এই দিনে-তারাকান্দর গণহত্যা ও জগদীশ by প্রশান্ত অধিকারী

গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার কান্দি ইউনিয়নের একটি গ্রাম তারাকান্দর। গ্রাম তো নয় বরং বলা যেতে পারে কোটালীপাড়ার বৃহত্তর বধ্যভূমি। অথচ স্বাধীনতার ৪১ বছর পরও এ গ্রামের গণহত্যার ইতিহাস কেউ জানে না। ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পায়নি সেসব ঘটনা।


এমনকি সেদিনের গণহত্যার একমাত্র সাক্ষী ও মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে বেঁচে থাকা যুদ্ধাহত জগদীশ বৈদ্য এখনো মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি।
১৯৭১ সালের মে মাস। বাংলা ১৯ জ্যৈষ্ঠ। দেশজুড়ে চলছে যুদ্ধের প্রস্তুতি। কান্দি ইউনিয়নের মানুষও বসে নেই। তাই পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি নেয় যুদ্ধের। দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তারা তারাকান্দর বালা বাড়িতে প্রতিরোধ শিবির গড়ে তোলে। স্থানীয় লোকের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থান থেকে আশ্রয় নিতে আসা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ওই বাড়িতে তাঁবু খাটিয়ে আশ্রয় নেয়। এ খবর যায় পার্শ্ববর্তী গোপালপুর পূর্ণবতী গ্রামের রাজাকার-আলবদরদের কাছে।এরপর তাঁরা কোটালীপাড়া থানা থেকে তিনটি গানবোটে ঘাঘর নদী দিয়ে ১১ জন পাকিস্তানি সেনা গোপালপুর আসে। সেখানে পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে অপেক্ষা করছিল স্থানীয় দোসর রাজাকার আহমদ চেয়ারম্যান, আফতাব উদ্দিন, বারেক মাস্টার, সোবহানসহ আরও অনেকে। তাদের ইশারায় পাকিস্তানি বাহিনী প্রস্তুতি নেয় তারাকান্দর আক্রমণের। একপর্যায়ে ভারী মেশিনগানের গুলি ও মর্টার শেল ছুড়তে থাকে তারাকান্দরের দিকে।
মাত্র এক কিলোমিটার ব্যবধানে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হাজার খানেব মানুষ পাকিস্তানি বাহিনীর ভারী অস্ত্রের সামনে আর টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হয়। অস্ত্রশস্ত্র রেখে পেছন দিকে যে যেভাবে পারে পালাতে থাকে। এই সুযোগে স্থানীয় রাজাকার, আলবদররা পাকিস্তানি বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকে পড়ে তারাকান্দর গ্রামে। প্রতিরোধকারী যোদ্ধাদের ফেলে আসা রাম দা, কুড়াল, কালি দিয়ে শতাধিক আবালবৃদ্ধবনিতাকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা। সকাল ১১টায় শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে হত্যাযজ্ঞ। শহীদ হন দুই শতাধিক নারী-পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধ। সেই নৃশংসতার নীরব সাক্ষী পুরো তারাকান্দর গ্রাম, বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ এবং সেই সময় মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা জগদীশ বৈদ্য।
তারাকান্দর গ্রামের নটোবর রায় জানান, ‘আমাদের বাড়ির সামনে পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে একটা ডোবার মধ্যে পালিয়েছিল নয়জন। তাদের কাউকে গুলি করে, কাউকে কুপিয়ে, চোখ তুলে নানাভাবে নির্যাতন করে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা। তাদের মধ্যে ডহরপাড়া গ্রামের নরেন দাঁড়িয়া [সমদ্দার], তাঁর স্ত্রী, মা এবং চিন্তা দাঁডিয়া ও তাঁর ছেলে ছিল।’ এ ছাড়া ছিল দরশন রায়, তাঁর স্ত্রী ও মেয়ে এবং মনমোহন রায়ের ছেলে হরলাল রায়। সেই ভয়াল দৃশ্যের কথা এখনো মনে পড়লে যেন আঁতকে ওঠেন তিনি।
জানা যায়, তারাকান্দর খালের পশ্চিম পাড়ে বিষ্ণু রায়ের স্ত্রীকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মৃত পাওয়া যায়। এভাবে তারাকান্দর বৈদ্যবাড়ি, রায়বাড়ি, বিশ্বাসবাড়ির দক্ষিণ পাশের মাঠে ও পুকুর পাড়ে সারি সারি লাশ দেখা যায়। যে শহীদদের লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয় তাদের মধ্যে রাধিকা বৈদ্য, বিশ্বনাথ বৈদ্যর স্ত্রী পরিষ্কার বৈদ্য এবং তাঁর দুই মেয়ে, পচু মণ্ডলের স্ত্রী, কুটিশ্বর মণ্ডল, লক্ষ্মণ বিশ্বাস, দীনেশ হালদার, পোকাই, কালু বালা, বিমল ঢালীর মা, মহেন্দ্র বৈদ্য, তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে এবং রাজেশ বাড়ৈর স্ত্রী। এ ছাড়া নাম না-জানা এলাকা ও এলাকার বাইরের বহু লোককে সেদিন এই তারাকান্দর বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। এর পাশাপাশি নারী নির্যাতন, লুটপাট ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা।
সেই যুদ্ধের একজন অকুতোভয় যোদ্ধা জগদীশ বৈদ্য। বয়স তাঁর ৭০ ছুঁই ছুঁই। শত্রুর তাড়া খেয়ে ওই দিন আশ্রয় নিয়েছিলেন একটা কচুরিপানাভর্তি ডোবার মধ্যে। তাঁর এক হাতে রাম দা, অন্য হাতে কালী(এক ধরণের দেশীয় অস্ত্র)। শত্রুরা তাঁর হাতের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে একই উপুর্যপরি কুপিয়ে চলে যায়। কিন্তু ৩৪টি কোপ খেয়েও বেঁচে আছেন জগদীশ বৈদ্য। জীবনের নিরাপত্তার জন্য পৈতৃক ভিটেমাটি ছেড়ে যশোরের বাসুন্দিয়া আশ্রয় নেন। সেখানে এখন দিনমজুরি করে সংসার চলে তাঁর।
স্বামী-স্ত্রী এবং ছয় মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। ইতিমধ্যে তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বাকি তিন মেয়ে স্থানীয় চাল-ডালের মিলে কাজ করে। এই তিন মেয়ের ওপর নির্ভর করে এখন তাঁর সংসার চলে। বয়সের কারণে তিনি এখন নিয়মিত কাজ করতে পারেন না। সেই ভয়াল অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়লে কুঁকড়ে ওঠেন। তাঁর চাওয়া, সরকার যেন তাঁকে মৃত্যুর আগে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
দেশ স্বাধীন হলো ৪১ বছর। অথচ আজ পর্যন্ত জগদীশ বৈদ্যরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাননি। এ লজ্জা কার? জগদীশ বৈদ্যর মতো সেই দিনের ওই শহীদদের কথা কেউ মনে রাখেনি। তাঁদের নাম ঠাঁই পায়নি ইতিহাসেও। এমনকি তারাকান্দর এই গণহত্যার কথা মানুষ জানেও না। আজ পর্যন্ত এ শহীদদের নামে কোনো স্মৃতিফলক নির্মিত হয়নি। এমনকি শহীদদের তালিকা প্রণয়ন ও তাঁদের স্মৃতি সংরক্ষণ করার ব্যাপারেও উদ্যোগ নেয়নি কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা স্থানীয় প্রশাসন। স্থানীয় মানুষের দাবি, এই শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে শহীদদের তালিকা খুঁজে বের করে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হোক।
প্রশান্ত অধিকারী
proadhikary@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.