শেলায় নৌরুট বন্ধে পাল্টাপাল্টি

সুন্দরবনের শেলা নদীতে নৌযান চলাচল বন্ধ করা নিয়ে পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়েছে পরিবেশ ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। গতকাল আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় ওই রুটে নৌযান চলাচল স্থায়ীভাবে বন্ধের সুপারিশ করে। তবে ওই বৈঠকে অংশ নেয়া নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান জানিয়েছেন, ওই রুটে নৌযান চলাচল স্থায়ীভাবে বন্ধে এখনই ভাবা হচ্ছে না। এটি বন্ধ করলে মংলা বন্দর স্থবির হয়ে যাবে। ওই নদীতে তেলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবে সুন্দরবনের পরিবেশ বিপর্যয় ঘটায় ওই রুটে সাময়িকভাবে নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। গতকাল অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের উপ-মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের কথা জানান। তার অনুরোধের আগেই সুন্দরবনে সব ধরনের বাণিজ্যিক চলাচল বন্ধের আহবান জানায় জাতিসংঘ। এদিকে শেলা নদী দিয়ে নৌযান চলাচল বন্ধে মংলা বন্দর কার্যত অচল হয়ে পড়বে বলে আগে থেকেই বলে আসছিলেন নৌমন্ত্রী। আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকের তিনি বলেন, শেলা নদীর চ্যানেলটি সাময়িকভাবে বন্ধ থাকায় জাহাজগুলোকে ১০০ কিলোমিটার ঘুরে যেতে হচ্ছে। বিকল্প হিসেবে জাহাজগুলো নবগঙ্গা, আত্রাই ও মধুমতি নদী দিয়ে চলাচল করতে পারতো। কিন্তু নদীগুলোতে ব্রিজ থাকায় জাহাজ চলাচল সম্ভব নয়। ব্রিজে জাহাজ আটকে যাবে। ওই সভায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব আবুল কালাম আজাদ, নৌ মন্ত্রণালয়ের সচিব শফিক আলম মেহেদী, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব আবু বকর সিদ্দিক, প্রধান বন সংরক্ষক মো. ইউনুস আলী, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খন্দকার রাকিবুর রহমান, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের চেয়ারম্যান মো. ইউনুসুর রহমান, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আ ল ম আবদুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। এর আগে গত ৯ই ডিসেম্বর শেলা নদীতে কার্গোর ধাক্কায় সাড়ে ৩ লাখ লিটার ফার্নেস অয়েলবাহী একটি অয়েল ট্যাঙ্কার ডুবে গেলে তেল ছড়িয়ে পড়ে সুন্দরবনের নদী ও খালগুলোতে। এতে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করা হলে নৌমন্ত্রণালয় বনের ভেতর দিয়ে  শেলা নদীতে নৌযান চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়। এদিকে ছড়িয়ে পড়া তেল সুন্দরবনের উপর অবশ্যই ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে বলে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে জানায় পরিবেশ মন্ত্রণালয়। এর আগে গত শনিবার নৌমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, তেলে বনের কোন ক্ষতি হবে না। নৌমন্ত্রীর এ বক্তব্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব খোন্দকার রাকিবুর রহমান বলেন, নৌমন্ত্রী বক্তব্য তার নিজস্ব, আর আমাদের বক্তব্য পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের। এ ঘটনায় সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতি হবে, তবে কতটুকু ক্ষতি হয়েছে তা তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর জানা যাবে।
শেলা নদীর রুট স্থায়ী বন্ধ চায় বন মন্ত্রণালয়: সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে যান চলাচলে শেলা নদীর এ রুটের স্থায়ী বন্ধ চায় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। পরিবেশ উপমন্ত্রী বলেন, এ রুটটির অনুমোদন দেয়  নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। আমরা বহুবার নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছি, অনুরোধ করেছি সুন্দরবনকে রক্ষা করতে হলে এ রুট বন্ধ করতে হবে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় এ কথা বলেন তিনি। উপমন্ত্রী বলেন, সুন্দরবনের যে এলাকায় জাহাজ ডুবেছে  সেখানকার অধিবাসীদের চর্মরোগ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এ জন্য সেখানে মেডিকেল টিম পাঠানোর জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে। হোয়াইট ফিস রক্ষার জন্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে সংগৃহীত তেল সংগ্রহের জন্য আরো ক্রয়কেন্দ্র খুলতে বলেছি আমরা। সভায় তেলের দাম বাড়ানোরও সুপারিশ করা হয়েছে। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অধিবাসীদের সহায়তা দিতে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
জলে ভাসমান তেলের দাম বেড়েছে: ট্যাঙ্কারডুবিতে সুন্দরবনের নদী ও খালগুলোর পানিতে ভেসে থাকা প্রতি লিটার তেলের দাম বাড়িয়ে ৪০ টাকা দরে কিনবে রাষ্ট্রায়ত্ত পদ্মা অয়েল কোম্পানি। পরিবেশের ক্ষতি কমাতে জলে ভাসমান তেল সংগ্রহে প্রথমে স্থানীয়দের নামানো হয়। আর সেখানে ক্রয়কেন্দ্র খুলে সেই তেল প্রতি লিটার ৩০ টাকা করে কিনছিল পদ্মা অয়েল। এরপর বন বিভাগও ট্রলার ও নৌকায় শ্রমিক নামায় তেল ওঠাতে। গতকালের আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় তেল কেনার দর বাড়িয়ে ৪০ টাকার সিদ্ধান্ত হয় বলে নৌমন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত তেল পদ্মা অয়েল কোম্পানি সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভ্রাম্যমাণ ক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করবে। প্রতি লিটার তেল ৩০ টাকার পরিবর্তে ৪০ টাকা দরে ক্রয় করবে। পরিবেশ উপমন্ত্রী জ্যাকব সাংবাদিকদের বলেন, বর্তমানে ১০০ নৌকা দিয়ে ৩০০ কর্মীর মাধ্যমে তেল সংগ্রহ করা হচ্ছে। কমপক্ষে ৫০০ নৌকা দিয়ে লোকজনকে উৎসাহ যুগিয়ে তেল সংগ্রহ করার জন্যও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
ডলফিনের বিচরণ স্বাভাবিক দাবি: শেলা নদীতে ডলফিনের বিচরণ শনিবারও দেখা গেছে বলে জানান পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব রাকিব। তিনি বলেন, তেল দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব কমিয়ে আনতে বিদেশী বিশেষজ্ঞ বা বিদেশীদের সহযোগিতা নেয়ার সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। তেল ছড়ানো নিয়ে গণমাধ্যমের সব প্রতিবেদনও সঠিক নয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব বলেন, একটি মিডিয়ায় এসেছে ৩৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় তেল ছড়িয়েছে, আসলে তা সঠিক নয়। ঢাকা থেকে ওই স্পটের দূরত্বও অত না। আমরা যত দূর জেনেছি, ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে তেল ছড়িয়েছে। ওই সভায় ক্ষতিগ্রস্ত কাঁকড়া, ঝিনুক ও মৎস্য আহরণকারীদের এক মাসের আপৎকালীন ত্রাণ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ট্যাংকার চালকের লাশ উদ্ধার
স্টাফ রিপোর্টার, খুলনা ও মংলা প্রতিনিধি জানান,  সুন্দরবনের শেলা নদীতে ডুবে যাওয়া তেলবাহী ট্যাংকার চালক (মাস্টার) মোকছেদ মাতুব্বরের (৫৭) লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ট্যাংকার ডুবির পাঁচ দিন পর  রোববার সকালে শেলা নদীর মৃগমারী এলাকা থেকে তার লাশ উদ্ধার করেন স্বজনরা। মোকছেদের বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মীপাশা গ্রামে। তার পিতার নাম ইজ্জত আলী হাওলাদার।  মোকছেদের লাশ উদ্ধার করেন তার মেয়ের জামাই শহীদুল ইসলাম। তিনি জানান, ট্যাংকার ডুবির পর থেকে নিখোঁজ ছিলেন তিনি। তাকে খুঁজে পেতে ৩/৪টি ট্রলার নিয়ে স্বজনরা শেলা নদীর আশপাশের এলাকাগুলোতে সন্ধান চালাচ্ছিলেন। রোববার ভোর সাড়ে ৬টার দিকে মৃগমারী এলাকার বাদামতলী খাল থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। পরে লাশটি জয়মণি এলাকার চাঁদপাই রেঞ্জে নেয়া হয়েছে। পুলিশের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। জয়মণি চাঁদপাই নৌ পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, সুরতহাল শেষে ময়না তদন্তের জন্য লাশ বাগেরহাট সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
২৫ হাজার লিটার তেল সংগ্রহ: ঘটনার ৬ষ্ঠ দিনেও আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে চলছে তেল সংগ্রহের কাজ। রোববার দুপুর একটা পর্যন্ত সর্বমোট ২৫ হাজার লিটার ফার্নেস অয়েল সংগ্রহ করা হয়েছে। স্থানীয়রা ভাটার শুরুতে তাদের নৌকা নিয়ে সুন্দরবনের নদী খাল এবং বিভিন্ন চরে চলে যাচ্ছেন এবং জোয়ার শুরু হলে তারা সংগ্রহ করা তেল নিয়ে জয়মণি গ্রামে ফিরে আসছেন। মাটি এবং নানা ধরনের আবর্জনা   মেশানো ফার্নেস অয়েল জালে ছেঁকে কিছুটা পরিষ্কার করে তবে তা সংগ্রহ করা হচ্ছে বলে জানান তেল সংগ্রাহক রফিকুল ইসলাম বাবলু। মংলা বন্দরের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান ভুইয়া বলেছেন, স্থানীয় মানুষদের সম্পৃক্ত করে তাদের তেল সংগ্রহ অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এখন পর্যন্ত সর্বমোট ২৫ হাজার লিটার ফার্নেস অয়েল সংগ্রহ করা হয়েছে। একই কথা বলেছেন সুন্দরবন সংরক্ষক কার্ত্তিক চন্দ্র সরকার।
নদীতে মৃত ডলফিন: শনিবার নদীর একটি চ্যানেলে মৃত ইরাবতী ডলফিন পাওয়া গেছে। ইতিমধ্যেই শুশুকসহ বিভিন্ন মৃত প্রাণী পাওয়া  গেলেও এবার ডলফিন পাওয়ায় উদ্বেগ বাড়ছে। ডলফিনের জন্য সংরক্ষিত এলাকায় তেলের কারণে মারা গেছে ডলফিনটি। যদিও বন বিভাগ ডলফিনের মৃত্যুর বিষয় স্বীকার করেনি। নদীর হারিণটানা-তাম্বুলবুনিয়া চ্যানেলে একটি মৃত ইরাবতি ডলফিনের খোঁজ পান। তেলবাহী ট্যাংকার যেখানে ডুবেছিল সেখান থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে মৃত ইরাবতীকে পাওয়া যায়। শেলা নদীতে দুই প্রজাতির ডলফিনের অভয়াশ্রম। সাড়ে ৩ লাখ লিটার তেলসহ ট্যাংকার ডুবির ঘটনায় বিরল এ সামুদ্রিক প্রজাতির জীবন সংশয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল। শুক্রবারেই বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছিল। তবে এই প্রথম কোন ডলফিনে মারা যাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
দেখা মিলছে না ডলফিনের: কয়েক বছর আগেও প্রাণিবিজ্ঞানীদের কাছে ইরাবতী ছিল হারিয়ে যাওয়া ডলফিন। বিশ্বের সবাই জানতো ইরাবতী ডলফিন পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাংলাদেশের একদল প্রাণিবিজ্ঞানী কয়েক বছর আগে সুন্দরবনসহ উপকূলে খুঁজে পান দুর্লভ ওই ডলফিনসহ ৬ প্রজাতির ডলফিন। হারিয়ে যাওয়া ডলফিন ইরাবতীর সন্ধান মিলেছে সুন্দরবনে- এ খবরে তখন সারা বিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি করে। গত ৯ই ডিসেম্বর সুন্দরবনের শেলা নদীতে ফার্নেস অয়েল  বোঝাই ট্যাংকার ডুবির পর তেল ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। ওইদিন সকাল  থেকেই শ্যালা নদীতে ডলফিনের অভয়াশ্রমে আর দেখা মিলছে না ইরাবতীসহ ৬ প্রজাতির ডলফিনের। সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদ ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম জানান, ইরাবতীসহ সুন্দরবনের ৬ প্রজাতির ডলফিন খুবই স্পর্শকাতর। তারা যখন বুঝেছে তাদের অভায়াশ্রম আক্রান্ত হয়েছে তারা দ্রুতই স্থান ত্যাগ করেছে এমনটিই মনে হচ্ছে। গত ৫ দিনে শেলা নদীসহ আশপাশের কোথাও কেউ ডলফিনের দেখা পায়নি। সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকায় ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়ায় ডলফিন যদি সুন্দরবন ত্যাগ করে তবে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম আরও বলেন, সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী সুন্দরবনে ৪৪৪টি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মধ্যে ৬৩টির বাস এই শেলা নদী এলাকায়। এ রয়েল বেঙ্গল টাইগারেরও দেখা মিলছে না। আমাদের এ সম্পদ হারানোর জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়সহ যারাই দায়ী তাদের একদিন জাতির কাছে জবাবদিহি করতে হবে। এ ব্যাপারে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ও তদন্ত কমিটির সদস্য প্রফেসর ড. দিলীপ কুমার দত্ত বলেন, যে এলাকায় ট্যাংকারটি ডুবেছে ওই এলাকাটি ডলফিনের অভয়াশ্রম হিসেবে পরিচিত। ইতিপূর্বে ওই এলাকায় ২০ থেকে ৩০টি ডলফিন দেখা গেছে। কিন্তু ঘটনার পর থেকে আর কোন ডলফিন দেখা যাচ্ছে না।
মংলায় আটকা দুই শতাধিক লাইটারেজ জাহাজ: সুন্দরবনের অয়েল ট্যাংকার ডুবির পর বন্ধ করে দেয়া হয় অবৈধভাবে চলা শেলা নদীর চ্যানেলটি। ফলে মংলা বন্দরে আটকা পড়েছে দুই শতাধিক লাইটারেজ জলযান। এসব জলযানের মাস্টার ও ক্রুরা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। সারা দেশের সঙ্গে মংলা বন্দরের নৌযোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। মংলা বন্দরে অবস্থানরত ১১টি জাহাজে পণ্য ওঠানো নামানোর কাজ দারুণভাবে ব্যাহত হয়েছে। মংলা বন্দর হারবার মাস্টার খান মো. আখতারুজ্জামান এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
বিবিসিতে ট্যাঙ্কারডুবি
বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের পরিবেশ বিপর্যয় মোকাবিলায় বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় শেলা নদীতে জাহাজ চলাচল স্থায়ীভাবে বন্ধ রাখার সুপারিশ করলেও নৌ পরিবহন মন্ত্রী তা নাকচ করে দিয়েছেন। গত মঙ্গলবার শেলা নদীতে এক ট্যাঙ্কার ডুবে গেলে সাড়ে তিন লাখ লিটার ফার্নেস তেল পানিতে ছড়িয়ে পড়ে। সুন্দরবনের ইতিহাসে এটি এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় পরিবেশ বিপর্যয় সৃষ্টি করতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। গতকাল ঢাকায় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় সুন্দরবনে নৌ-চলাচল বন্ধের সুপারিশ করা হয়। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচল বনের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে- নৌ-মন্ত্রণালয়কে এর আগেও বারবার জানানো হয়েছে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। তবে তা আমলে নেয়নি নৌ মন্ত্রণালয়। এ খবর দিয়েছে বিবিসি। এতে বলা হয়, এবার আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক ডেকে বনের ভেতর দিয়ে এই নৌরুট স্থায়ীভাবে বন্ধের জন্য নৌ মন্ত্রণালয়কে সরাসরি অনুরোধ জানিয়েছেন বন ও পরিবেশ বিষয়ক উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব। তিনি বলেন, এটা সমপূর্ণ নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার। এই রুট নিয়ে আমরা আগে থেকেই ওনাদের অনুরোধপত্র দিয়েছি এবং তাদের আমরা বলেছি যে, সুন্দরবনের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এ রুটটি বন্ধ করতে হবে। দুর্ঘটনাকবলিত স্থানসহ অন্য যে সব এলাকায় এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে ওই সব স্থানে নৌ চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ করার জন্য আমরা নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়ে সুপারিশ আকারে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তা নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়কে ইতিমধ্যেই আমরা জানিয়েছি। গত মঙ্গলবার শেলা নদীতে তেলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবে যে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে, ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে, সে জন্য ঘষিয়াখালী-মংলা রুটটি সংস্কার করে পুনরায় চালু করারও সুপারিশ করেছে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়। এর আগে ওই পথেই মংলা বন্দর দিয়ে জাহাজ চলাচল করতো। এরপর ২০১১ সালে সুন্দরবনের ভেতরেই নৌপথ চালু করে নৌ-মন্ত্রণালয় এবং প্রতিদিনই প্রায় ১৫০ নৌযান ওই রুটে যাওয়া-আসা করতো। তেল ট্যাঙ্কারডুবির পর রুটটি সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছে নৌ মন্ত্রণালয়। তবে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন শুরু থেকেই এই রুট বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছিল। জাহাজডুবির ঘটনার পর সে দাবি আরও জোরালোভাবে উঠেছে। সেই সঙ্গে এই রুট ব্যবহারের অনুমতি দেয়ায় সমালোচনার মুখে পড়েছে নৌ মন্ত্রণালয়। তবে এ ঘটনার পরও সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে পণ্যবাহী নৌ চলাচলের বিষয়ে এখনই কোন সিদ্ধান্ত নিতে রাজি নয় নৌ-মন্ত্রণালয়। বিবিসিকে নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খান বলেন, আমরা তো এটা বন্ধই করতে চাই। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ঘুষিয়াখালী চ্যানেল নাব্য হারানোর কারণে সে চ্যানেল দিয়ে নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমাদের বিকল্প রাস্তা খুলতে হয়েছে সুন্দরবনের এ চ্যানেলটিতে। আমাদের এ চ্যানেলটি একরকম বাধ্য হয়েই ব্যবহার করতে হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, আমরাও জানি, আশঙ্কা উঠেছে। আমরাও করছি, বিদেশেও সবাই এই আশঙ্কা করছে। এই আশঙ্কা অমূলক নয়। আপাতত আমরা ওটা নিয়ে চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি। সুন্দরবনসহ দেশের জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলন করছেন যারা, তারা বলছেন, সরকার সুন্দরবনের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারলে যত দ্রুত সম্ভব এ রুট বন্ধের ঘোষণা আসতো। এমনই একজন আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, সুন্দরবনের গুরুত্ব সম্পর্কে সরকারের বোধ থাকলে, তারা সুন্দরবনের এ বিপদ সম্পর্কে সচেতন থাকতো এবং যথাযথভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতো। যে কারণে নৌমন্ত্রী এখনও বলতে পারছেন, যে তেল পড়েছে, সে তেলে সুন্দরবনের কোন ক্ষতি হবে না। যারা এ ধরনের কথা বলতে পারেন, তারা এ নৌ-রুট নিয়েও একটা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবেন, এটা তো বিস্ময়কর নয়, খুবই উদ্বেগজনক। নৌ-মন্ত্রী বলেছেন, এই রুট বন্ধ থাকায় জাহাজ চলাচলে বিঘ্ন ঘটায় ইতিমধ্যেই লোকসান শুরু হয়েছে। অন্যদিকে জাহাজডুবির কারণে সুন্দরবনের ওপর জীবিকা যাদের, তারাও লাখ লাখ টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছেন। ফলে দ্রুতগতিতে বিকল্প রুটের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন পরিবেশবিদরা। একই সঙ্গে মংলা-ঘোষিয়াখালী নৌ-পথ খনন করে আবারও চালু করার সুপারিশ করেছে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়। সুন্দরবনের তেলের ট্যাঙ্কারডুবির ঘটনায় এখন পর্যন্ত যে কটি বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে, তার মধ্যে একটি হলো ডলফিন। স্থানীয় ভাষায় যাদেরকে শুশুক নামেও ডাকা হয়। সুন্দরবনের উপকূলীয় এলাকায় ইরাবতি ডলফিনের বাস। শেলা নদীতে তেল ছড়িয়ে পড়ার পর এরকম একটি মৃত ডলফিনের  ছবি গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচার পেয়েছে। এই মৃত ডলফিনকে দেখেছেন ট্যুর অপারেটর বেঙ্গল ট্যুরের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ হোসেন। তিনি বলেন, আমরা যেখানে ডলফিনটা ভেসে থাকতে দেখি, সেটি হচ্ছে জাহাজডুবির স্থান থেকে ৪০-৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে। তাম্বুলবুনিয়া ফরেস্ট অফিস থেকে আরও ৫-৭ কিলোমিটার দক্ষিণে ও হরিণটানা ফরেস্ট অফিসের আগে একটা জায়গাতে  হাতের বাম পাশে আমরা যাওয়ার সময় দেখতে পাই, সাদা একটা অবজেক্ট ভাসছে পানিতে। বাইনোকুলার থেকে আমি প্রথম যখন দেখলাম, তখন মনে হচ্ছিল মাছ। পরে আমরা সিপডবোট দিয়ে কাছাকাছি যাই এবং গিয়ে দেখি যে এটা একটা ডলফিন এবং নারী ইরাবতি ডলফিন। মনে হয়েছে তিন-চারদিন আগের মরা। আমরা দেখলাম ১২ তারিখ সন্ধ্যায়, মরেছে হয়তো ৮-৯ তারিখের কোন একটা সময়। ডলফিন দেখার স্থানে তেলের দূষণ ছিল কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হ্যাঁ, তেলের দূষণ ছিল। ঘটনার দিন তিনটার দিকে আমার সঙ্গে ১০-১২ জন বিদেশী নিয়ে বেরিয়েছিলাম। তখন গাছের গায়ে, কচুরিপানাতে তেলের দাগ স্পষ্ট ছিল এবং তেল ভেসে বেড়াচ্ছিল। যেহেতু ভাটির সময়, তাই অনেক দূর পর্যন্ত চলে আসছিল তেল। এই ডলফিনটা তেলের দূষণেই মারা যাওয়া নিয়ে নিশ্চিত হওয়ার উপায় আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই। এটি সমপর্কে প্রাথমিকভাবে জানার উপায় নেই। পরীক্ষা করতে হবে। তবে ওটার গায়ে কোন ক্ষত চিহ্ন ছিল না। ওই এলাকায় ডলফিন ছাড়া আর কোন প্রাণী দূষণের শিকার হয়েছে, এমন প্রশ্নের ব্যাপারে তিনি বলেন, যে জায়গাটাকে আমরা কুমিরের অভয়ারণ্যও বলি, যেখানে কুমির ডিম পাড়ে ও বাচ্চা দেয়, ওই অঞ্চলতা পুরোটা তেলে একেবারে কালো হয়ে গেছে। আগামী কত বছর পরে যে কুমির এ অঞ্চলে আসবে তা আমি জানি না। যে সব পাখি নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়ায় ও ওখান থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে, তাদের পক্ষে দুই-চার-দশ বছরেও ওখানে পুনরায় বসবাস করা সম্ভব হবে বলে আমার মনে হয় না। ওই অঞ্চলে প্রচুর কুমির ও গুঁইসাপ দেখতে পাই সাধারণত। কিন্তু এবার গুঁইসাপ বা কুমির একেবারেই আমি দেখিনি। ওখানে কোন ধরনের স্তন্যপায়ী প্রাণীই আমি দেখিনি এই ট্রিপটাতে। তার সঙ্গে থাকা দেশী-বিদেশী পর্যটকদের প্রতিক্রিয়া কি ছিল জানতে চাইলে মাসুদ হোসেন বলেন, আসার পথে ওরা মোটামুটি কম-বেশি সবাই দেখেছে। তাদের সবার বক্তব্য ছিল যে, এটা কিভাবে রিকভার করা হবে, কারও জানা নেই। আদৌ কি কোন পদ্ধতি আছে কিনা এ জায়গাটাকে পরিষ্কার করার- এমন প্রশ্নও ছিল। আমি বলেছি, না, আমাদের এমন কোন প্রযুক্তি নেই। তারা সবাই বলছিল, এতে এ অঞ্চলের বন্যপ্রাণীর জন্য বিশাল বড় ক্ষতি হবে। প্রত্যেকেই এ কথা বলছিল। অনেকে ছবি তুলছিল। প্রশ্ন করছিল। কিন্তু আমি যেহেতু বিশেষজ্ঞ নই, তাই তাদের প্রশ্নের সদুত্তর আমি দিতে পারিনি। তারা সবাই ভীষণভাবে শঙ্কিত ছিল।

No comments

Powered by Blogger.