কালের পুরাণ-এই লেখা শুধুই পুলিশকে নিয়ে by সোহরাব হাসান

কয়েক দিন আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত দুর্নীতিকে বাংলাদেশের ১ নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে বলেছিলেন, ‘সবখানে দুর্নীতি ছেয়ে গেছে।’ আর এই দুর্নীতির শীর্ষে যে পুলিশ বাহিনী, সে কথাটিও বলতে ভুলে যাননি এই প্রবীণ আমলা-রাজনীতিক।


তিনি বলেছেন, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা থেকে শুরু করে প্রতিটি পুলিশ সদস্যই ঘুষ খান। সরকারের মেয়াদের সাড়ে তিন বছরের মাথায় অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্য তাঁর সহকর্মীদের স্বভাবতই মনঃপূত হয়নি। তাঁর অনুপস্থিতিতে মন্ত্রিসভার বৈঠকে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের ‘মৃদু’ সমালোচনা হয়েছে বলে পত্রিকায় দেখেছি। কিন্তু স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর মতো কেউ পুলিশের পক্ষে সাফাই গাননি। পুলিশ যে দুর্নীতির শীর্ষে, সেই কথাটি পুলিশের জুনিয়র মন্ত্রী স্বীকার করতে চান না।
কিন্তু এই মুহূর্তে পুলিশের দুর্নীতির চেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে তার অন্যান্য বেআইনি কর্মকাণ্ড। পুলিশ আজ দুষ্টের নয়, শিষ্টের দমনে উঠেপড়ে লেগেছে। পদে পদে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। পুলিশ সদস্যদের হাতে লাঞ্ছিত হচ্ছেন নারী, সাংবাদিক, আইনজীবীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। অথচ তারা অপরাধীদের ধরতে পারে না। পুলিশের হাতে প্রথম আলোর তিন সাংবাদিক নিগৃহীত হওয়ার পর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু পুলিশ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে পেশাগত দায়িত্ব পালনের পরামর্শ দিয়েছেন। অনেক দিন আগে হইতে সাবধান নামে একটি নাটক দেখেছিলাম। যার মূল কথা ছিল—দুর্নীতি হইতে সাবধান, চুরি-ডাকাতি হইতে সাবধান, অন্যায়-অসততা হইতে সাবধান। এবার যুক্ত হলো পুলিশ হইতে সাবধান। পুলিশ হইতে যদি সাধারণ মানুষ বা সাংবাদিক শতহস্ত দূরেই থাকবেন, তাহলে সেই পুলিশের কী প্রয়োজন আছে?

২.
২০০১ সালের ২৭ মে বিবিসি ঢাকার একটি পত্রিকার বরাত দিয়ে বলেছিল, বাংলাদেশের পুলিশের প্রতি পাঁচজনের মধ্যে চারজন দুর্নীতিগ্রস্ত। সে সময় পুলিশ বাহিনীর সদস্যসংখ্যা ছিল এক লাখ। তাঁদের মধ্যে ৮৫ হাজারই ছিলেন দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত। বিবিসির ভাষ্য অনুযায়ী, দুর্নীতির অভিযোগে ১২ হাজার সদস্য চাকরিচ্যুত হয়েছেন বা বাধ্যতামূলক অবসর নিয়েছেন। বাকি সদস্যদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল।
সে সময় আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ছিল। মাঝখানে বিএনপি ও বিতর্কিত তত্ত্বাবধায়ক পর্ব পার হয়ে ফের আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দাবি, এই ১১ বছরে পুলিশ বাহিনীতে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি, বরং অবনতি ঘটেছে। বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন দাবি করেছেন, ‘গত সাড়ে তিন বছরে যখনই যেই পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে, তদন্ত করা হয়েছে, ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? কোনো অঘটন বা অপরাধের সঙ্গে কোনো পুলিশ সদস্য জড়িয়ে পড়লে তাঁকে প্রত্যাহার বা সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এটাই হলো বিভাগীয় ব্যবস্থা। এরপর তদন্তের নামে সেই ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হয়। এভাবেই বিভাগীয় ব্যবস্থা চলে আসছে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আমলের মধ্যে কেনো পার্থক্য নেই।
একজন সাধারণ নাগরিক আইন ভঙ্গ করলে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়া হলে পুলিশের বিরুদ্ধে নেওয়া হবে না কেন? সম্প্রতি চট্টগ্রামে একটি মাজারে অর্থ আত্মসাতের দায়ে র‌্যাবের একজন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ ক্লাবে নিয়ে নারীর শ্লীলতাহানি ও চেইন ছিনিয়ে নেওয়া এর চেয়েও গুরুতর অপরাধ। তাহলে কেন অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা বা সদস্যদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মামলা হবে না? পুলিশ বাহিনীতে ন্যূনতম শৃঙ্খলা ও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রতিটি অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত এবং শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

৩.
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের কাছে সাংসদ হোসেন মকবুল শাহরিয়ারের প্রশ্ন ছিল, গত এক বছরে দেশে কতগুলো গুপ্তহত্যা ও অপহরণের ঘটনা ঘটেছে? জবাবে মন্ত্রী বলেছেন, গত এক বছরে অপহরণের ঘটনায় ৬৩৩টি মামলা হয়েছে। তিনি পুলিশের ভূমিকার প্রশংসা করে বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি নিখোঁজ, অপহরণ বা খুন বা লাশ উদ্ধার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিষয়টি জিডিভুক্ত করে এবং প্রচলিত আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ২০১১ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দক্ষতা ও সফলতার সঙ্গে ৪৯৬ জনকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে।’ গুপ্তহত্যা সম্পর্কে মন্ত্রী কিছু বলেননি। (প্রথম আলো, ১ জুন, ২০১২)
অন্য যেকোনো সভায় বা অনুষ্ঠানে মন্ত্রীরা প্রশ্নকর্তার প্রশ্নের জবাব না-ও দিতে পারেন। দিতে বাধ্য নন। কিন্তু জাতীয় সংসদে প্রশ্নের জবাব এড়ানোর সুযোগ নেই। মন্ত্রী বলতে পারেন, নোটিশ প্রয়োজন। অর্থাৎ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য তিনি সময় নিতে পারেন। কিন্তু কোনোভাবেই উত্তর এড়িয়ে যেতে পারেন না। সংসদই হলো মন্ত্রী তথা সরকারের জবাবদিহি করার উপযুক্ত জায়গা।
মন্ত্রী কেন গুপ্তহত্যার বিষয়টি এড়িয়ে গেলেন? দেশে গত এক বছরে কি গুপ্তহত্যার কোনো ঘটনা ঘটেনি? না ঘটলে তিনি বলবেন, দেশে গুপ্তহত্যা হয়নি। দেশবাসী হয় মন্ত্রীর কথায় আশ্বস্ত হবেন, অন্যথায় তাদের হাতে তথ্য-প্রমাণ থাকলে চ্যালেঞ্জ করবেন। এই চ্যালেঞ্জের কাজটি যেহেতু সাংবাদিকেরা করেন, সেহেতু তাঁদের ওপরই পুলিশের যত আক্রোশ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দক্ষতা ও সফলতার সঙ্গে ৪৯৬ জনকে উদ্ধার করেছে। ৬৩৩টি অপহরণের ঘটনা ঘটে থাকলে বাকি ১৩৭ জনের ভাগ্যে কী ঘটেছে? তাঁরা কি সবাই নিখোঁজ রয়েছেন না গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন—সেই জবাব জানার অধিকার জনগণের আছে।
আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী যখন পুলিশ সদস্যদের পক্ষে বিরামহীন সাফাই গাইছেন, তখন আমরা তাঁদের কী সাফল্য ও দক্ষতার নিদর্শন দেখতে পাই? আমরা নিরীহ মানুষ পেটাতে তাঁদের সাফল্য দেখতে পাই। আমরা রাজনৈতিক দলের কর্মীর গলা টিপে ধরতে তাঁদের সাফল্য দেখতে পাই। আমরা প্রতিপক্ষের হাতে ব্যবসায়ীকে তুলে দিয়ে তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করায় পুলিশের সাফল্য দেখতে পাই। কিন্তু সাফল্য দেখতে পাই না সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্তে। সাফল্য দেখতে পাই না ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার রহস্য উদ্ঘাটনে, সাফল্য দেখতে পাই না চট্টগ্রামে হিমাদ্রীর হত্যাকারীদের পাকড়াও করতে। আমরা পুলিশের সাফল্য দেখতে পাই না যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত মাওলানা আবুল কালাম আজাদের গ্রেপ্তার অভিযানে। পুলিশের সহায়তা ছাড়া তাঁরা পালিয়ে যেতে পারতেন না।
শুক্রবার সকালে রিপোর্টার্স ইউনিটির মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘দেশে এক লাখ ৪০ হাজার পুলিশ সদস্য রয়েছে। এর মধ্যে সব পুলিশ যে ভালো হবে, এমন কোনো কথা নেই। কিছু খারাপ পুলিশও রয়েছে। এরপর তিনি গত সাড়ে তিন বছরে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে, তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন। কেন ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়া হয় না জানতে চাইলে মন্ত্রী নিয়মকানুনের দোহাই দেন। সব পুলিশ ভালো হবে এ কথা আমরাও বলছি না। কিন্তু পুলিশ বিভাগে থেকে যাঁরা বেআইনি কাজ করেছেন, করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে, সেটাই আমরা জানতে চাই।
আগেও দেখেছি, এখনো দেখছি, যখনই পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়, তখনই তাঁদের রক্ষায় নানা রকম তৎপরতা চলে। এটাই পুলিশ বিভাগের প্রধান ব্যাধি। এই ব্যাধি সারাতে হলে আগে নিয়ত ঠিক করুন। পুলিশকে দলীয় কাজে ব্যবহার বন্ধ করুন। একজন পুলিশ সদস্য অন্যায় করে পার পেলে অন্যরাও অন্যায় করতে উৎসাহিত হন। আর দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার বা সাময়িক বরখাস্ত কোনো শাস্তিই নয়। সাময়িক বরখাস্ত হলে ওই পুলিশ সদস্য আর্থিকভাবে যতটুকুই ক্ষতিগ্রস্ত হন, তা পরে সুদাসলে উঠিয়ে নেন।

৪.
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুব উল আলম হানিফ সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশের সাংবাদিক পেটানোর ঘটনার পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র আছে বলে দাবি করেছেন। প্রথম আলোর তিন সাংবাদিককে পেটানোর ঘটনায় তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, কতিপয় পুলিশকে দিয়ে গোটা পুলিশ বাহিনীর মুখে কালিমা লেপন কোনো গভীর ষড়যন্ত্রেরই অংশ।
কিন্তু ষড়যন্ত্রটি কারা করছে, তাদের পেছনে কারা আছে, তা বের করার দায়িত্ব কি সরকারের নয়? যে সরকার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে বাসে আগুন দেওয়া কিংবা সচিবালয়ে ককটেল নিক্ষেপের দায়ে ৩৩ জন বিরোধী দলের নেতাকে পাকড়াও করতে পারে, সেই সরকার এই ছোট্ট ষড়যন্ত্রটি বের করতে পারবে না? একই সঙ্গে মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন, বর্তমান সরকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। সেই সঙ্গে তিনি যখন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, ‘বিএনপি আমলে সাংবাদিকদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন হলেও তখন টিভি টক শোতে কেউ কথা বলেননি’, তখন মনে মনে প্রমাদ গুনি তাঁর আশ্বাসের পেছনে কি প্রচ্ছন্ন হুমকিও আছে কি না। কোন আমলে টিভি টক শোতে সরকারের সমালোচনা হয়েছে, কোন আমলে হয়নি তার সঙ্গে পুলিশের সাংবাদিক পেটানোর সম্পর্ক কী? ক্ষমতাসীন দলের যুগ্ম সম্পাদক মহোদয় এর মাধ্যমে কী বার্তা দিতে চান?
পুলিশ যখন সাংবাদিকদের রাস্তায় ফেলে পেটায়, বিরোধী দলের কর্মীদের গলা চেপে ধরে, তখন আমাদের মনে হয়, আমরা এখনো সভ্য হতে পারিনি।
লেখাটি শেষ করতে চাই টোকিও থেকে পাঠানো বাংলাদেশি নাগরিক মাকসুদুল আলমের ই-মেইলে পাঠানো একটি চিঠি দিয়ে। ওই চিঠিতে তিনি পুলিশ নিয়ে একটি লেখার অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘জনগণের আয়কর থেকে যাদের বেতন হয়, পুলিশ নামের সেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের এমন অমানবিক, অনৈতিক, হিংস্র আচরণের দায়িত্ব এড়াতে পারে না সরকার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে পুলিশ আর কত খেলা দেখাবে? পদোন্নতির জন্য পুলিশ বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে পিটিয়ে খোঁড়া করে, সাধারণ মানুষের গলা টিপে ধরে, মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠায়, প্রাথমিক শিক্ষকদের পেটায়, গরম পানি ঢেলে দেয়, ফটোসাংবাদিক ও প্রদায়ককে নির্মমভাবে নির্যাতন করে, দিনদুপুরে আদালত চত্বরের পাশে তরুণীর গলায়-গালে চুমু খায়, শ্লীলতাহানির প্রতিবাদ করায় আইনজীবীকে মারধর করে। তাহলে দুধ-কলা দিয়ে আমরা কী পুষছি? পুলিশের কাজ কি মানুষ পেটানো, নারীর শ্লীলতাহানি?
এ প্রশ্ন কেবল একা মাকসুদুল আলমের নয়। দেশের মানুষেরও। সবশেষে সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, কোহিনূররা যেমন বিএনপি-জামায়াত সরকারকে রক্ষা করতে পারেননি, তেমনি শহীদুলেরাও এই সরকারকে রক্ষা করতে পারবেন না। অতএব পুলিশ নয়, জনগণের ওপর ভরসা রাখুন।
 সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.