে বস্তুনিষ্ঠ নয় তা সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করে খণ্ডন করার প্রয়াস নেয়া হয়নি বা নেয়া হলেও তা খণ্ডন করতে ব্যর্থ হয়েছে।
টিআইবি একটি ট্রাস্টি বোর্ড দ্বারা পরিচালিত। প্রতিষ্ঠানটি দেশের সব বিভাগের দুর্নীতি নিয়ে মাথা ঘামালেও একবার টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হলেও দুঃখজনক হলেও সত্য, অদ্যাবধি টিআইবি এ বিষয়ে লিখিত বা মৌখিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। তাছাড়া টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডে এবং নির্বাহী দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের সবাই যে ধোয়া তুলসী পাতা, দেশবাসী সেটাও মনে করে না।
বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। ’৭০-এর দশকে প্রতিবছর আমাদের খাদ্য আমদানি করতে হতো। আজ আমাদের জনসংখ্যা ’৭০-এর দশকের তুলনায় দ্বিগুণ অতিক্রম করলেও আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এটি সম্ভব হয়েছে একমাত্র কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে। যে কৃষক আমাদের অর্থনীতিতে অনন্য অবদান রেখে চলেছেন, তার ন্যূনতম চাহিদা গণতন্ত্র ও শোষণমুক্ত সমাজ আমরা কি দিতে পেরেছি? পারিনি বলেই এখন পর্যন্ত আমাদের কাক্সিক্ষত অগ্রগতি ও উন্নতি সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতার পর বারবার আমাদের দেশে গণতন্ত্র ব্যাহত হওয়ার কারণে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের পূর্বশর্ত হল সুশাসন এবং একমাত্র গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাই সুশাসন নিশ্চিত করতে পারে।
দেশে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে একদিকে যেমন সুশাসন নিশ্চিত হয়নি, অপরদিকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে জাতি আজ দুটি ধারায় বিভক্ত। এ ধরনের বিভাজন একটি জাতির উন্নতি ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে অন্তরায়। তাই এ বিভাজন রোধের উপায় রাজনীতিকদেরই বের করতে হবে।
আমরা ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদ্যাপন করব। সরকারের পক্ষ থেকে জোর দিয়ে বলা হচ্ছে, ২০২১ সালের আগেই বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে এবং এর ২০ বছর পর বাংলাদেশের স্থান হবে উন্নত দেশের সারিতে। ২০২১ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে পারবে কি-না অথবা ২০৪১ সালে উন্নত দেশের সারিতে পৌঁছতে পারবে কি-না তা নিয়ে দেশের সচেতন জনমানুষের অনেকের মনে সংশয় থাকলেও এটি অনেকটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, আমরা যদি গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারতাম অর্থাৎ প্রতি পাঁচ বছর পরপর অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা যেত এবং দুর্নীতিকে সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসা সম্ভব হতো, তাহলে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার বহু আগেই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো যেত।
যে কোনো দেশের জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ এবং সশস্ত্র বাহিনী সে দেশের মেরুদণ্ড। একটি দেশে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হলে এবং দেশটিকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে হলে এসব বিভাগে জ্যেষ্ঠতা, দক্ষতা, যোগ্যতা, সততা ও ন্যায়পরায়ণতার মাধ্যমে নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়ন ও বদলি আবশ্যক। কিন্তু আমাদের দেশে দেখা যায়, বিভাগগুলোয় এক সরকারের সময় যারা মূল্যায়িত
হচ্ছেন, অপর সরকারের আগমনে রাজনৈতিক কারণে তাদের অবমূল্যায়িত হতে হচ্ছে। অতিমূল্যায়ন ও অবমূল্যায়নের দোলাচলে আজ এসব বিভাগের শৃংখলা অনেকটাই বিনষ্ট। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মকর্তা বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হিসেবে চরম হতাশায় দিনাতিপাত করছেন। আবার আত্মসম্মান
আছে এমন অনেক কর্মকর্তা অবমাননাকর পরিস্থিতি এড়াতে চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই স্বেচ্ছা অবসরে চলে গেছেন।
বাংলাদেশে অদ্যাবধি ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটি সংজ্ঞায়িত না হওয়ায় কে মুক্তিযোদ্ধা এবং কে মুক্তিযোদ্ধা নয় এটি নিরূপণ করা কঠিন। দেখা গেছে, সরকারের শীর্ষ পদধারী সচিবসহ অনেকেই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। এসব সচিবসহ যারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ সংগ্রহ করেছেন, শোনা যায় তাদের অনেকে তা সংগ্রহের পেছনে লাখো-কোটি টাকা ব্যয় করেছেন। তা করবেন নাইবা কেন; উচ্চ বা লোভনীয় পদে চাকরির মেয়াদ ২-৩ বছর বৃদ্ধির অর্থই হচ্ছে এর পেছনে যে টাকা লগ্নি করা হয়েছে তা সুদে-আসলে উঠে আসবে।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অনুসৃত হয় এমন সব দেশের নাগরিকরা চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্ স্বাধীনতা যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে ভোগ করে থাকেন। একটি দেশের সরকারি-বেসরকারি পদে আসীন সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী যদি মুক্তভাবে ব্যক্তি ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্ স্বাধীনতার চর্চা করতে পারেন, তবে সে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর হয় এবং দুর্নীতি লাঘবের পথ সুগম হয়। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর আমরা কি বলতে পারি, আমাদের দেশের নাগরিকরা যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তি ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্ স্বাধীনতা ভোগ করছে?
এটি অনস্বীকার্য, যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে এ দেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষ মহান মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তার মূলে ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ বিনির্মাণ। আজ আমরা এ দেশের জনমানুষের আকাক্সক্ষার গণতন্ত্র এবং দুর্নীতিমুক্ত সমাজ থেকে বহু দূরে। এ অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তা দুর্নীতির কারণে বাস্তব রূপ নিতে পারছে না।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ; সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.