পাঁচ বছর ধরে উপেক্ষিত হাইকোর্টের রায়

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত অনেক কিছুই রয়েছে লোকচক্ষুর অগোচরে। দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে এসব স্মৃতিচিহ্ন। কিন্তু এসব স্মৃতি রক্ষায় সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। এসব স্মৃতিবিজড়িত স্থান রক্ষায় ২০০৯ সালে হাইকোর্টের হস্তক্ষেপও চাওয়া হয়। হাইকোর্ট স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহ চিহ্নিত করে তা সংরক্ষণের পক্ষে রায়ও দেন। কিন্তু রায় ঘোষণার পর পাঁচ বছরের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও ওই রায় বাস্তবায়নে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।
জানতে চাওয়া হলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নিয়েছি এক বছর হল। জেনেছি যে স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহ চিহ্নিত ও সংরক্ষণের জন্য একটি রায় আছে। সে জন্য উদ্যোগ নিয়েছি। সবগুলো কাজে হাত দিয়েছি। বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের কাজ দু-এক মাসের মধ্যেই শুরু হবে’।
মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। এ উদ্যানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ঐতিহাসিক বহু স্মৃতিবিজড়িত স্থান। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এ উদ্যানে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন। গণঅভ্যুত্থানের সময় ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ উদ্যানেই ভাষণ দিয়েছিলেন।
এ উদ্যানে দাঁড়িয়েই শপথগ্রহণ করেছিলেন ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ হতে জাতীয় ও প্রাদেশিক সংসদে নির্বাচিত সদস্যরা। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে পাকিস্তানি বাহিনীর এ উদ্যানে আত্মসমর্পণ, দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তান থেকে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এবং ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণ এ উদ্যানেই।
কিন্তু উদ্যানের কোন স্থানে এসব ভাষণ ও শপথগ্রহণ হয়েছিল তা আজও চিহ্নিত করা হয়নি। স্থাপন করা হয়নি কোনো স্মৃতিস্মারক বা ফলক। এর ফলে এসব ঐতিহাসিক স্থান সম্পর্কে নতুন প্রজন্ম জানতে পারে না। অবশেষে জনস্বার্থে বিষয়টি নিয়ে হাইকোর্টে রিট করা হয়। সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ঐতিহাসিক স্থাপনাসমূহ সংরক্ষণের দাবিতে সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল কেএম শফিউল্লাহ, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন এবং পরিবেশ ও মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ এ রিট করেন।
রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৯ সালের ৮ জুলাই হাইকোর্ট সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ওইসব স্মৃতিবিজড়িত স্থানসহ সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান, মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সদস্যদের সমাধিক্ষেত্র, বধ্যভূমি চিহ্নিত করার নির্দেশ দেন। এ আদেশ বাস্তবায়নের জন্য এক বা একাধিক কমিটি গঠনেরও নির্দেশ দেয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সৈনিকদের সমাধিগুলোকে মানসম্পন্ন ও বিবেচনাপ্রসূত ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ সমাধিক্ষেত্র নির্মাণ বা স্মৃতিফলক বা স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন ও সংরক্ষণ করতে রায়ের নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়। রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হতে বিদ্যমান সব ধরনের স্থাপনা অপসারণ পূর্বক কমিটি কর্তৃক চিহ্নিত স্থানগুলোতে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ও বিবেচনাপ্রসূত দৃষ্টিনন্দন ও ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ ও সংরক্ষণ করতে হবে। তবে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পূর্বের কোনো স্থাপনা এবং বিদ্যমান মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত স্মারক, ভাস্কর্য, স্মৃতিফলক বা স্তম্ভ এ আদেশের আওতার বাইরে থাকবে এবং এগুলো ব্যতীত অন্য সব স্থাপনা ব্যতিক্রমহীনভাবে অবিলম্বে অপসারণ করতে হবে। কমিটির চিহ্নিত বধ্যভূমিগুলোতে মানসম্পন্ন ও বিবেচনাপ্রসূত সমাধিক্ষেত্র নির্মাণ বা স্মৃতিফলক বা স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন ও সংরক্ষণ করতে হবে। ২০১০ সালের জুলাই মাসে এ রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি প্রকাশিত হয়।
কিন্তু ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তৈরি করা স্থাপনাসমূহ এখনও অপসারণ করা হয়নি। এছাড়া স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহ সংরক্ষণ তো দূরের কথা এখনও স্থানগুলো চিহ্নিতও করা হয়নি। মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সৈনিকদের সমাধিগুলোকে মানসম্পন্ন ও বিবেচনাপ্রসূত ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ সমাধিক্ষেত্র নির্মাণ করা হয়নি। রায়ের প্রায় সবগুলো নির্দেশনাই উপেক্ষিত রয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী বলেন, ‘রায়ের কপি এখনও দেখিনি। বুধবার মন্ত্রণালয়ে গিয়ে বিষয়টি দেখব। এছাড়া একাত্তরের পরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরে স্থাপিত শিশুপার্ক ও পুলিশ ফাঁড়িও অপসারণ করা হবে বলে মন্ত্রী জানান। তিনি বলেন, পুলিশ থাকবে, তবে তা থাকবে এ উদ্যানের নিরাপত্তার জন্য’।
জানতে চাওয়া হলে রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, বর্তমান সরকারকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার হিসেবে জাতি গণ্য করে। কিন্তু এ সরকারের আমলেও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার রায় উপেক্ষিত থাকছে। সরকার এ রায় বাস্তবায়নে আন্তরিক নয়। আমরা রায় বাস্তবায়নে প্রয়োজনে আদালত অবমাননার মামলা দায়েরের উদ্যোগ নেব।
হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ও বিচারপতি মো. মমতাজ উদ্দিন আহম্মেদের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চের দেয়া ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, বাদী-বিবাদীপক্ষের বক্তব্য শুনে দেখা যায় যে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতা পদক প্রদান করা হয়েছে। তিনি জাতির জনক। তার নামেই মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল। তার সরকারই এসব পদক প্রদান করেছে। এ পদক প্রদান করে তাকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। তিনি সব পদকের ঊর্ধ্বে। বরঞ্চ সব সেক্টর কমান্ডারের বীরত্বের পুরস্কার স্বরূপ স্বাধীনতা পদক প্রদান করতে আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
পর্যবেক্ষণে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ৯ মাসে বাংলাদেশে যে লাখ লাখ মানুষ শুধু বাঙালি হওয়ার কারণে চরম নির্যাতিত হয়েছে এবং প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে তাদের স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনপূর্বক বিজয় দিবসের প্রাক্কালে ১৫ ডিসেম্বর তারিখটি ‘জাতীয় শোক দিবস’ ঘোষণা করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো যাচ্ছে। এছাড়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের যে অংশে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যৌথ বাহিনীর নিকটে আত্মসমর্পণ করেছিল উদ্যানের সেই অংশটি ‘স্বাধীনতা উদ্যান’ নামকরণ করার জন্যও সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু রায়ের এসব পর্যবেক্ষণ এখনও বাস্তবায়ন হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.