ঢাকার সেই ছাত্রীকে খুঁজছে পুলিশ! শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা: দুই তদন্ত কমিটি by নুরুজ্জামান লাবু

রাজধানী ঢাকা ও বরিশালে নারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে এখনও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ঘটনা তদন্তে ঢাকায় দুই সদস্যের ও বরিশালে তিন সদস্যের পৃথক দু’টি তদন্ত কমিটি করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। রাজধানীর শাহবাগে এক পুলিশ কর্মকর্তা যে দুই ছাত্রীকে লাথি মেরেছেন ঢাকার তদন্ত কমিটির সদস্যরা তাদের খুঁজছে। একই সঙ্গে সংগ্রহ করা হচ্ছে সেই ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ও ছবি। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ কেন এত বেপরোয়া আচরণ করেছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আর বরিশালের তদন্ত কমিটির সদস্যরা ইতিমধ্যে ১৭ শিক্ষার্থীর জবানবন্দি নিয়েছেন। নেয়া হয়েছে প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যও। ভিডিও ফুটেজ ও ছবি দেখে চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে দায়ী পুলিশ সদস্যদের। ঢাকা ও বরিশালের তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা দায়ী পুলিশ সদস্যদের চিহ্নিত করে প্রতিবেদন জমা দেবেন। এরপর সার্ভিস রুল অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। সূত্র জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ চেয়ে বেশ কিছুদিন ধরে আন্দোলন করে আসছিল একদল শিক্ষার্থী। গত রোববার পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা সকাল ১১টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হয়। পরে তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে স্মারকলিপি দেয়ার জন্য রওনা হয়। শিক্ষার্থীদের র‌্যালি শাহবাগ থানার সামনে এলে তাদের আটকে দেয় পুলিশ। এ সময় শিক্ষার্থীদের পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল রওনা হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দিকে। বাকি শিক্ষার্থীরা থানার সামনের রাস্তা অবরোধ করে বসে থাকে। দুপুর ২টার দিকে পুলিশ তাদের অবরোধ তুলে নিতে বলে। কিন্তু আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিনিধি দল ফিরে না আসা পর্যন্ত রাস্তা ছাড়তে রাজি হয়নি। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের প্রথমে তর্কাতর্কি ও পরে ধস্তাধস্তি হয়। এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ওপর বেপরোয়া লাঠিচার্জ শুরু করে পুলিশ। ব্যবহার করা হয় জলকামান। এসময় শাহবাগ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হাবিল হোসেন দুই নারী শিক্ষার্থীকে পেছন থেকে লাথি মারেন। এই ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে নাগরিক সমাজ। বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও নারীবাদী সংগঠন পুলিশের এই আচরণের তীব্র প্রতিবাদ জানায়। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকেও এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এ অবস্থায় ঘটনার পরদিন সোমবার ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে ঘটনা খতিয়ে দেখতে দুই সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যরা হলেন- ডিএমপি’র রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) ইব্রাহীম ও সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) শিবলী নোমান। তাদেরকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তারা ওই ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ও ছবি সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। একই সঙ্গে খোঁজা হচ্ছে পুলিশ কর্মকর্তা হাবিল যে দুই নারী শিক্ষার্থীকে লাথি মেরেছেন তাদের। এছাড়া প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকেও ঘটনার বিবরণ শোনা হচ্ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, ঘটনাটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী দায়ী পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদিকে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ সূত্র জানায়, গত ৩রা নভেম্বর বরিশালের হেলথ টেকনোলজির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের যে সংঘর্ষ হয়েছে তা নিয়ে তদন্ত চলছে। ঘটনার পরদিনই বিএমপি’র উপ-কমিশনার (সদর দপ্তর) শোয়েব আহমেদকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন- ডিসি ট্রাফিক রায়হান ও এসি (সিএসবি) রুনা লায়লা। তিন কার্যদিবসের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন দিতে বলা হলেও তারা প্রতিবেদন জমাদানের জন্য আরো পাঁচ কার্যদিবস সময়ের আবেদন করেছেন। কমিটি সূত্র জানায়, তদন্ত কমিটির সদস্যরা ইতিমধ্যে ওই ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ও ছবি সংগ্রহ করেছেন। ছবিগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করছেন। ছবি দেখে তারা আন্দোলনরত ২৭ শিক্ষার্থীর জবানবন্দি নেয়ার জন্য ডাকেন। এর মধ্যে ১৭ জন শিক্ষার্থীর জবানবন্দি সংগ্রহ করেছেন। এছাড়া, প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। ঘটনার সময় দায়িত্বরত কোতোয়ালি থানার পুলিশ সদস্যদের ডেকেও কথা বলেছেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, সেদিনের বর্বরোচিত হামলার নেপথ্যে বরিশালের কোতোয়ালি থানার ওসি সাখাওয়াত ও এসআই মহিউদ্দিনের নাম উঠে এসেছে। তবে ঘটনার সময় বিএমপি’র অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) আতিকুর রহমান ও সহকারী কমিশনার (এসি) মাহমুদ উপস্থিত ছিলেন। সূত্র জানায়, পুলিশের লাঠিচার্জের নির্দেশনা ও অতিউৎসাহী হয়ে যারা লাঠিচার্জ ও নারী শিক্ষার্থীদের গায়ে হাত দিয়েছে তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। তদন্ত কমিটির প্রধান বিএমপি’র উপ-কমিশনার (সদর দপ্তর) শোয়েব আহমেদ বলেন, তদন্ত চলছে। তদন্তে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হবে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
উল্লেখ্য, সরকারি চাকরিতে ডিপ্লোমা মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট ও ফার্মাসিস্টদের দ্বিতীয় শ্রেণীর পদমর্যাদাসহ ১০ দফা দাবিতে বেশ কিছুদিন ধরে আন্দোলন করে আসছিল ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজির শিক্ষার্থীরা। গত ৩রা ডিসেম্বর পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী বরিশাল শহরের বান্দরোডে শিক্ষার্থীরা অবরোধ কর্মসূচি পালন করে। এসময় পুলিশ তাদের বাধা দিলে প্রথমে উভয়পক্ষের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হয়। পরে পুলিশ মারমুখো হয়ে বেধড়ক লাঠিচার্জ শুরু করে শিক্ষার্থীদের ওপর। এতে রেহাই পায়নি নারী শিক্ষার্থীরাও। লাঠিচার্জের কারণে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তাদের অনেকে। পুরুষ পুলিশ সদস্যরা অনেক নারী শিক্ষার্থীদের গায়েও হাত দেন। এ ঘটনায় বরিশালের সর্বমহল থেকে বিষয়টির সমালোচনা করা হয়। প্রতিবাদ করছে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও নারীবাদী সংগঠন।

No comments

Powered by Blogger.