স্মরণ-তাঁর স্মৃতিই এখন সবচেয়ে বড় সত্যি by সেলিনা আক্তার

দিনের পর দিন, তারপর মাস গড়িয়ে দশটি বছর পার হয়ে গেছে। আজ ১৬ জুলাই সাংবাদিক শামছুর রহমানের দশম মৃত্যুবার্ষিকী। এই দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে শামছুর রহমানের কর্মস্থল যশোরে তাঁর সহকর্মীরা, আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে স্মরণ করবে পরম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায়।


তিনি চিরদিনের জন্য চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে। প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ তিনি যেন আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছেন। আমি তাঁকে কোনোভাবেই ভুলতে পারি না। ভুলতে পারলে হয়তো কষ্টটা একটু কম হতো। কিন্তু শামছুর রহমান আমার কাছে এক অবিনশ্বর আত্মা। তাঁর স্মৃতিই এখন আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সত্যি। আরও সত্যি, আমাদের দুই কন্যা সেঁজুতি আর প্রণতি। ওদের মুখের দিকে তাকিয়েই আমার এ পার্থিব জগতে বেঁচে থাকা।
কলমযুদ্ধে লড়াইয়ের ময়দানে শত্রুদের হাতে শামছুর রহমান নিহত হওয়ার পর প্রতিবছর তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী এলেই আমাদের পরিবারের শুভাকাঙ্ক্ষীরা আমাকে পত্রিকায় লেখা দিতে বলেন। কিন্তু কী লিখব আমি? আমি কি এ কথাই বারবার লিখে যাব যে আমি আমার স্বামীর হত্যাকারীদের বিচার চাই; আর আমার কন্যারা তার পিতৃহন্তারকের বিচার চায়?
দৈনিক জনকণ্ঠ-এর বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে তিনি দীর্ঘদিন কাজ করেন। নির্ভীক সাংবাদিক শামছুর রহমান নিহত হওয়ার বিষয়টি তখন দেশ-বিদেশে অত্যন্ত আলোচিত ঘটনা ছিল। দেশ ও দেশের মানুষের জন্য কলমসৈনিক হিসেবে যুদ্ধ করেই তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেন। কিন্তু তাঁর বৃদ্ধা মা (আমার শাশুড়ি), স্ত্রী, সন্তান ও আত্মীয়স্বজনেরা কী পেয়েছেন?
১৯৯৯ সালে দৈনিক জনকণ্ঠ ভারতের জাতীয় নির্বাচন কাভার করার জন্য শামছুর রহমানকে সে দেশে পাঠায়। সেখানে টানা দুই মাস অবস্থান করে ভারতের নির্বাচনসংক্রান্ত যাবতীয় সংবাদ জনকণ্ঠ-এর হয়ে তিনি লিখেছেন। তাঁর সেসব প্রতিবেদন দেশের অনেকের কাছেই প্রশংসা কুড়িয়েছিল। ওই সময় আমার ছোট মেয়ে প্রণতির বয়স মাত্র এক বছর চার মাস। দীর্ঘদিন বাবাকে না দেখে চিনতে পারবে না, এমন আশঙ্কা করতেন শামছুর রহমান। ভারতে থাকতে তিনি প্রায়ই সেখান থেকে আমাকে ফোন করে খোঁজখবর নিতেন। ফোনে তাঁর প্রথম কথা থাকত, ‘প্রণতিকে প্রতিদিনই আমার ছবি দেখাবে। বলবে, এই তোমার বাবা। তাহলে ও আমাকে দেখলেই চিনতে পারবে।’ কিন্তু নিয়তির কী নির্মম পরিহাস, সেই প্রণতি তার ছবির বাবাকে দেখে, ছবির বাবার সঙ্গে একা একা কথা বলে বলে বড় হচ্ছে। এখন আমার প্রণতি পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। তার মনে নানা প্রশ্ন—সবার বাবা আছে, বাবারা তাদের আদর করেন, কিন্তু তার বাবা নেই কেন। সন্ত্রাসীরা তার বাবাকে কেন মেরে ফেলেছে। কী দোষ ছিল তার বাবার—এমন অনেক প্রশ্ন ছোট মেয়ে যখন আমাকে করে, তখন আমি এর কোনো জবাব দিতে পারি না।
একটা সময় ছিল, যখন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল অপরাধী চক্রের বিচরণক্ষেত্র হওয়ায় এখানে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাপন করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এমন একটি সন্ত্রাসকবলিত এলাকায় বসে শামছুর রহমান সাংবাদিকতা করেছেন। তাঁর প্রতিবেদনের প্রধান উপজীব্য ছিল সন্ত্রাস, চোরাচালান, নৈরাজ্য, অনাচার-অবিচারের মতো নানা বিষয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন অপরাধী চক্রের বিরুদ্ধে তিনি একের পর এক প্রতিবেদন লিখেছেন।
তিনি ছিলেন সত্যের পক্ষে, আলোর পক্ষে, শান্তির পক্ষে, দেশ ও জনগণের পক্ষে। তিনি বুঝেছিলেন, সাংবাদিক হিসেবে সত্যের পক্ষেই তাঁর অবস্থান নেওয়া উচিত। এ কর্তব্য পালন থেকে একদিনের জন্যও তিনি বিচ্যুত হননি। কোনো লোভ ও জাগতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। তাঁর নৈতিক দৃঢ়তার কারণে কায়েমি স্বার্থবাদীরা তাঁর কলমকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। সত্যের পক্ষে কঠোর অবস্থানের কারণে যে তার (প্রণতি) বাবাকে প্রাণ দিতে হয়েছিল, সে কথা আমার এই শিশুকন্যাকে কী করে বোঝাই? আমার এসব কথা তাঁরাই খুব সহজে অনুভব করবেন, যাঁরা অকালে বৈধব্যকে বরণ করে জীবন যাপন করেন। শামছুর রহমান যখন নিহত হন, তখন আমাদের বড় মেয়ে সেঁজুতি নবম শ্রেণীতে পড়ে। ওর বাবার কথা বেশ মনে আছে। সেঁজুতি তাঁর আদর-ভালোবাসা প্রণতির তুলনায় বেশ খানিকটা পেয়েছে। ওর স্মৃতিতে বাবা ও তাঁর আদর্শ অনেকটা স্থানজুড়ে উজ্জ্বল হয়ে আছে। সেঁজুতি এইচএসসি পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়। এর পর বছর না ঘুরতেই বাবার পেশা ও আদর্শ তাকে এতটাই নাড়া দেয় যে সেঁজুতি তার বিষয় বদল করে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে আবার ভর্তি হয়।
আমি আমার দুই সন্তানকে এই বলে সান্ত্বনা দিই, তোমাদের বাবা বীরের মতো কলমযুদ্ধে লড়াইয়ের ময়দানে শত্রুদের হাতে নিহত হয়েছেন। এ রকম মহান মৃত্যু খুব কম মানুষের হয়। তোমরা আজীবন এ জন্য গর্ববোধ করতে পারবে। আমরা তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।
লেখক: শামছুর রহমানের সহধর্মিণী।

No comments

Powered by Blogger.