কাশ্মীর-বিক্ষোভের আগুন সরকারই জ্বালিয়েছে by মুজামিল জামিল

কাশ্মীর উপত্যকার চলতি গোলযোগটি কি বিচ্ছিন্নতাবাদী ও বিরোধীদের পরিকল্পিত সৃষ্টি, নাকি সরকারি ব্যবস্থার ব্যর্থতা? ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কি পূর্বাপর না ভেবেই এর পেছনে কারও হাত থাকার সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে? জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্য সরকারও কি কেন্দ্রের নিঃশর্ত মদদে তাদের ব্যর্থতা ঢাকার মওকা পাচ্ছে?


ধারাবাহিকভাবে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর দিকে তাকালেই এসব প্রশ্নের যৌক্তিক ব্যাখ্যা মিলবে। গত মে মাসের ৩০ তারিখে ফাঁস হয় যে, মাছিল নামের এক যুবককে ভুয়া এনকাউন্টারে হত্যা করা হয়েছে। পরের ঘটনাটি জুলাই মাসের ১১ তারিখের। ১৭ বছর বয়সী ছাত্র তোফায়েল আহমেদ মাট্টু সেদিন টিউশনি সেরে বাড়ি ফিরছিল। দিনটি ছিল শুক্রবার এবং পুলিশ সেসময় তাদের দিকে পাথর ছুড়ে পালানো একদল যুবককে ধাওয়া করছিল। আর মাট্টু একা দাঁড়িয়ে ছিল একটি ফুটবল স্টেডিয়ামের ভেতরের মাঠে। সেই অবস্থায় পুলিশ খুব কাছ থেকে তাকে গুলি করে। তার মাথায় আধা ইঞ্চি ছিদ্র হয়ে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গেই সে মারা যায়। ঘটনা জানাজানি হলে গোটা শহর থমকে যায় বেদনায়। পুলিশ যথারীতি শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে নেমে পড়ে। প্রথমে তারা দাবি করে যে মাট্টুর মৃত্যু হয়েছে মাথায় ধারালো পাথরের আঘাতে। এর কয়েক ঘণ্টা পর তারা একে ‘পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’ বলে প্রচার করে এবং মাট্টুকে হাসপাতালে নিয়ে আসা দুই ব্যক্তিকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য সবার সাহায্য চায়। কিন্তু যারা মাট্টুকে হত্যা করার দৃশ্য দেখেছে তারা এগিয়ে এসে সত্য ফাঁস করে দেয়। অবশেষে জনগণের ক্ষোভের মুখে পুলিশ হত্যাকাণ্ডের দায়দায়িত্ব স্বীকার করে। এদিকে স্বাধীনতাকামীরাও রাজপথে জনগণের সঙ্গে সামিল হয় এবং ক্ষোভকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
ঘটনা সেখানেই শেষ নয়। মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ’র তরফে তদন্ত করে এ ঘটনার শাস্তির প্রুতিশ্রুতির পরও নিরাপত্তা বাহিনী সিআরপিএফ রফিক আহমেদ বাংরু (২২) নামের আরেক যুবককে মর্মান্তিকভাবে পেটায়। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে আট দিন থাকার পর বাংরু মারা যান। জুনের ২০ তারিখে তাঁর জানাজা শেষে ফেরার পথে শোকতপ্ত জনতার কয়েকজন সিআরপিএফের যে ক্যাম্পে বাংরুকে পেটানো হয়েছিল, সেখানে পাথর ছোড়ে। জবাবে সিআরপিএফ জওয়ানেরা গুলি করে এবং মারা যান বাংরুর ২০ বছর বয়সী চাচাতো ভাই জাভেদ আহমেদ মাল্লা। মুখ্যমন্ত্রী তখন গুলমার্গে ছুটি কাটাচ্ছেন। সেখান থেকে তড়িঘড়ি করে ফিরে শ্রীনগরের এসএসপিকে বদলি করে আবার সেই ছবির মতো সুন্দর অবকাশযাপন কেন্দ্রে পরিবারের কাছে ফিরে গেলেন। এসব হত্যাকাণ্ডের পর সরকারের তরফে কোনো অনুতাপের চিহ্ন না দেখে মানুষ আরও খেপে গেল।
জুনের ২৫ তারিখে সিপিআরএফ অন্য ঘটনায় নিহত দুই সশস্ত্র যোদ্ধার লাশ ফেরত চাইতে আসা জনতার ওপর আবারও গুলি করে শান্তি নষ্ট করে। অভিযোগ রয়েছে, নিহত দুজনের একজন কোনো কিছুতেই জড়িত ছিল না। প্রতিবাদ বিক্ষোভ বাড়তেই থাকে এবং সরকার বারবারই শক্তি প্রয়োগের পথে যায়। স্বাধীনতাকামীরা মিছিল ডাকে এবং ২৯ জুন সেই মিছিলে সিপিআরএফ আবারও গুলি করে। এতে তেজামুল বশীর নামের ১৭ বছরের এক তরুণ নিহত হয়। কয়েক ঘণ্টা পরে নয় বছর বয়সী এক বালক তার অসুস্থ ভাইকে খুঁজতে বাড়ির বাইরে বেরিয়েছিল। তার ওপরও গুলি হয় এবং সে মারা যায়। পরের দিন মুখ্যমন্ত্রী গণমাধ্যমের সামনে আসার সিদ্ধান্ত নেন। সেদিনও পুলিশ আরও তিন কিশোরকে হত্যা করে। পুলিশ তাদের বাড়ির ভেতর ঢুকে বুকে ও মাথায় গুলি করে।
কেন্দ্রীয় সরকারের নিঃশর্ত সমর্থন নিয়ে রাজ্য সরকার প্রচার করা শুরু করে যে ‘জাতীয় স্বার্থবিরোধী’ ব্যক্তিরাই এই সংকটের জন্য দায়ী এবং বিক্ষোভকারীদের নাকি ভাড়া করে আনা হয়েছে। আবদুল্লাহ বলেন, যে কোনো মৃত্যুর জন্য বিক্ষোভকারীরাই দায়ী, কারণ কেন তারা কারফিউর মধ্যে রাস্তায় বের হয়? তিনি ভাবলেন না, তাঁর এই ইঙ্গিত পুলিশের কাছে হত্যার ছাড়পত্র হিসেবে গণ্য হবে। জুলাইয়ের ৬ তারিখে পুলিশ পাথর ছুড়তে থাকা একদল বালককে ধাওয়া করার সময় মুজাফফর আহমদ ভাট নামের ১৭ বছর বয়সী এক ছাত্রকে ধরে তার মাথায় রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করে। পুলিশ প্রথমে ভাটকে আটক করার কথা অস্বীকার করে। পরদিন সকালে কাছের একটি খালে তার লাশ পাওয়া যায়। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, মৃত্যু হয়েছে ‘মাথায় ভোঁতা অস্ত্রের আঘাতে’। তার জানাজা মিছিলেও সিআরপিএফ গুলি করে ফায়াজ আহমেদ (৩৫) নামের এক যুবককে হত্যা করে। আহমদের স্ত্রী ও দুটি কন্যাশিশু রয়েছে। এই করুণ মৃত্যুতে কাশ্মীরজুড়ে আবারও বিক্ষোভের ঢল নামে। কয়েক ঘণ্টা পর ২৫ বছর বয়সী এক নারী ঘরের জানালা খোলা মাত্র গুলিবিদ্ধ হন এবং মারা যান।
এভাবে ১৫ জন নিরীহ মানুষের মৃত্যুতে সারা শ্রীনগর উত্তাল হয়ে ওঠে এবং কার্যত প্রায় প্রত্যেকেই রাস্তায় নেমে আজাদীর দাবি তুলতে থাকে। মসজিদের মাইক থেকে বাজানো হয় স্বাধীনতার গান। এতে করে আবদুল্লাহ আরও ভীত হলেন এবং কাশ্মীরের রাজধানীকে তুলে দিলেন সেনাবাহিনীর হাতে। এ ঘটনা নজিরবিহীন। এমনকি চরম সশস্ত্র সংঘাতের দিনগুলোতেও কখনো সেনাবাহিনীকে ডাকা হয়নি। আবদুল্লাহর নির্দেশে দিল্লির মদদে ৪০ হাজার পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর সদস্যরা শ্রীনগরের ১৩ লাখ অধিবাসীকে কার্যত যার যার ঘরের মধ্যে বন্দী করে ফেলে। বন্ধ করে দেওয়া হয় সব হাসপাতাল ও সংবাদপত্র।
সুতরাং এটা স্পষ্ট যে বিরোধী দল ও স্বাধীনতাকামীরা পরিস্থিতির সুযোগ নিলেও তারাই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, এটা বলা মিথ্যাচার। এই অসত্য বলে সরকার তার ব্যর্থতা ঢাকতে চাইছে। এসব মৃত্যু এড়াতে সরকার কিছুই করেনি এবং এর প্রতিক্রিয়া সামাল দেওয়ার চেষ্টাও তাদের ছিল না। বিচ্ছিন্নতাবাদীরাই যদি প্রতিবাদের হোতা হতো, তাহলে কীভাবে সেনাবাহিনীর মিথ্যা এনকাউন্টারের প্রতিবাদে সারা কাশ্মীর অসন্তোষে জ্বলে উঠল? যে আগুন জ্বলেছে, তার জন্ম সরকারেরই হাতে।
ওমর আবদুল্লাহ নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী। কেন তাঁর সরকার সরাসরি জনগণের সঙ্গে যোগাযোগে ব্যর্থ হচ্ছে? কেন তাঁদের কোনো রাজনৈতিক উদ্যোগ নেই? নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই বা কোথায়? ‘ষড়যন্ত্রকারীদের’ থেকে তাঁদেরই তো জনগণের সঙ্গে বেশি যোগাযোগ থাকার কথা? আবদুল্লাহ এখন মূলধারার সব রাজনৈতিক দল নিয়ে সম্মেলনে বসার চিন্তা করছেন, কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে।
কাশ্মীরের সাম্প্রতিক প্রতিবাদ-বিক্ষোভ প্রমাণ করে, শাসক মহল কিছুই মনে রাখে না। কাশ্মীর সমস্যাকে রাজনৈতিকভাবে তুলে ধরতে তারা ব্যর্থ। আবারও দেখা যাবে, পরিস্থিতি শান্ত হলে রাজনৈতিক সমাধানের সুযোগকে হিমঘরে তুলে রাখা হবে। পরিস্থিতি থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখা মানে সমস্যা আরও বাড়তে দেওয়া। সরকার যতই জনগণকে ভাঁওতা দিতে চাইবে, ততই জনগণ আরও বেশি করে ‘আজাদী’র জমিনে সমবেত হবে।

ভারতের দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ
মুজামিল জামিল: ভারতের দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার কাশ্মীর ব্যুরোপ্রধান।

No comments

Powered by Blogger.