বিবর্ণ হতে শুরু করেছে সুন্দরবন

বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে অয়েল ট্যাংকার ডুবির ঘটনায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। জোয়ারের পানিতে ভেসে আসা ফার্নেস অয়েলের আবরণে ঢাকা পড়েছে বৃক্ষরাজির শ্বাসমূল। নদী তীরের ছনেরবন, গোলপাতা, কেওড়া, হেতাল, গেওয়া, সুন্দরীসহ সব উদ্ভিদকে জড়িয়ে থাকা কালো ফার্নেস অয়েল যেন বৃক্ষরাজিকে দম বন্ধ করে রেখেছে। এতে বিবর্ণ হতে শুরু করেছে সুন্দরবনের বৃক্ষরাজি। ইতিমধ্যেই অসংখ্য গাছের পাতা কুঁকড়ে এসেছে। খোদ সুন্দরবন বিভাগীয় কর্মকর্তাই এমন কথা স্বীকার করেছেন। গাছের গায়ে লেগে থাকা তেল শুকিয়ে তা এখন আলকাতরার মতো হয়ে আছে। ওই তেল এখন আর অপসারণ করা সম্ভব নয় বলে জানা গেছে। নদীর চরের তেল অপসারণ করতে মাটি কাটা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই বলে অনেকে মনে করছেন। তবে বনের অভ্যন্তরে এক পানির পাম্প দিয়ে গাছের সঙ্গে লেগে থাকা তেল পরিষ্কারের চেষ্টা করা হচ্ছে। এছাড়া ভাসমান তেল অপসারণের জন্য নদীতে কচুরিপানা ফেলা হবে বলে জানা গেছে। এদিকে ডুবে যাওয়া ট্যাংকারের মাস্টার মোকলেসুর রহমানের দাফন বরিশালের বাকেরগঞ্জের লক্ষ্মীপাশা গ্রামে সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া খুলনায় গোলটেবিল বৈঠকে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে নৌযান চলাচল বন্ধের দাবি জানানো হয়েছে। সুন্দরবন রক্ষার দাবিতে প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপিও দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে খুলনা বিভাগীয় নৌপরিবহন মালিক গ্রুপের পক্ষ থেকে জয়মনি-শ্যালা রুটে নৌযান চলাচল বন্ধের প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। যুগান্তরের খুলনা ব্যুরো অফিস থেকে শেখ আবু হাসান, হেদায়েৎ হোসেন ও বাগেরহাট থেকে শওকত হোসেন বাবু জানান-
বাগেরহাট : দূর থেকে দেখে মনে হয় কারা যেন আলকাতরা প্রলেপ দিয়ে রেখেছে সারিবদ্ধ গাছগুলোতে। খুব কাছে গিয়ে দেখলে ফার্নেস অয়েলের প্রভাব কতটা নৈসর্গিক বনের ওপর প্রভাব ফেলেছে তা পরিষ্কার হয়ে ওঠে। গত ৬ দিনে জোয়ার-ভাটায় নদীর তেল অনেকটা ভেসে গেলেও ক্ষত রেখে গেছে বনের সবুজ গাছে। নদীর ঘোলা পানিতে দেখা মিলছে না লোনা ভেসে বেড়ানো অসংখ্য পোনা মাছের ঝাঁক। জোয়ারের পানিতে ভেসে আসা ফার্নেস অয়েলের আবরণে ঢাকা পড়েছে বৃক্ষরাজির শ্বাসমূল। ইতিমধ্যেই অসংখ্য গাছের পাতা কুঁকড়ে এসেছে। বিবর্ণরূপ নিতে শুরু করেছে শ্যালা নদী তীরের বৃক্ষরাজি।
এ ব্যাপারে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. আমির হোসেন চৌধুরী জানান, নদী-খালে ভেসে যাওয়া তেল গাছের নিচের অংশ ও শ্বাসমূলে জড়িয়ে যাওয়ায় এরই মধ্যে বিবর্ণ হয়ে পড়তে শুরু করেছে গাছপালা। গাছের পাতা আস্তে আস্তে হলুদ হতে চলেছে। গাছের গায়ে লেগে থাকা তেল শুকিয়ে তা এখন আলকাতরার মতো হয়ে আছে। এই তেল এখন আর অপসারণ করা সম্ভব নয়। এছাড়া নদীর চরের তেল অপসারণ করতে মাটি কাটা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) মংলার আহ্বায়ক মো. নূর আলম বলেন, নদীর ঘোলাপানিতে যে অসংখ্য পোনা ভেসে বেড়ায় তার দেখা নেই, জলজপ্রাণীর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে যা দৃশ্যমান নয়। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, তেল অপসারণে এখন যা হচ্ছে তা দেখে মনে হচ্ছে এটি আইওয়াশ। বনের এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে যে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন তা করা হচ্ছে না। অগণিত গাছের শ্বাসমূল তেলে আবৃত হয়ে আছে, যা অপসারণের জন্য ফোম, কর্মীদের গ্লাভস সরবরাহসহ অসংখ্য মানুষকে এ কাজে নিয়োজিত করা প্রয়োজন তার কিছুই হচ্ছে না।
তিনি জানান, বনের বৃক্ষরাজির শ্বাসমূলসহ বিভিন্নস্থানে যে পরিমাণ তেল লেগে আছে তা দ্রুত অপসারণ করা না গেলে বনের ইকোসিস্টেম ভেঙে পড়বে। সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের অন্তর্গত শ্যালা নদীতে দীর্ঘক্ষণ ঘুরেও দেখা মেলেনি কোনো মাছ বা জলজপ্রাণীর। নদী তীরে দেখা যায়নি হরিণ বা অন্য প্রাণী। শ্যালা নদীর দুই তীরে সবুজ বনে এখন কেবলই তেলের ছোপ ছোপ কালো দাগ। এসব এলাকার নদী-খালগুলোর দুই পাড়ের গাছের পাতা ও শ্বাসমূল এখনও ঢেকে আছে কালো তেলের আবরণে।
বাড়ল বনবিভাগ গঠিত তদন্ত কমিটির সময়সীমা : ঘটনার পর বনবিভাগের গঠিত তদন্ত কমিটিকে তিন কার্যদিবসে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছিলেন বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. আমির হোসেন চৌধুরী। গত ১৩ ডিসেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার কথা থাকলেও এর মেয়াদ বাড়িয়ে ২০ ডিসেম্বর করা হয়েছে।
বাড়ানো হয়েছে নৌকার সংখ্যা, কর্মীদের দেয়া হল গ্লাভস : দুর্ঘটনার শিকার সুন্দরবনের নদী-খাল থেকে তেল অপসারণের জন্য শ্রমিকদের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি চলছে আরও নতুন নৌকা বাড়ানোর প্রস্তুতি। ইতিমধ্যে তেল অপসারণে সুন্দরবনে ৫শ নৌকা বাড়ানোর জন্য প্রধান বন সংরক্ষকের নির্দেশ পেয়েছেন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা। শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি স্প্রের মাধ্যমে শুরু হয়েছে শ্বাসমূলের তেল বের করার কাজ।
এছাড়া নদী ও খালে ভেসে বেড়াতে তেল অপসারণের জন্য শরণখোলা থেকে দুটি ট্রলারে করে কচুরিপানা আনা হবে। এ কচুরিপানা খালের তীরে ফেলা হবে নদীতে ভেসে থাকা তেল অপসারণের জন্য।
এদিকে সুন্দরবনের শ্যালা নদী থেকে তেল দ্রুত অপসারণ করে বন ও জীববৈচিত্র্যকে রক্ষাসহ সব প্রকার নৌযান বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন করেছে বাগেরহাট শহরবাসী। সোমবার সকাল ৯টায় বাগেরহাট ট্যুরিস্ট ক্লাব ও সুন্দরবন রিসোর্টের যৌথ উদ্যোগে বাগেরহাট প্রেস ক্লাবের সামনে এই মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়।
খুলনা ব্যুরো : খুলনা বিভাগীয় অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন মালিক গ্রুপ জয়মনি-শ্যালা নৌরুটে নৌযান চলাচলের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তারা অভিযোগ করেছেন, রামপাল-মংলা-ঘষিয়াখালি নদীর নাব্য হ্রাসের ফলে ওই রুটটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রায় ৭ বছর ধরে মংলা থেকে ৬০ কিলোমিটার ঘুরে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জয়মনি-বগিনালা-শ্যালা নৌরুটে নৌযান চলাচল করে আসছে। কিন্তু কোনো এক অশুভ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মংলাবন্দরকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা করা হচ্ছে। সোমবার দুপুরে খুলনা প্রেস ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন মংলা বন্দর ব্যবহারকারী সমন্বয় কমিটির মহাসচিব মো. সাইফুল ইসলাম।
এদিকে সুন্দরবনের জীবন বাঁচাতে আমাদের করণীয় শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক সোমবার খুলনায় অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বক্তারা সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে সব ধরনের নৌ-চলাচল বন্ধ করার আহ্বান জানান। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), জনউদ্যোগ, বারসিক ও ক্লিনের অয়োজিত এ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন খুলনার আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট কুদরত-ই-খুদা। সঞ্চালনা করেন বিভাগীয় প্রেস ক্লাব ফেডারেশনের সভাপতি লিয়াকত আলী।
এছাড়া মানবসৃষ্ট দুর্যোগের হাত থেকে সুন্দরবনকে রক্ষার জন্য সুন্দরবন বাঁচাও আন্দোলন সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেছে। খুলনা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে এ স্মারকলিপি প্রদান করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.