শিক্ষানীতি ২০১০-কর্মমুখী ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা বাস্তবায়ন কৌশল by ছিদ্দিকুর রহমান

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদন লাভ করেছে। সঠিক ও বাস্তবসম্মত নীতি প্রণয়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ নীতি বাস্তবায়ন। নীতি বাস্তবায়নে কত সময় লাগবে, কত টাকার প্রয়োজন হবে, কত মেধা ও শ্রম দিতে হবে—এ সবকিছুই নির্ভর করে নীতি বাস্তবায়নকৌশলের ওপর।


কৌশল সঠিক হলে কম খরচে ও কম সময়ে বড় কিছু অর্জনও সম্ভব। শিক্ষানীতি ২০১০ বাস্তবায়নের ওপর ধারাবাহিকভাবে লিখতে হলে প্রথমেই আরম্ভ করতে হয় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে। যেহেতু এখন জাতীয়ভাবে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা সপ্তাহ ২০১০ পালিত হচ্ছে, তাই বৃত্তিমূলক শিক্ষা দিয়েই শুরু করা হলো।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ ৫+ বছর বয়সের সব শিশুর জন্য এক বছর মেয়াদি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা এবং ৬+ থেকে ১৩+ বছর বয়সের সবার জন্য আট বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তনের নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা হবে সর্বজনীন, অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক। প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিটি শিশুর মৌলিক শিখন-চাহিদা নিশ্চিত করবে, এ শিক্ষা থেকে শিশুরা একদিকে যেমন সুদৃঢ় ব্যবহারিক সাক্ষরতা অর্জন করবে, অন্যদিকে তেমনি জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় জীবন-দক্ষতা অর্জন করবে। অনেকের জন্য এ শিক্ষা হবে প্রান্তিক, আবার অনেকে এ শিক্ষা শেষে মাধ্যমিক শিক্ষায় প্রবেশ করবে।
আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা কর্মবিমুখ। অভিভাবকেরা সন্তানদের পড়ায় ভালো চাকরিলাভের আশায়। কেউ কেউ পড়ায় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা জজ-ব্যারিস্টার বানানোর জন্য। ছেলেমেয়েরাও পড়ে একই লক্ষ্যে। দক্ষ শ্রমিক বা কারিগর হওয়ার লক্ষ্য থাকে না বললেই চলে। অথচ একটি জাতির টিকে থাকা ও অগ্রগতির জন্য যেমন প্রয়োজন অনেক সুশিক্ষিত দক্ষ শ্রমিক, কর্মকার, কৃষক, কর্মচারী, তেমনি প্রয়োজন নির্ধারিতসংখ্যক সুশিক্ষিত শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, কর্মকর্তা। এর জন্য প্রয়োজন মৌলিক শিক্ষা পর্যায়ে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। শিক্ষা সবাইকে কর্মমুখী করবে। শ্রমমূলক কাজের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি এবং শ্রম ও শ্রমিককে যথাযথ মর্যাদা দিতে শেখাবে।
শিক্ষানীতি ২০১০ বাস্তবায়নের জন্য প্রাথমিক শিক্ষার (১ম থেকে ৮ম শ্রেণী) জন্য নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করতে হবে। উচ্চ-প্রাথমিক স্তরে (৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণী) অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে প্রাক-বৃত্তিমূলক শিক্ষা হিসেবে কর্মমুখী শিক্ষা বাধ্যতামূলক থাকবে। কর্মমুখী শিক্ষার জন্য কোনো পাঠ্যপুস্তক থাকবে না, কিন্তু শিক্ষক সহায়িকা ও শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে। প্রতি শ্রেণীতে সপ্তাহে কমপক্ষে এক দিন রুটিনে শেষ দুই পিরিয়ড কর্মমুখী শিক্ষার জন্য বরাদ্দ থাকবে। একেক শ্রেণীর শিক্ষার্থীদেরকে ১৫ থেকে ২০ জনের দলে ভাগ করে একেক দলকে একেকজন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে শ্রমমূলক কাজে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করানো হবে। শিক্ষার্থীরা গ্রামের রাস্তাঘাট মেরামত করবে; স্কুল, রাস্তাঘাট, ড্রেন, পুকুর পরিষ্কার করবে, গ্রামের বিভিন্ন বৃত্তির লোকজনের কাজে সহায়তা করবে। যেমন, কৃষকের সঙ্গে কৃষিজমি নিড়াবে, কামারের সঙ্গে মাটি মন্থন করবে, সুতারের সঙ্গে র্যাঁদা ঠেলবে। এর জন্য আলাদা কোনো ওয়ার্কশপ লাগবে না, যে গ্রামে যেসব কাজের সুযোগ আছে ওই কাজ করবে। একই কাজ বারবার করবে না। বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণ করবে। কারণ এ শিক্ষার উদ্দেশ্য কোনো নির্দিষ্ট বৃত্তি বা কাজের জন্য তৈরি করা নয়, কায়িক শ্রমের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি ও দৃষ্টিভঙ্গি গঠন করা।
আট বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষা সবার জন্য বাধ্যতামূলক। তাই সবাইকে তিন বছর (৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণী) বাধ্যতামূলকভাবে কর্মমুখী শিক্ষা নিতে হবে। এর জন্য এসবিএ-র (বিদ্যালয়ভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি) অধীনে ধারাবাহিক মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকবে। ৮ম শ্রেণী শেষে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার নম্বর ফর্দে কর্মমুখী শিক্ষার ধারাবাহিক মূল্যায়নের গড় নম্বর উল্লেখ থাকবে।
সন্তোষজনকভাবে আট বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে কেউ কেউ মাধ্যমিক শিক্ষায় যাবে, আবার কেউ কেউ বৃত্তিমূলক শিক্ষায় যাবে। বৃত্তিমূলক শিক্ষায় অর্জিত দক্ষতা উৎপাদনমূলক কাজে লাগিয়ে আয়রোজগার করবে। কেউ কেউ বৃত্তিমূলক শিক্ষা শেষে এবং কেউ কেউ মাধ্যমিক শিক্ষার দুই বছর শেষে উচ্চতর দক্ষতার বৃত্তিমূলক শিক্ষা নেবে। উচ্চতর দক্ষতার বৃত্তিমূলক শিক্ষা শেষে অনেকে কর্মজীবনে যাবে। আবার কেউ কেউ কারিগরি শিক্ষায় যাবে। চার বছরের মাধ্যমিক শিক্ষা শেষেও কারিগরি শিক্ষায় যাবে।
বৃত্তিমূলক শিক্ষার সুযোগলাভের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। যেমন, সরকারি উদ্যোগে প্রতি উপজেলায় একাধিক বৃত্তিমূলক শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করা, বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরকে শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপনে উদ্বুদ্ধ করা এবং সহযোগিতা প্রদান, প্রতি জেলায় আবাসিক সুবিধাসহ কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন ইত্যাদি সরকারের পিপিপি পলিসির আওতায় বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
কোথায় কী ধরনের বৃত্তিমূলক শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করা হবে এ বিষয়ে সতর্ক পদক্ষেপ নিতে হবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ, কাঁচামাল প্রাপ্তি, বাজারজাতকরণের সুযোগ ইত্যাদি বিবেচনায় রেখে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন বৃত্তিমূলক কার্যক্রম (ট্রেড কোর্স) চালু করা, বিভিন্ন কলকারখানার ভবিষ্যৎ শ্রমশক্তির চাহিদা নিরূপণ করার জন্য গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা এবং কলকারখানার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করে চাহিদানুসারে বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রদান এবং শিক্ষা শেষে কর্মে নিয়োগদান, বিদেশে দক্ষ শ্রমশক্তির চাহিদা নিরূপণের জন্য গবেষণা পরিচালনা, তা ছাড়া দেশে স্বকর্মসংস্থানের সুযোগ চিহ্নিত করার জন্য গবেষণা পরিচালনা এবং সে অনুসারে বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রদান ইত্যাদি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ক্ষেত্রবিশেষে বিদেশি ভাষা (যেমন ইংরেজি, আরবি, কোরিয়ান ইত্যাদি) শিক্ষা বৃত্তিমূলক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
স্বকর্মসংস্থানের সুযোগভিত্তিক বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রদান এবং সন্তোষজনকভাবে শিক্ষা কার্যক্রম শেষ করার পর ব্যাংক থেকে কম সুদে ক্ষুদ্রঋণপ্রাপ্তির সুযোগ থাকা প্রয়োজন। প্রতি উপজেলায় একটি করে পরিবীক্ষণ সেল থাকবে, ব্যাংকসমূহের যৌথ অর্থায়নে ওই সেল পরিচালিত হবে। এর প্রধান কাজ হবে ঋণগ্রহীতারা ঋণের টাকা নির্ধারিত খাতে বিনিয়োগ করছে কি না তা তদারক করা এবং ঋণের টাকা যথাযথভাবে বিনিয়োগ করে কার্য পরিচালনায় উৎসাহ ও সহযোগিতা প্রদান করা।
সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হলে সবার জন্য সুশিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। আর দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য প্রয়োজন বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণ। বর্তমান সরকারের ঘোষিত নীতি অনুযায়ী, প্রত্যেক পরিবারের জন্য কমপক্ষে একজনের কর্মসংস্থান করতে হলে স্বকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এ ছাড়া অদক্ষ বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে কর্মমুখী শিক্ষাসহ প্রাথমিক শিক্ষা শেষে বৃত্তিমূলক শিক্ষা গ্রহণ করে ব্যাংক থেকে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে করা স্বকর্মসংস্থান দারিদ্র্য ও সন্ত্রাসমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে পৌঁছাতে মুখ্য ভূমিকা রাখবে।
ড. ছিদ্দিকুর রহমান: অধ্যাপক, আইইআর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; সদস্য, জাতীয় শিক্ষানীতি কমিটি ২০০৯।

No comments

Powered by Blogger.