ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিহত- ফুল হাতে পাশাপাশি, এক ঘণ্টা পর খুন তাপস সরকার

রোববার সকাল ১০টা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবী চত্বর। ছাত্রলীগের দুই পক্ষের নেতা-কর্মীরা একসঙ্গে শ্রদ্ধা জানালেন একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের। বেলা সোয়া ১১টা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ আমানত হলের গেট। দুই পক্ষ মুখোমুখি। এবার নিজেদের কর্মীকেই গুলি করে হত্যা করল ছাত্রলীগের এক পক্ষ। ফুল হাতে পাশাপাশি হেঁটে চলার সোয়া এক ঘণ্টার মধ্যেই খুব কাছে থেকে সতীর্থের গুলি ছিন্নভিন্ন করল তাপস সরকারের বুক। নিহত তাপস বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার এ কে এম হাফিজ আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে তাপস সরকার খুন হয়েছেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর গত ছয় বছরে সারা দেশে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে এ নিয়ে ৪০ জন নেতা-কর্মী প্রাণ হারালেন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্র জানায়, বেদিতে ফুল দেওয়ার সময় ছাত্রলীগের দুই পক্ষ ভিএক্স (ভার্সিটি এক্সপ্রেস) এবং সিএফসি (চুজ ফ্রেন্ডস উইথ কেয়ার) ও ‘ক্যাম্পাস ছাত্রলীগ’-এর নেতা-কর্মীদের মধ্যে সামান্য কথা-কাটাকাটি হয়। দুই পক্ষই নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী।
শ্রদ্ধা জানানোর পর সিএফসি ও ক্যাম্পাস ছাত্রলীগ পক্ষের নেতা-কর্মীরা শাহ আমানত হলের দিকে যেতে থাকেন। এ সময় ১৫ গজ দূরের শাহজালাল হল থেকে ভিএক্স পক্ষের নেতা-কর্মীরা প্রতিপক্ষকে লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপ করেন। এতে সিএফসি ও ক্যাম্পাস ছাত্রলীগ পক্ষের তিন কর্মী সামান্য আহত হন।
এ খবর ছড়িয়ে পড়লে শাহজালাল ছাত্রাবাসের সামনে ভিএক্স পক্ষের নেতা-কর্মীরা এবং শাহ আমানত হলের সামনে সিএফসি ও ক্যাম্পাস ছাত্রলীগ পক্ষের নেতা-কর্মীরা অবস্থান নেন। দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার মধ্যে সিএফসি পক্ষের কর্মী তাপসের বুকে গুলি লাগে। তাঁকে প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হলে বেলা পৌনে একটায় জরুরি বিভাগের চিকিৎসকেরা তাপসকে মৃত ঘোষণা করেন।
তাপসের গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলায়। বেলা আড়াইটায় তাঁর লাশ নিয়ে সুনামগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হন সহপাঠীরা। তাঁর বাবার নাম বাবুল সরকার, মায়ের নাম অঞ্জলী সরকার। পাঁচ সন্তানের মধ্যে তাপস তৃতীয়। তাপস সরকারের লাশ দেখতে হাসপাতালে যান মহিউদ্দিন চৌধুরী। এ সময় তিনি বলেন, ‘যারা ছাত্রলীগ করে, তারা সবাই আমার ছেলে। খুনের ঘটনায় যে বা যারা জড়িত, তাদেরকে তদন্ত করে বের করে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে।’
হত্যাকাণ্ডের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহজালাল হলে তল্লাশি চালিয়ে ছাত্রলীগের ভিএক্স পক্ষের ২৭ জন নেতা-কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। দুপুরে শাহজালাল এবং সন্ধ্যায় শাহ আমানত হলে পুলিশ তল্লাশি চালিয়ে অস্ত্র, পাথর ও লাঠিসোঁটা উদ্ধার করেছে।
পুলিশ সুপার বলেন, শাহজালাল হলের একটি কক্ষ থেকে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মওদুদীর বই পাওয়া গেছে। এই কক্ষটিতে ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা থাকতেন।
হাটহাজারী থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) সালাহউদ্দিন বলেন, শাহজালাল হলের ৩০৪ নম্বর কক্ষ থেকে একটি পিস্তল এবং অন্য কক্ষে আরও চারটি ম্যাগাজিন, দেড় শতাধিক রামদা ও ছোরা উদ্ধার করা হয়েছে। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শাহজালালে তল্লাশি চলে। সন্ধ্যায় শাহ আমানত হলে তিন বস্তা পাথর ও লাঠিসোঁটা পাওয়া গেছে।
সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের জরুরি সভায় ঘটনা তদন্তে ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক খান তৌহিদ ওসমানকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। কমিটির সদস্যসচিব করা হয়েছে সহকারী প্রক্টর অরূপ বড়ুয়াকে। অন্য তিন সদস্য হলেন এ এফ রহমান ছাত্রাবাসের প্রাধ্যক্ষ মঈনুল হাসান, সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন আবুল হোসাইন ও আবদুর রব ছাত্রাবাসের প্রাধ্যক্ষ রাশেদ উন নবী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ও দর্শন বিভাগের শিক্ষক মাছুম আহ্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় খোলা রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে বৈঠকে। তদন্ত কমিটিকে দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মদদে এ ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করেছেন সিএফসি ও ক্যাম্পাস ছাত্রলীগ পক্ষের নেতারা। বিকেলে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে তাঁরা উপাচার্য ও প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করেছেন। এ সময় বক্তব্য দেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সাহেদ সারোয়ার, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সভাপতি মামুনুল হক ও সহসভাপতি শাহাদাত হোসেন।
বিলুপ্ত কমিটির সহসভাপতি অমিত কুমার বসু বলেন, ‘ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রক্টর এবং তাঁদের পেটোয়া বাহিনী আমাদের দীর্ঘ দেড় বছর ক্যাম্পাসে যেতে দেয়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে আমরা ক্যাম্পাসে গেলেও তারা আমাদের বিভিন্নভাবে হুমকি দিয়ে আসছিল। সর্বশেষ তারা গুলি করে তাপসকে হত্যা করেছে।’
তবে উপাচার্য অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘নিজেরা মারামারি করে আমাদের কাঁধে দায় চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিরস্ত্র। ওরা অস্ত্র নিয়ে নামলে আমাদের কী করার আছে?’
কার গুলিতে খুন: প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ, সিএফসির নেতা-কর্মী ও শিক্ষার্থীরা জানান, ভিএক্স পক্ষের নেতা ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সদ্য বিলুপ্ত কমিটির সংস্কৃতিবিষয়ক উপসম্পাদক আশরাফুজ্জামান ওরফে আশাকে ঘটনার সময় পিস্তল দিয়ে গুলি ছুড়তে তাঁরা দেখেছেন। আশা শাহজালাল হলে থাকতেন। গত বছর তিনি উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছেন।
জেলা পুলিশ বলেন, ‘আশার গুলিতে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে শুনেছি। সে গা ঢাকা দিয়েছে। তাকে ধরতে অভিযান চলছে।’
‘সবশেষ’: তাপসের বড় ভাই আশীষ সরকার নেত্রকোনায় বিক্রয়কর্মীর কাজ করেন। তিনি জানান, শনিবার ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর শেষ কথা হয়। মুঠোফোনে তাপস তাঁকে বলেছিল, ‘বড়দা সামনের মাসে আমার পরীক্ষা। দুই হাজার টাকা লাগবে।’
আশীষ সরকার বলেন, ‘ভাইদের লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করার জন্য দিন-রাত পরিশ্রম করেছি। বাড়িতে মা-বাবা খেয়ে না-খেয়ে দিন কাটান। আজ আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে।’
প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন সুনামগঞ্জ অফিস ও কেন্দুয়া (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি

No comments

Powered by Blogger.