বাঘা তেঁতুল-আরও একটি অক্টোপাস চাই by সৈয়দ আবুল মকসুদ

জগতে যা ঘটার তা ঘটবে। তবু মানুষের অবুঝ মন ভবিষ্যতের কথা আগেভাগে জানতে চায়। কিরো ছিলেন সর্বকালের সবচেয়ে খ্যাতিমান ও নির্ভুল ভবিষ্যৎ-বক্তা। তিনি কারও হাত দেখে বা জন্মদিন-ক্ষণ হিসাব করে তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলতেন। এবার কিরোকে ছাড়িয়ে গেছে জার্মানির এক অক্টোপাস। তার নাম পল।


পল মানুষের জীবন-মৃত্যু ও সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে মাথা ঘামায় না। সে বলে দেয় বিশ্বকাপ ফুটবল খেলায় কে জিতবে। অর্থাৎ কোন দলের ভবিষ্যৎ কী। নির্ভুল তার ভবিষ্যদ্বাণী। আটটি খেলা সম্পর্কে সে যা বলেছে, তা ফলেছে।
ফুটবল খেলার মতো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করাও এক ধরনের খেলা। সেখানেও হার-জিতের প্রশ্ন আছে। বিশ্বকাপ ফাইনালে স্পেন-হল্যান্ডের খেলায় অক্টোপাস পল মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল ওলন্দাজদের দিক থেকে। তাতে বিশ্বব্যাপী তার শত্রু সৃষ্টি হয়। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী ইয়োসে জাপাতেরো পলকে নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি পলের নিরাপত্তার জন্য জার্মানিতে ‘প্রটেকশন টিম’ পাঠানোর প্রস্তাব করেছিলেন। আমরাও চাই, পল বেঁচে থাক। অন্তত বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন পর্যন্ত।
সাড়ে তিন বছর পর বাংলাদেশে যদি নির্বাচন হয় এবং তত দিন আদৌ যদি কোনো বিরোধী দলের অস্তিত্ব থাকে—পলকে আমাদের প্রয়োজন হবে। নির্বাচন কমিশনের কন্ট্রোল রুম থেকে ফলাফল ঘোষণার আগেই কে বিজয়ী হচ্ছে, তা আমরা জানতে পারব। তাতে নির্বাচন কমিশনও বেঁচে যাবে। পরাজিত দল অবধারিতভাবে অভিযোগ করবে, নির্বাচনে ভোট ডাকাতি ও কারচুপি হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলতে পারবেন, আমাদের কী করার আছে? পল তো ফলের কথা আগেই বলে দিয়েছে।
গণতন্ত্র একটি প্রতিযোগিতা। অনেকটা বিশ্বকাপ ফুটবল বা যেকোনো খেলার মতোই। সেখানে দুটি পক্ষ দরকার। এক টিমে খেলা হয় না। এক টিমের খেলোয়াড়েরা ৯০ মিনিট সারা মাঠ দৌড়ালেও একজন লোকও তাদের খেলা দেখার জন্য স্টেডিয়ামে যাবে না। দূরের দর্শকেরা টিভির সুইচ অফ করে দেবে। এক দলের অতি চমৎকার শাসনও অগণতান্ত্রিক স্বৈরশাসন—তা সামরিকই হোক বা বেসামরিকই হোক, নির্বাচিতই হোক বা অনির্বাচিতই হোক।
বাংলাদেশের বিরোধী দল সরকারসমর্থক সাংবাদিক ও কলাম লেখকদের অভিশাপে যদি নিজের থেকেই শেষ হয়ে যায়, তা হলে বলার কিছু নেই। কিন্তু সরকারের বন্ধুদের বুদ্ধিমতো যদি বিরোধী দলকে শেষ করার সুবন্দোবস্ত করা হয়, তাতে বরং বিরোধী দল লাভবান হতে পারে। তখন বিরোধী দলের মরা ডালে সবুজ পাতা গজাবে এবং ফুল ফুটবে।
গণতন্ত্রের প্রতিযোগিতা হলো ভালো কাজের প্রতিযোগিতা। কার কতটা জনসমর্থন আছে, তার ফাইনাল পরীক্ষা। যাঁরা গণতন্ত্রের জন্য অশ্রুবিসর্জন দেন, অথচ বিরোধী দলের বিলুপ্তি কামনা করেন, তাঁরা খুবই বিদ্বান, কিন্তু গণতন্ত্র সম্পর্কে তাঁদের কোনো ধারণা নেই। ধারণা থাকা সত্ত্বেও যদি তাঁরা সরকারকে সেই পথে চলতে উৎসাহ দেন, তা হলে তাঁরা কী মাপের কপট তা জনগণ বলতে পারবে। যে গণতন্ত্রে বিভিন্ন দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা যত তীব্র, সে গণতন্ত্র তত খাঁটি, মজবুত ও টেকসই।
আশা-নিরাশা সবখানেই আছে। খেলায়ও আছে, গণতন্ত্রেও আছে। আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের যে দশা হলো। তারা ছিল বিশ্বকাপে এ টিম এবং বি টিম। এবার দুটোই বাদ। কয়েকটি মধ্যমানের টিম থাকলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতেও আমরা পেয়েছি প্রধান দুটি টিম—এ এবং বি। মাঝেমধ্যে গণতন্ত্রেও আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের অবস্থা হওয়া ভালো। এ এবং বি-এর বদলে নতুন টিম; তা জার্মানি বা ইংল্যান্ড হোক, স্পেন বা নেদারল্যান্ডস হোক। সি, ডি, ই, এফ টিম হলে ক্ষতি কী?
গণতন্ত্রের খেলাটা যদি অবাধ, সুষ্ঠু ও সুন্দর হয়, তাহলে কোনো রকম ভবিষ্যদ্বাণীই ষোলো আনা সফল হওয়ার সুযোগ থাকে না। যেমন হলো সেদিন চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামে আমাদের এ এবং বি টিমের মধ্যে কোয়ার্টার ফাইনাল। ওই খেলার ফলাফলের ভবিষ্যদ্বাণী অক্টোপাস পল মহোদয়ও করতে পারত না। সেখানে বিজ্ঞ বুদ্ধিজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ পণ্ডিত, ত্রিকালদর্শী কলাম লেখক ও সাংবাদিকদের যূথবদ্ধ ভবিষ্যদ্বাণীই টিকল না। না টেকার কারণ, খেলায় দর্শকদের কিছু করণীয় নেই, চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া। গণতন্ত্রের খেলায় ভোটারদের প্রচণ্ড ক্ষমতা। সেখানে তাঁবেদারদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও ভবিষ্যদ্বাণীর কোনো মূল্য নেই।
পল আরও সাড়ে তিন বছর বাঁচলে ভালো। আমাদের এ এবং বি টিমের মধ্যে কে জেতে তা তার কাছ থেকে জানা যাবে। তবে আরেকটি অলৌকিক অক্টোপাসের আবির্ভাব হওয়া আবশ্যক, যে অক্টোপাস বিভিন্ন দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে। সেই অলৌকিক অক্টোপাসের কাছে গিয়ে আমরা জানতে চাইব, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎটা কী?
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.