এবার মুরগির বাজারে আগুন

সরকারি হিসাবেই গত এক সপ্তাহে বাজারে মুরগির দাম বেড়েছে ২২ শতাংশের বেশি। এ থেকে মুরগির বাজারের আগুনের ভয়াবহতা হয়তো খুব বেশি বোঝা যাবে না। তবে সরাসরি দামটা বললে আগুন কিছুটা টের পাওয়া যেতে পারে।


ঢাকার বাজারে এখন এক কেজি ওজনের ব্রয়লার বা ফার্মের মুরগি কিনতে হলে গুনতে হবে ১৮০ টাকা। আর চট্টগ্রামের বাজারে দুটি ১০০ টাকার নোট দিলে ফেরত পাওয়া যাবে না এক টাকাও। সেখানে দাম এখন ২০০ টাকা।
মুরগি ব্যবসায়ীরা বলছেন, কয়েক দিন ধরেই মুরগির দাম বাড়ছে। দ্রুত কমবে বলে কোনো আশ্বাস দিতে পারলেন না তাঁরা। অর্থাৎ এবার মুরগির দামও দেশের বাজারে নতুন রেকর্ড করল। সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, এক বছর আগেও এই মুরগির কেজি ছিল ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা। অর্থাৎ এক বছরে দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশ আর এক মাসে ২২ শতাংশ।
দাম বাড়ার ক্ষেত্রে অবশ্য ডিম হারিয়ে দিয়েছে মুরগিকে। টিসিবির হিসাবে গত এক বছরে ডিমের দাম বেড়েছে ৫১ শতাংশ। এর মানে হলো, ডিম ও মুরগি এখন নিম্নমধ্যবিত্তদের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলছে। মাঝে মাঝে ডিম ও মুরগি খেতে হলে এখন মধ্যবিত্ত হতে হবে, আর নিয়মিত খাবেন কেবল উচ্চবিত্তরা।
ঢাকার বাজার: রাজধানীর বাজারে গত এক সপ্তাহে মুরগির দাম কেজিপ্রতি পাঁচ থেকে ১৫ টাকা এবং ডিমের দাম ডজনপ্রতি তিন টাকা করে বেড়েছে। গতকাল শুক্রবার কারওয়ান বাজার ঘুরে এ তথ্য মিলেছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আড়ত থেকে বেশি দামে কিনতে হয় বলে বিক্রি করতে হয় বেশি দামে। সরবরাহ কমে যাওয়ায় দাম বেড়েছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, বাজারে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া ব্রয়লার মুরগির দাম গত সপ্তাহে ছিল ১৭০ থেকে ১৭৫ টাকা কেজি। আর গতকাল তা বিক্রি হয়েছে ১৮০ টাকায়। কারওয়ান বাজারের তুলনায় অন্যান্য বাজারে দাম আরেকটু বেশি।
বড় সাইজের পাকিস্তানি কক প্রতিটি গত সপ্তাহে ২০০ থেকে ২২০ টাকায় বিক্রি হলেও গতকাল এর দাম ছিল ২২০ থেকে ২৫০ টাকা। অন্যদিকে গত সপ্তাহে প্রতি ডজন ডিম ১০৩ টাকা বিক্রি হলেও গতকাল এর দাম ছিল ১০৫ টাকা।
কারওয়ান বাজারের মুরগি ব্যবসায়ী ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘দাম বাড়ার কারণ জানি না। বেশি দামে কিনতে হয় বলে বেশি দামে বিক্রি করি। তেজগাঁওয়ের মুরগির আড়ত থেকে প্রতি সপ্তাহেই বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। সরবরাহ কমে যাওয়ায় বাজারে মুরগির সংকট দেখা দিলে দাম বাড়ে।’
চট্টগ্রামের বাজার: চট্টগ্রাম থেকে মিঠুন চৌধুরী জানান, চট্টগ্রামের খুচরা বাজারে গতকাল দাম বেড়ে ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে ব্রয়লার মুরগি। অথচ এক মাস আগেও ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ১৪০ টাকা।
বিক্রেতাদের অজুহাত—সরবরাহ কম, কিন্তু মুরগির চাহিদা বেড়েছে। আর খামারিরা বলছেন, বাচ্চার দাম বেড়ে যাওয়ায় মুরগির দাম বাড়ছে। আর বাচ্চা উৎপাদনকারীরা বলছেন, এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার আতঙ্কে মাস দুয়েক আগে থেকেই বাচ্চা উৎপাদন কমতে শুরু করেছে। মাস খানেকের মধ্যে বাচ্চার উৎপাদন স্বাভাবিক হলেই মুরগির দাম কমতে শুরু করবে।
নগরের রিয়াজউদ্দিন বাজার ও চৌমুহনীর সিডিএ কর্ণফুলী মার্কেট ঘুরে গতকাল দেখা গেছে, প্রতি কেজি ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগির দাম ১৯০ টাকা। তবে নগরের পাড়া-মহল্লার দোকানগুলোতে দাম ২০০ টাকা। যেমন, সিরাজউদ্দৌলা সড়কের দোকানগুলোতে ২০০ টাকার নিচে মুরগি পাওয়া যায়নি। সিডিএ কর্ণফুলী মার্কেটের ওয়ান স্টার ব্রয়লার অ্যান্ড ড্রেসিং হাউসের স্বত্বাধিকারী আবদুল গণি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতি কেজি ব্রয়লার কিনতে হয় ১৮০ টাকায়, বিক্রি করছি ১৯০ টাকা। লেয়ার প্রতি কেজি ১৭৮ থেকে ১৮০ টাকা কিনে বিক্রি করছি ১৯০ টাকায়। বাজারে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। তাই দাম বাড়ছে।’
কর্ণফুলী বাজারের ক্রেতা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘মূল্যবৃদ্ধির এই প্রবণতা কোথায় গিয়ে থামবে, তা বুঝতে পারছি না। বেশি দামের কারণে মুরগি ছাড়া অন্য মাংস নিয়মিত খাওয়া সম্ভব হয় না। এখন মনে হচ্ছে মুরগির মাংসও খেতে পারব না। আমাদের মতো মধ্যবিত্তরা তাহলে যাবে কোথায়?’
মুরগির খামারি ও বাচ্চা উৎপাদনকারীদের দাবি, মুরগির বাচ্চা সংকটের কারণে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কমে গেছে। খাবারের দামসহ অন্যান্য খরচ বেড়ে গেছে। খামারিরা জানান, বর্তমানে প্রতিটি ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার দাম ৭০ টাকা। এক কেজি মুরগির মাংস উৎপাদনে প্রয়োজন হয় দুই কেজি খাবার। দুই কেজি খাবারের দাম ৭০ টাকা। এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকার নিচে পাইকারিতে প্রতি কেজি মুরগি বিক্রি সম্ভব হয় না। এরপর কয়েক হাত ঘুরে বাজারে এসে মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৯০ থেকে ২০০ টাকায়।
পাহাড়িকা ফার্মস লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী দিদারুল আলম বলেন, ‘প্রায় আড়াই মাস আগে থেকে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার আতঙ্কে বাচ্চা উৎপাদন কমে যায়। তখন থেকেই বাচ্চার দাম বাড়তে শুরু করে। এর আগে প্রতিটি ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার দাম ছিল ৪০ টাকা, এখন তা ৭০ টাকা।’
বাংলাদেশ পোলট্রি ব্রিডারস অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক মো. রকিবুর রহমান বলেন, ‘সারা দেশে এক সপ্তাহে ৯০ লাখ মুরগির বাচ্চার চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে প্রতি সপ্তাহে উৎপাদন ৬০ থেকে ৬৫ লাখ। পাশাপাশি ভারত থেকে আরও ১০ লাখের মতো বাচ্চা আমদানি করা হয়। তার পরও চাহিদার পুরোটা মেটানো সম্ভব নয়।’ বাচ্চার উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে রকিবুর রহমান বলেন, ‘মাস চারেক আগে মুরগি ও বাচ্চার দাম খুব কম ছিল। এ কারণে বাচ্চা উৎপাদনকারীদের কেউ কেউ প্যারেন্ট স্টক (বাচ্চা উৎপাদনকারী মুরগি) কমিয়ে ফেলে। এরপর দেখা দেয় রানীক্ষেতের প্রাদুর্ভাব ও এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা আতঙ্ক। সব মিলিয়ে বাচ্চার উৎপাদন কমে গেছে। ফলে মুরগির উৎপাদনও কমে গেছে। এখন মুরগির দাম বাড়তে থাকায় আবার খামারিরা বাচ্চা ও মুরগির উৎপাদন বাড়াচ্ছেন। আশা করি, সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে মুরগির দাম কমবে।’
চট্টগ্রামের সহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘চট্টগ্রামে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার কোনো নমুনা পাওয়া যায়নি। তবে খামারিদের একটি অংশ আতঙ্কে মুরগি উৎপাদন বন্ধ রেখেছিল। এখন চাহিদা বাড়ায় তারা আবার উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছে।’

No comments

Powered by Blogger.