বাংলাদেশে দুই নেত্রীর মেগালোম্যানিয়া by এম আবদুল হাফিজ

খালেদা জিয়ার বিদ্যা-বুদ্ধির পরিমাণ নিয়ে এখন আর কেউ প্রশ্ন তোলে না। তোলা সমীচীনও নয়। যিনি একাধিকবার দেশের প্রধানমন্ত্রিত্বের মুকুট পরিধান করেছেন, তার ওই পদ অলঙ্কৃত করার যোগ্যতা সম্পর্কে কোনো বিতর্ক হাস্যকর। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে 'দুই নেত্রীর দ্বন্দ্ব' শিরোনামে যুক্তরাজ্যের দ্য ইকোনমিস্ট নেত্রীদ্বয়ের


তুলনামূলক গুণাগুণ ও বৈশিষ্ট্যের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। স্মৃতি থেকে উদৃব্দত করছি, তাই অবিকল শব্দ চয়নে কিছু ভ্রান্তি থাকলেও থাকতে পারে। দ্য ইকোনমিস্ট লিখেছিল :কযধষবফধ তরধ যধং রসঢ়ৎবংংরাব সধহবৎরংস যিরষব যবৎ ৎরাধষ ঝযবরশয ঐধংরহধ রং সড়ৎব বফঁপধঃবফ ধহফ ষড়াবং ঢ়ড়ষরঃরপধষ ফবনধঃব.
কিন্তু খালেদা জিয়ার ম্যানারিজম বা শেখ হাসিনার বিতর্কপ্রীতি এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। তাদের উভয়ের মধ্যে যে একটি অভিন্ন বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান, তার ওপর কিঞ্চিৎ আলোকপাতই এখানে উদ্দেশ্য। ক্ষমতায় এলেই তাদের মধ্যে যে মারাত্মক মেগালোম্যানিয়ার প্রকাশ ঘটে, সেটাই দেশের রাজনীতিকে অস্থির, অশান্ত ও টালমাটাল করে তোলে। উভয়েরই বিশ্বাস, তারা জনপ্রিয়তা, জনসমর্থন এবং দেশ শাসনের নিখুঁত কারিগর হিসেবে অনেক শক্তির অধিকারী; যদিও বাস্তবে তা দৃশ্যমান নয়। তাদের এ বিশ্বাসই সমঝোতার সব দুয়ার বন্ধ করে দেয়। উস্কে দেয় এক ভয়াবহ সাংঘর্ষিক রাজনীতির। যে অবস্থার কবলে দেশ আজ নিপতিত। অথচ উভয়েরই দুঃশাসন ও ব্যর্থতা দেশবাসীর অজ্ঞাত নয়। জনগণ হাড়ে হাড়ে জানে, দুই নেত্রীকে পর্যায়ক্রমে ক্ষমতাসীন করে কী পরিমাণ খেসারত তাদের দিতে হয়েছে! কিন্তু মেগালোম্যানিয়ায় আক্রান্ত নেত্রীদ্বয়ের এ দেশের ক্ষমতার মসনদে আরোহণ তাদের বিকৃত ধারণায় তাদেরই প্রাপ্য। জনগণ তাদের নেত্রীকে তার প্রাপ্য আসনে ভোটের মাধ্যমে পেঁৗছে দিয়ে শুধু তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। এ ধারণায় তাদের ক্ষমতাসীন নেত্রীদ্বয়ের কাজ এখন শুধু তাদের প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা, যার জন্য তাদের নিজ মেধা ও যোগ্যতাই যথেষ্ট। নিজেদের বড় এবং শক্তিশালী ভাবার এ বাতিক বাংলাদেশে রাজনীতির সব অনর্থের মূল। এ বাতিক যে কাউকে রাজনীতিসহ ক্ষমতার যে কোনো লড়াইয়ে বাতিকগ্রস্তকে বেপরোয়া করে তোলে এবং তার বা তাদের মাত্রাজ্ঞান লোপ পায়_ এতে কোনো সন্দেহ নেই। অনেককে অপ্রিয় লাগলেও এমনই এক মাত্রাজ্ঞানহীন রাজনৈতিক সংঘর্ষ এ দেশকে আর্থ-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিয়েছে, যার পরিণতি ভয়াবহ। যেভাবেই হোক, এ প্রবণতাকে ঠেকাতে না পারলে সর্বনাশা সংঘাত দেশের সব সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করবে। এ জন্য দেশের বিজ্ঞজনকে দলবিশেষের জন্য পক্ষপাতকে পরিহার করে দক্ষ রেফারির ভূমিকায় অনতিবিলম্বে নামতে হবে।
খালেদা জিয়া তার বিগত শাসনামলে এমন বাতিকের বশবর্তী হয়ে প্রতিপক্ষের সঙ্গে তুচ্ছাতিতুচ্ছ আচরণ করেছিলেন এবং তা রাজনৈতিক উত্তাপকে শুধু বাড়িয়েছিল। অনেক ফন্দি-ফিকির করেও তিনি বা তার জোট ক্ষমতায় থাকতে পারেনি; না ক্ষমতার প্রলম্বন ঘটাতে পেরেছিলেন। ক্ষমতা প্রলম্বিত করতে একই প্রকার মানসিক বিকারে ভুগছেন এখনকার প্রধানমন্ত্রী। বেগম জিয়ার মতো তিনিও প্রতিপক্ষকে তীব্র-তীক্ষষ্ট কটাক্ষবাণে ঘায়েল করছেন এবং ভাবছেন যে, তার চাতুর্য কেউ বোঝে না। তিনি হয়তো ভাবেন_ তিনি অতি কৌশলী, জনপ্রিয় এবং শক্তিশালী। ক্ষমতার অন্তিম সময়ে এসে সবাই এমন ভাবেন। কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রেই বাস্তবতা একই রকম_ শেষ পর্যন্ত তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে তাদের স্বপ্ন, সাধ এবং কল্পনাবিলাস। এ ছাড়া দুই নেত্রীর ক্ষেত্রেই রয়েছে আরেক মারাত্মক উপসর্গ_ নারী নেতৃত্বের জেদ ও একগুঁয়েমি।
যে কোনো দেশে, যে কোনো সময়ে ব্যর্থ সরকারগুলোর জন্য যখন পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যেতে থাকে, তাদের আচরণ ও প্রতিক্রিয়া হয় অভিন্ন। তারা সবকিছুর মধ্যে ষড়যন্ত্র দেখতে পায়, যার ওপর ভিত্তি করে তাদের দমন নীতিগুলো প্রয়োগ হতে থাকে। এ ছাড়া এমন সরকারগুলো শুধু নিজেদের ছাড়া আর কাউকে দেশপ্রেমিক ভাবতে পারে না। হঠাৎ তারা উচ্চকণ্ঠ হয়ে পড়ে এবং হুমকি-ধমকি ও শাসনের আশ্রয় নেয়। এ ছাড়াও পুলিশ-র‌্যাবের ওপর সরকারের নির্ভরতা বেড়ে যায়। তারাও কিছু প্রাপ্তির আশায় কারণে-অকারণে নিরীহ সাংবাদিক, এমনকি আদালতে বিচারপ্রার্থীদেরও পেটাতে শুরু করে।
আদালত প্রাঙ্গণের পুলিশ ক্লাবে এক নারী বিচারপ্রার্থীর শ্লীলতাহানির মতো কেলেঙ্কারি হয়। তার ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। একটি সমর্থনহীন সরকার শুধু পুলিশের এবং স্তাবকদের ওপর নির্ভর করে টিকতে পারে না; ফন্দি-ফিকিরের মাধ্যমে প্রলম্বিতও হতে পারে না। কিন্তু মেগালোম্যানিয়া তো একটি মানসিক ব্যাধি। মানসিক বিকার ইত্যাদি প্রচণ্ড ধাক্কায়ই দূর হয়। যেমন ২০০৭ সালে জোট সরকারের অনেক দেরিতে হলেও হুঁশ হয়েছিল। কেউ কখনও সীমাহীন শক্তির অধিকারী হতে পারে না, যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারে না। কোনো না কোনো সময় তাদের যুক্তির কাছে, ন্যায়ের কাছে অবনত মস্তক হতেই হয়। সমসাময়িক ইতিহাস তার প্রমাণ। গাদ্দাফি অনেক অস্ত্রবল, প্রাণ বাজি রাখা সমর্থক এবং কূটকৌশল দিয়েও শেষ রক্ষা পাননি। তাই নমনীয়তার ভেতর দিয়ে এবং যুক্তির পথ ধরে এগোলে রাজনীতির দুই পক্ষই মুখোমুখি সংলাপে জটিল সমস্যার জট খুলতে পারেন। সেটিই হবে নেত্রীদ্বয়ের বিকারমুক্ত চিন্তার পরিচায়ক।

ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল
হাফিজ :সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক
 

No comments

Powered by Blogger.