গদ্যকার্টুন-গল্প নয়, সত্যি ঘটনা by আনিসুল হক

গদ্যকার্টুনে সাধারণত আমি কৌতুক পরিবেশন করে থাকি। এই কৌতুকগুলো সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত নয়, নিতান্তই হাস্যকৌতুক, পুরোপুরিই কাল্পনিক। কিন্তু আজ যে গল্পগুলো বলব, সেসব সত্য বলে প্রচারিত।
প্রথম ঘটনাটি ঘটেছে আমেরিকাতে।
লিওলা নামের একজন ভদ্রমহিলা। তিনি তাঁর নিজের বাড়িতে সুখেই ছিলেন। কিন্তু তাঁর সুখের ঘরে দুখের আগুন জ্বালাল একটা টেলিফোন। তাঁর বাড়ির পাশে একটা মোটেল চালু হলো। সেই মোটেলের টেলিফোন নম্বর আর তাঁর বাড়ির টেলিফোন নম্বর প্রায় একই রকম। একটা ডিজিট এদিক-ওদিক। এর ফলে তাঁর বাসার ফোনটা সারাক্ষণই বাজতে থাকে। হ্যালো, এটা কি প্লাজা মোটেল?
জি না, রং নম্বর।
একটু পরে আবার ফোন। হ্যালো, প্লাজা মোটেল?
না, রং নম্বর।
কত আর ফোন ধরা যায় আর বলা যায় রং নম্বর। লিওলা টেলিফোন কোম্পানিতে অভিযোগ করলেন। টেলিফোন কোম্পানি বিষয়টাকে হেসেই উড়িয়ে দিল।
নম্বর তো আলাদা। মোটেলের সঙ্গে মিলে গেলে আমরা কী করব?
সত্যি হয়তো তাদের কিছু করার ছিল না। এবার লিওলা গেলেন মোটেল কর্তৃপক্ষের কাছে। আপনারা কি কাইন্ডলি আপনাদের টেলিফোন নম্বরটা পাল্টাবেন।
মোটেল কর্তৃপক্ষও লিওলার অভিযোগ কানে তুলল না।
উপয়ান্তর না দেখে লিওলা নিজের সমস্যার সমাধানে নিজেই এগিয়ে এলেন।
তার কাছে ফোন এল, হ্যালো, প্লাজা মোটেল।
জি বলছি।
আপনাদের ডাবল রুম ডিলাক্স ফাঁকা আছে।
জি আছে। কয়টা রুম লাগবে?
আমরা অমুক কলেজ থেকে আসছি। হকি টিম। সাতটা রুম দরকার।
কবে আসছেন।
এই তো ৭ তারিখ থেকে ১০ তারিখ।
ঠিক আছে আমি বুকিং দিয়ে দিচ্ছি।
কত টাকা অ্যাডভান্স পে করতে হবে?
আপাতত লাগবে না। আমি আপনার কথাতেই আস্থা রাখছি। আমরা প্লাজা কর্তৃপক্ষ ক্রেতাদের বিশ্বাস করি।
একটু পরে আবার ফোন। হ্যালো, প্লাজা মোটেল?
জি বলছি।
আমরা মেয়ের বিয়ের জন্য হলরুম খুঁজছি।
কতজনের অনুষ্ঠান করবেন। কবে?
এই তো ২০০ জনকে আপ্যায়ন করব।
কবে করবেন বলুন। কী কী লাগবে।
মেয়ের জন্য যা যা লাগবে, সবকিছুর অর্ডার শুনে নিয়ে একেবারে কনফার্ম করে দিলেন লিওলা।
হ্যালো... আবার ফোন। আমরা বলছি কুস্তিগীর ফেডারেশন থেকে। আমাদের ১০ জন কুস্তিগীর থাকবেন আপনার মোটেলে।
লিওলা কোনো রকম অগ্রিম ছাড়াই তাদেরও রুম বুকিং দিয়ে দিলেন। একটার পর একটা রুম, হল, লবি তিনি বুকিং দিয়েই চলেছেন।
তার পর থেকে ওই মোটেলে যা সব কাণ্ড ঘটতে লাগল, তা সহজেই অনুমেয়। হকিস্টিকওয়ালারা, কুস্তিগীরেরা, বিয়ের দাওয়াতিরা এসে ভিড় জমাতে লাগল মোটেলে।
ছয় মাস পর ফোন এল একটা বড় হোটেল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। হ্যালো, প্লাজা মোটেল?
লিওলা বললেন, জি বলছি। বলুন কী করতে পারি।
আপনাদের মোটেলটা তো দেউলে হয়ে গেছে। ওটা আমরা কিনে নিতে চাই। বিক্রি করবেন?
বিক্রি করতে পারি, একটা শর্তে। যদি আপনারা এই প্লাজা মোটেলের টেলিফোন নম্বরটা বদলাবেন, এই বিষয়ে আগেভাগেই আমাদের কথা দেন।
আরেকটা সত্য ঘটনা বলি।
একটা শেয়াল মধ্য যুগোস্লাভিয়ার ৩৮ বছর বয়স্ক এক শিকারিকে গুলি করে হত্যা করেছে। এপি পরিবেশিত এই খবরের সূত্র ছিল যুগোস্লাভ বার্তা সংস্থা তানযুগ।
বসনিয়া-হার্জেগোভিনার গোরনজে রাসনো গ্রামের সালিহ হাজদুর নামের একজন কৃষক রোববার শিকারে গিয়েছিলেন।
সালিহ একটা শেয়ালকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে গুলি শেয়ালের পায়ে লাগে। শেয়ালটা আহত হয়ে লুটিয়ে পড়ে। এই কৃষক শেয়ালের চামড়াটা রক্ষা করার ইচ্ছে থেকে আর গুলি না ছুড়ে রাইফেলের বাঁট দিয়ে শেয়ালটাকে আঘাত করতে থাকেন।
শেয়ালটাও পা দিয়ে রাইফেলটা জড়িয়ে ধরে। তার ট্রিগারে পা লেগে গুলি বেরিয়ে গেলে সেটা ওই শিকারি কৃষকের বুকে বিদ্ধ হয়। কৃষক ঘটনাস্থলেই মারা যান। শেয়ালটাও পরে মারা গেছে, তানযুগ জানায়।
এই ঘটনাটা কোন রোববারে ঘটেছে, ইন্টারনেটের সাইটে সেটা খুঁজে পেলাম না। কিন্তু তারা ঘটনাটাকে সত্য এবং এপি পরিবেশিত খবর বলেই দাবি করছে।
বাংলাদেশে সম্প্রতি একটা ঘটনা ঘটেছে।
বিশ্বকাপে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করা, পতাকা ওড়ানো, পতাকা সরানো ইত্যাদি নিয়ে ঝগড়াঝাঁটির একপর্যায়ে এক ব্রাজিল-সমর্থক এক আর্জেন্টিনা-সমর্থককে ছুরি মেরেছেন এই বাংলাদেশে। আর্জেন্টিনা-সমর্থকটি মারা গেছেন।
স্টালিনের পুত্র জ্যাকব কেন মারা গিয়েছিলেন জানেন? আমার কলামে মিলান কুন্ডেরার বই থেকে আমি বার তিনেক ঘটনাটা লিখেছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জ্যাকব ছিলেন মিত্রবাহিনীতে। তিনি টয়লেটে গিয়ে দেখেন, টয়লেট নোংরা। তিনি তাঁর অফিসারকে অভিযোগ করেন, আমি স্টালিনের ছেলে, এই নোংরা টয়লেটে বর্জ্য ত্যাগ করতে পারব না। অফিসার তাঁকে বলেন, নিজেই পরিষ্কার করে নাও। জ্যাকব সেটা করতে অস্বীকৃতি জানান। অফিসার তাঁকে শাস্তি দেন। রাগে-দুঃখে জ্যাকব ঝাঁপিয়ে পড়েন কাঁটাতারের বেড়ায়। সেটা ছিল বিদ্যুতায়িত। জ্যাকব মারা যান। লেখক মিলান কুন্ডেরা বলেছেন, জ্যাকব মারা গেছেন গুয়ের জন্য। হি ডায়েড ফর শিট।
আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের জন্য যাঁরা মারা যাচ্ছেন আর মারামারি করছেন, তাঁরা তাঁর থেকে ভালো কোনো কারণে মারা যাচ্ছেন, সেটা আমি খুব বড় মুখ করে বলতে পারব না।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.