শ্রদ্ধাঞ্জলি-বহুভাষাবিদ জাহাঙ্গীর তারেক by আবদুশ শাকুর

ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ সত্ত্বেও তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল আনুষ্ঠানিক—আমার সম্বোধন প্রফেসর, তাঁর সম্বোধন শাকুর সাহেব। হুট করে কোনো পছন্দমতো শব্দ মনে না পড়লেই ফোন করতাম: একটা জুতসই শব্দ বলুন তো প্রফেসর—daughter city? অমনি জবাব পেতাম: ‘দুহিতা-নগরী’। জিজ্ঞেস করতাম: vision? জবাব পেতাম: ‘ভাবদৃষ্টি’।


তাঁর ফোন পেলাম: বাংলায় sub-atom-এর সুবিধেমতো বাংলা শব্দ কী হতে পারে শাকুর সাহেব? বললাম: ‘অবর পরমাণু’। শব্দ দুটিকে ক্ষণেক চেখে নিয়ে বললেন: ‘অবর’ শব্দটি সুবিধেমতো হলো কি? বললাম: না-হলে লিখুন ‘ঊনপরমাণু’। বললেন: ‘হ্যাঁ, এ শব্দটি স্বচ্ছ।’ মানে শোনামাত্রই পছন্দ এবং গৃহীত। ব্যাপারটার পাল্টাও হতো। যেমন আমার জিজ্ঞাসা ছিল: charged-এর সুবিধেমতো বাংলা শব্দ কী হতে পারে প্রফেসর? বললেন: ‘প্রভারিত’। বললাম: শব্দটি সুবিধেমতো হলো কি? বললেন: না হলে লিখুন ‘পরিপ্লুুত’। বললাম: ‘হ্যাঁ, এ শব্দটি স্বচ্ছ।’
এমনি উচ্চারণ ও বানানের ব্যাপারেও তিনি ছিলেন আমার মতো অনেকেরই জিজ্ঞাসার ঠিকানা। প্রফেসর, Catallus উচ্চারণ? ‘কাতাল্লুস’। ‘De Broglie-র বানান কীভাবে লেখেন আপনি?’ ‘দ্য ব্রয়’। ‘Cicero উচ্চারণ চিচেরোই তো?’ ‘না, কিকেরো। কারণ ল্যাটিন ভাষায় K-র জায়গায় C ব্যবহূত হয়।’ ‘Emile Durkheim বাংলায় কীভাবে লিখব?’ ‘এমিল দ্যুরক্যাঁ’। ‘Heraclitus-এর বাংলা উচ্চারণ কী?’ ‘এরাক্লিতুস’।
অনেক বছর ধরে তাঁর সঙ্গে এমনি লেনদেন চলত। তবে আমার লেনই বেশি চলত, দেন চলত ক্বচিত-কদাচিত। কারণ তাঁর পারদর্শিতা ছিল বিশ্বের ১৪টি ভাষায়—বেঙ্গলি, ইংলিশ, ফ্রেঞ্চ, জার্মান, ইতালিয়ান, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, হিন্দি, উর্দু, অ্যারাবিক, পার্শিয়ান, সংস্কৃত, ল্যাটিন ও ডাচ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজেসের প্রফেসর জাহাঙ্গীর তারেক ১৯৪৩ সালের পয়লা জানুয়ারি বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে এমএ পাস করেন ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, ফরাসি সাহিত্যে এবং ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স করেন সরবোন ইউনিভার্সিটি ও প্যারিস ইউনিভার্সিটি থেকে যথাক্রমে ১৯৭১ ও ১৯৭৩ সালে। তাঁর ইংরেজিতে মাস্টার্সের থিসিস ছিল কবিতার ক্রিটিক হিসেবে লাসেলেস এবারক্রম্বি। এরপর ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন সরবোন ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৭৬ সালে। যত দূর মনে পড়ে, তাঁর ডক্টর‌্যাল ডিসার্টেশনের বিষয় ছিল ফরাসি ও ইংরেজি ভাষার রোমান্টিক পেরিয়ডের তুলনামূলক সাহিত্যবিচার। এরপর ফ্রান্সের ক্রেডিফে ১৯৮৪-১৯৮৫ সালে এক বছরের প্রশিক্ষণ এবং গবেষণা প্রোগ্রাম সম্পূর্ণ করেন ‘টেকনিক্স অব মডার্ন এডুকেশন’ বিষয়ে। জুন ১৯৯১ থেকে নভেম্বর ১৯৯২ পর্যন্ত ডক্টর জাহাঙ্গীর তারেক রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেন ইউনিভার্সিটি অব মিউনিকের আলেক্সান্দার ফন হুমবোল্ট ফাউন্ডেশনে।
বাংলা ভাষায় অনুবাদে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন তিনি। বাংলা একাডেমী প্রকাশ করেছে প্রফেসর তারেক অনূদিত শব্দার্থ-বিজ্ঞানের মূলসূত্র (প্রিন্সিপলস অব সিম্যান্টিক্স—স্টিফেন উলম্যান), গ্যুস্তাভ ফ্লোবেরের মাদাম বোভারি। এ ছাড়া তিনি অনুবাদ করেছেন কারিগরি বিদ্যার দিশারী (ট্রেইল ব্লেজার্স অব টেকনোলজি— হারল্যান্ড ম্যাঞ্চেস্টার), সামাজিক সংকটে বিজ্ঞানের ভূমিকা (ক্যান সায়েন্স সেভ আস?— জর্জ এ লুন্ডবার্গ)।
ডক্টর জাহাঙ্গীর তারেকের মৌলিক রচনা এবং গবেষণাপত্রও অনেক। বাংলা একাডেমী প্রকাশিত সিম্বলিস্ট লিটারেচার, নজরুল ইনস্টিটিউট প্রকাশিত কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও গানের ওপর ফ্রেঞ্চ এবং স্প্যানিশ ভাষায় বিভিন্ন রচনা। ইনস্টিটিউট অব মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজেসের জার্নালে প্রকাশিত ‘বেসিক বাংলা ভোকাবুলারি’, বাংলা একাডেমী পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ম্যান’স স্টেট ইন দ্য প্লেজ অব কাম্যু’, ‘রোমান্টিসিজম অ্যান্ড কানশিয়ান ফিলসফি’, ‘দি থিয়োরি অব আর্ট অব ফ্রাঙ্কফুর্ট ফিলসফি’ ইত্যাদি। বাংলা একাডেমীর বহুল ব্যবহূত বেঙ্গলি-ইংলিশ ও ইংলিশ-বেঙ্গলি ডিকশনারি দুটিরও অন্যতম সম্পাদক ছিলেন প্রফেসর জাহাঙ্গীর তারেক। তিনি ‘সিডা’র লিগ্যাল রিফর্ম প্রকল্পাধীন ইংলিশ-বাংলা লিগ্যাল লেক্সিকনের ওপরও কাজ করে গেছেন ২০০৩ সালের জানুয়ারি থেকে।
ডক্টর তারেক ‘আন্তর্জাতিক নজরুলচর্চা কেন্দ্র’-এর জাতীয় কমিটির কো-চেয়ারম্যান এবং ‘ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ইনস্টিটিউট’-এর উপদেষ্টা ছিলেন।
ভাষা ও সাহিত্যজগতের এই বিরল পণ্ডিত এবং নীরব কর্মী ২৯ জুন ২০১০ মাত্র ৬৭ বছর বয়সে হূদযন্ত্রের ব্যর্থতাহেতু আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্ত্রী রাফিয়া তারেকও শিক্ষয়িত্রী। এক মেয়ে ও এক ছেলে ব্যাংকার, আরেক মেয়ে হংকং ইউনাইটেড ওয়ার্ল্ড কলেজের ছাত্রী।
বড় মেয়ে মৌনীর ওয়ার্কবুকে লেখা পিতার শেষ বাণীটি ছিল: ‘ট্রাই টু বি এ গুড হিউম্যান বিইং। অলওয়েজ বি কাইন্ড অ্যান্ড ইউজফুল টু আদার। রিমেমবার দ্যাট উই আর অল গেস্টস অব লাইফ। গেস্টস ডু নট ফাইট বাট হেলপ ইচ আদার। বি গুড, ডু গুড, অ্যান্ড থিংক গুড।’ ছোট মেয়ে সুনানের খাতায় লিখেছেন: ‘শান ইভিল অ্যাট এনি কস্ট, ফলো দি পাথ অব গুডনেস। অ্যাক্ট ওনলি টু প্লিজ গড। মেক বেস্ট ইউজ অব ওয়াটেভার গিফটস ইউ হ্যাভ রিসিভড ফ্রম দি ক্রিয়েটর।’ ছেলে তীথিকের প্রতি বাণীটি লেখা বাংলায়: তীথিকের দীপ্র দৃষ্টি থির বিদ্যুৎ রেখায় ঊর্ধ্ব পানে নিত্য যেন জ্বলে। নিবেদিতচিত্ত শিক্ষাব্রতীর এই উপদেশগুলি সম্ভবত তাঁর ছাত্রছাত্রীদের প্রতিও।

No comments

Powered by Blogger.