এখনই উচিত নির্বাহী আদেশ জারি করা-ফতোয়াবিরোধী আদেশ

একটি গণতান্ত্রিক ও আধুনিক সমাজে যা সাধারণ জ্ঞান ও বোধের বিষয়, বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে তা আইন করে পালন করাতে হয়। তাও সব সময় সুফল দেয় না। ফতোয়াবাজির মতো কাজ দেশে চলছেই। আর এটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারী-নিগ্রহের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। প্রচলিত আইনেই এসব দণ্ডনীয়।


হাইকোর্ট দ্বিতীয়বারের মতো এ বিষয়ে একটি আদেশ দিয়েছেন। বর্তমান সরকার বিষয়টিকে দুইভাবে কাজে লাগাতে পারে। প্রথমত, হাইকোর্টের দুটো রায়ের আলোকে অবিলম্বে একটি নির্বাহী আদেশ জারি করা এবং দেশের সব থানা ও ইউনিয়ন পরিষদে তা পৌঁছে দেওয়া। পাশাপাশি গণমাধ্যমে তা প্রচার করে এ ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করা। এবং এ বিষয়ক প্রশাসনিক নজরদারি অব্যাহত রাখা। দ্বিতীয়ত, জাতীয় সংসদে আলাপ-আলোচনা করে প্রচলিত আইন শুধরে প্রয়োজনে ফতোয়াবাজির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায় ও সাজা নির্দিষ্ট করে দেওয়া।
বিচারবহির্ভূত যেকোনো শাস্তি অবৈধ বলেই গণ্য হওয়ার কথা। এটা ঠিক যে সমাজে সালিস-দরবারের রেওয়াজ চলে আসছে। এটা অনেক সময় ইতিবাচক ফলও দিচ্ছে। সমাজে এর বাস্তব চাহিদা থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু ফতোয়াবাজি আলাদা বিষয়। ফতোয়াকে যে অর্থে ব্যবহার করা হয়, তা কখনো অজ্ঞতা, কখনো তা স্রেফ ধর্মের অপব্যবহার। ইসলামি আইন ও শরিয়া সম্পর্কে যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি অর্জন করা-সম্পন্ন ব্যক্তিরা ফতোয়াবাজির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হন না। দোররা মারা বা পাথর ছোড়ার মতো যেসব ঘটনা ঘটছে, তা ফতোয়াবাজি। সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদ বলেছে, ‘কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না কিংবা কারও সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করা যাবে না।’ এর অর্থ হলো, এ ধরনের ব্যবস্থাসংবলিত কোনো আইন তৈরির ক্ষমতা সংসদও রাখে না। অথচ ফতোয়াবাজির মাধ্যমে প্রায় সব ক্ষেত্রেই ‘লাঞ্ছনাকর’ দণ্ড দেওয়া হয়।
বাংলাদেশে ফতোয়াবাজির মাধ্যমে যেসব কর্মকাণ্ড চলছে, তা প্রচলিত আইনেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অথচ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ফতোয়াবাজি প্রতিরোধে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করার বিষয়ে উদাসীন। সরকারগুলো আন্তরিক থাকলে এ বিষয়ে অনেক আগেই উপযুক্ত নির্বাহী আদেশ কিংবা সংসদের মাধ্যমে উপযুক্ত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব ছিল। এ রকম প্রেক্ষাপটে নয় বছর আগে ফতোয়াবিরোধী একটি আলোচিত রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্ট বিভাগ। ফতোয়া-ব্যাধি দূর করতে সংসদের উচিত ছিল অনেক আগেই এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। এখন সাংসদেরা সেটা নেবে, সেই আশা আমরা করব।
নয় বছর আগের রায় আপিল বিভাগে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় পড়ে আছে। অথচ রাষ্ট্রপক্ষ এটি সুরাহা করতে কখনোই আগ্রহ দেখায়নি। গত ৮ জুলাই হাইকোর্ট বিভাগের একটি দ্বৈত বেঞ্চ প্রচলিত আইনে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। ফতোয়া-সম্পৃক্ত ব্যক্তিদেরও অপরাধের সহযোগী হিসেবে একই ধরনের শাস্তির ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। হাইকোর্টের সর্বশেষ রায় নারীর অধিকার ও সম্মান রক্ষায় সহায়ক হবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। ফতোয়ার নামে নারীর অধিকার হরণ, শারীরিক নির্যাতন ও অপমানের পথ রুদ্ধ হোক।

No comments

Powered by Blogger.