গদ্যকার্টুন-পল আর উৎপল অক্টোপাস by আনিসুল হক

জার্মানির চ্যান্সেলরের নাম আমি জানি না, কিন্তু সে দেশের একটা অক্টোপাসের নাম আমার জানা। পল নামের এই আটপেয়ে সামুদ্রিক প্রাণীটি এরই মধ্যে সারা পৃথিবীতে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে ফুটবলের ফল আগাম বলে দিয়ে। জার্মানির ওবারহাউজেন নামের জায়গায় একটা সামুদ্রিক প্রাণীকেন্দ্রে এই অক্টোপাস মহাসুখে দিনাতিপাত করছে।


জার্মানি ফুটবল দলের খেলার আগে তার অ্যাকুরিয়ামে দুটো খাবারভর্তি বাক্স রাখা হয়। দুটো বাক্সে থাকে প্রতিদ্বন্দ্বী দুটো দেশের পতাকা। অক্টোপাসটা যে বাক্সে যায়, সেই দল জিতবে বলে ঘোষণা করা হয়। উইকিপিডিয়া থেকে পাওয়া তথ্যমতে, এবার বিশ্বকাপে জার্মানির সব খেলার ফল এই অক্টোপাস নির্ভুলভাবে আগাম বলে দিতে পেরেছে। এমনকি সার্বিয়ার সঙ্গে জার্মানি হেরে যাবে, এটাও পল নামের এই কদাকার প্রাণীটি আগেভাগে বলে দিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। স্পেনের সঙ্গে সেমিফাইনালের আগেও তার ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, জার্মানি হারতে যাচ্ছে। তা-ই ঘটেছে। এখন পর্যন্ত ১২টা খেলার পূর্বাভাস দিয়েছিল পল, যার ১১টাই মিলে গেছে। আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা জার্মানির কাছে তাদের দলের পরাজয়ের পর ঘোষণা করেছিল, ওই অক্টোপাসটিকে তারা পুড়িয়ে কাবাব বানিয়ে খাবে; স্পেনের কাছে জার্মানির পরাজয়ের পর জার্মানির সমর্থকেরাও অক্টোপাসের রেসিপি নিয়ে নানা ঘোষণা দিচ্ছে; আর অক্টোপাসের মতে সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন যে স্পেন, তার সমর্থকেরা তাদের দেশের রেস্তোরাঁয় অক্টোপাস পরিবেশন না করার আহ্বান জানিয়েছে।
ব্যাপারটা যে কাকতালীয়, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। এটার মাধ্যমে যে অপবিজ্ঞান ছড়ানো হচ্ছে, এ ব্যাপারেও আমরা নিশ্চিত। আমাদের টিয়াপাখির কোনো একটার নাম লিয়া, নিনা যা হোক, একটা কিছু রেখে আমরা সামনের বিশ্বকাপে এই বাণিজ্যে নামব, শুধু ফলগুলো ঠিকঠাকভাবে মিলে গেলেই হয়।
কিন্তু পল দ্য অক্টোপাসের পাশে আরেক অক্টোপাস বাংলাদেশে নীরবে নিভৃতে নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন এবং সেগুলো বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক প্রথম আলোয় আগেভাগেই ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়েছে। এই অক্টোপাসটির নাম উৎপল অক্টোপাস। তবে তিনি উৎপল শুভ্র নামে মনুষ্যসমাজে সমধিক পরিচিত।
উৎপল শুভ্র ২০০৬ বিশ্বকাপের প্রাক্কালে প্রথম আলোর ক্রোড়পত্রে লিখেছিলেন, ‘ব্রাজিল না হলে কে? ইতালি?’। ব্রাজিল হয়নি, আপনারা জানেন, ইতালি চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। আর এবার, ১১ জুন ২০১০ সালে উৎপল দি অক্টোপাস প্রথম আলোর বিশ্বকাপ ক্রোড়পত্রে ‘আনন্দযজ্ঞে সবার নিমন্ত্রণ’ শীর্ষক রচনায় লিখে রেখেছেন:
‘ভবিষ্যদ্বাণী করব না, সে তো আগেই বলেছি। কিন্তু চাওয়াটা তো বলতেই পারি। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা আবেগে আক্রান্ত দেশে কথাটা বেসুরো শোনাবে জানি। তবে কল্পচোখে স্বপ্নের যে ফাইনালটা দেখি, সেটির সুরমাধুর্যে মন ভরিয়ে দেওয়ার গ্যারান্টি দিতেও রাজি।...শুধু মন বলছে, আহা, ফাইনালটা যদি স্পেন-হল্যান্ড হতো!’
উৎপল দ্য শুভ্র এই অভিলাষ লিখিতভাবে ব্যক্ত করেছেন, আর তা কি পূর্ণ না হয়ে পারে! ফাইনালটা, আমরা জানি, স্পেন-হল্যান্ডই হচ্ছে।
অভিনন্দন উৎপল শুভ্র। কারণ পল দি অক্টোপাসের ভবিষ্যদ্বাণী স্রেফ কাকতালীয় এবং সেটা বিশ্বাস করা নিতান্তই অপবিজ্ঞানের শিকারে পরিণত হওয়া, কিন্তু শুভ্ররটা নির্বোধ অক্টোপাসের অন্ধ বাছাই নয়। তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীটা খেলা, খেলোয়াড়, পরিবেশ-পরিস্থিতি আর হূদয়ের সংবেদনশীলতা দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ সাপেক্ষে ঘোষিত একটা রায়। এ ক্ষেত্রে তাঁরটা মিলে গেছে বলে বিস্ময়মিশ্রিত অভিবাদনটা উৎপল শুভ্রর পাওনা।
এদিকে উৎপল শুভ্রর সহকর্মীরা দাবি করছেন, খেলার আগের দিন অনেকগুলো খেলার ফল তিনি ঘোষণা করেছেন, যেসব মিলে গেছে। যেমন: ব্রাজিল-চিলি খেলার ফল হবে ৩-০। এরপর ব্রাজিল কোয়ার্টার ফাইনালেই বিদায় নেবে। এটার গৌরব আমরা শুভ্রকে দেব না। কারণ এটাকে বলা হয়, ঝড়ে বক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে। জার্মানির কাছে আর্জেন্টিনা ৪ গোল খাবে, এটা গায়ক আসিফ খেলার আগেই আমাদের প্রকাশ্যে বলে দিয়েছিলেন। এসব ক্ষেত্রে মিলে গেলেই আমরা মাথা বের করি, না মিললে মাথাটা গর্তে লুকোই। এসব কোনো প্রণিধানযোগ্য ব্যাপারই নয়।
কিন্তু উৎপল শুভ্রর গ্যারান্টির বিষয়ে কথা বলার আছে। তিনি গ্যারান্টি দিয়েছেন, ফাইনাল খেলাটা যদি স্পেন আর হল্যান্ডের হয়, তাহলে তা সুরমাধুর্যে আমাদের মন ভরিয়ে দেবে। আমরা সেই সুর আর মাধুর্যের আশায় মন খালি করতে শুরু করেছি। তা যদি না হয়, তাহলে কী হবে?
আমার নিজের ধারণা, খেলাটা অত সুন্দর হবে না। একে তো ফাইনাল, তার ওপর হল্যান্ড ঠিক জুত করতে দেবে না স্পেনকে। দেখা যাক! আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণে আমাদের শ্বাস ফেলার সময় যদি না থাকে, তাহলেই না খেলা খেলা! সেটা কি পাব আমরা এই ফাইনালে!
আচ্ছা ভাই উৎপল দি অক্টোপাস, ফাইনালে কে জিতবে? আমি কায়মনোবাক্যে চাই স্পেন জিতুক, কিন্তু জিতবে তো আসলে হল্যান্ড। আপনি কী বলেন?
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.