দেখে-শুনে লেখা-রাজশাহী: শান্ত সবুজ সুখী নগর by মশিউল আলম

রোববার সন্ধ্যায় রাজশাহী শহরের সাহেববাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকিয়ে মনে হয় যেন এক ভূতুড়ে পরিবেশ। আলো নেই, বিদ্যুৎওয়ালারা লোডশেডিং চালাচ্ছে। আকাশ অন্ধকার, মেঘে মেঘে ছাওয়া, থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে সারা দিন। রাস্তাঘাট পানি ও কাদায় একাকার। এবং শহরটি যেন বেশি মাত্রায় নীরব।


চাপা নীরবতার মধ্যে শুধু মাঝে মাঝে শোনা যায় ব্যাটারি-চালিত অটোরিকশার চালকদের বিরল দুয়েকটি ডাক: তালাইমারী, কাজলা, বিনোদপুর, মতিহার...।
পথের পাশের এক দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম: লোডশেডিং কতক্ষণ চলবে? তিনি হেসে বললেন, তার নাকি কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। ‘দিনে-রাতে কতবার যে কারেন্ট যায়, কোনো আগামাথা পাবেন না,’ তিনি বললেন। জানতে চাইলাম রাজশাহীবাসীর জীবনে আর কী কী সমস্যা। তিনি প্রথমেই বললেন পানির সমস্যার কথা। বিশুদ্ধ পানির বড়ই অভাব, সিটি করপোরেশন যে পানি সরবরাহ করে তা পান করার যোগ্য নয়। যারা পান করে, তাদের জন্ডিস, আমাশয় ইত্যাদি পীড়া হয়। অনেক এলাকায় পানির সরবরাহ নেই; টিউবওয়েলে এখন আর পানি ওঠে না। তারপর আছে মশার ভীষণ উপদ্রব। তারপর রাস্তাঘাট খুব খারাপ, নালা-নর্দমাগুলো দুর্গন্ধ ছড়ায়, বৃষ্টি হলে উপচে পড়ে, অনেক এলাকায় পানি জমে গিয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।
জিজ্ঞেস করলাম, সিটি করপোরেশন কি এসব সমস্যা দেখে না? উত্তর: ‘সিটি করপোরেশন বলেন, সরকার বলেন, তারা যে আছে সেটাই টের পাই না। আমরা চলছি, সিটি করপোরেশন না থাকলেও আমাদের এভাবেই চলত, ঠিক আছে?’
কথার শেষে এমন সুন্দর ও কোমল সুরে ‘ঠিক আছে’ শব্দ দুটো উচ্চারিত হলো যে তাতে কোনো খেদ আছে বলে ঠাহর হয় না। কিন্তু এই ‘ঠিক আছে’ কথাটার মানে এই নয় যে সবকিছু ঠিকঠাক আছে, বরং এই কথাটার মানে ‘বুঝলেন তো?’
মানেটা বোঝা গেল আরও অনেক মানুষের সঙ্গে কথা বলে। যেমন, আমের বাজারে গিয়ে ভারতীয় ল্যাংড়া আম বিক্রি হচ্ছে দেখে যখন বললাম, আমের দেশেই এ অবস্থা? রাজশাহীর আম কি সব ফুরিয়ে গেল? আমবিক্রেতা সম্ভবত ভাবলেন, আমি তাঁর ঘাট ধরতে গেছি। বললেন, ‘চোরাচালানের না, এলসি খুলে ইমপোর্ট করা আম, ঠিক আছে?’
এবং সন্ধ্যার আরও পরে নগরভবনে মেয়র খায়রুজ্জামান লিটনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ‘ঠিক আছে’ কথাটার মানে সম্পর্কে আরও নিশ্চিত হওয়া গেল, যখন তিনি তাঁর নগরসহ পুরো রাজশাহী বিভাগের প্রতি দেশের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের অবহেলার অনুযোগ করতে গিয়ে বললেন, ‘আমরা হলাম নদীর এপারে, ঠিক আছে?’ মেয়র খায়রুজ্জামান মনে করেন, উন্নয়নের নিরিখে বাংলাদেশ মোটা দাগে দুভাগে বিভক্ত: যমুনা নদীর পশ্চিম ভাগ ও পূর্ব ভাগ। পশ্চিম ভাগের উত্তরে পঞ্চগড় থেকে দক্ষিণে সাতক্ষীরা পর্যন্ত পুরো এলাকাই কেন্দ্রীয় প্রশাসনের অবহেলার শিকার।
৩০টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত রাজশাহী সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত অধিবাসীর সংখ্যা ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী তিন লাখ ৮১ হাজার। কিন্তু বর্তমানে লোকসংখ্যা প্রায় সাত লাখ, জানালেন মেয়র খায়রুজ্জামান। হলে কী হবে, কেন্দ্র থেকে এখনো যে বার্ষিক থোক বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা ওই তিন লাখ ৮১ হাজারের হিসাবেই। সিটি করপোরেশনের নিজস্ব আয় নগণ্য, ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে ছিল ১২ কোটি টাকা, পরের বছর ১৬ কোটি। এর মধ্যে হোল্ডিং ট্যাক্স ২৫ শতাংশ ও পানির বিল সামান্য কিছু বাড়ানোর ফলে চলতি অর্থবছরে করপোরেশনের রাজস্ব আয় ২২ কোটি টাকা হবে বলে মেয়রের প্রত্যাশা। হোল্ডিং ট্যাক্স, পানির বিল, হাট-বাজারের ইজারা, ঠিকাদারি ও যানবাহনের লাইসেন্স-পারমিট ইত্যাদি হলো সিটি করপোরেশনের নিজস্ব আয়ের উৎস। নিজস্ব আয় থেকে করপোরেশনের ২৬০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর (৭০০ জন স্থায়ী স্টাফ, বাকিরা মাস্টাররোলে) বেতন-ভাতাই পরিশোধ করা সম্ভব হয় না। কেন্দ্র থেকে বার্ষিক বরাদ্দ দেওয়া হয় ১৪-১৫ কোটি টাকা। এ থেকেও ২৫ শতাংশ নিতে হয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করার জন্য। অর্থাৎ, ব্যাপার দাঁড়াচ্ছে এ রকম যে নগরবাসীর করের সমস্ত টাকা তো বটেই, নগরের উন্নয়ন ও নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর লক্ষ্যে কেন্দ্র থেকে যে অর্থ দেওয়া হয়, তারও ২৫ শতাংশ খরচ হয়ে যায় সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পুষতে গিয়ে। তাই বোধ হয় রাজশাহী নগরবাসী টের পায় না সিটি করপোরেশন আছে না নেই।
মেয়র খায়রুজ্জামান মনে করেন, এভাবে চলতে পারে না, সিটি করপোরেশনের নিজস্ব আয় বাড়াতে হবে। তিনি জানালেন, চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী সিটি করপোরেশনের আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে যেসব বাণিজ্যিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেগুলো তাঁকে আকৃষ্ট করেছে। রাজশাহীর মেয়র চট্টগ্রাম গিয়ে সেগুলো দেখা ও বোঝার চেষ্টা করেছেন এবং এখন নিজের নগরেও সেসব অনুসরণের চেষ্টা করছেন। তিনি বেশ কিছু বাণিজ্যিক কর্মোদ্যোগ নিয়েছেন এবং আরও নিতে চলেছেন। যেমন, সিটি করপোরেশনের খালি জায়গায় পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে আট-দশটি বহুতল বাণিজ্যিক ভবন গড়ে তোলা হচ্ছে, বছর দুয়েক পরে এ থেকে সিটি করপোরেশনের অনেক টাকা আয় হবে। এ ছাড়া একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, চারটি সিএনজি স্টেশন, নদীতীরে পর্যটন, বিনোদন ব্যবসা ইত্যাদি উদ্যোগের কথা মেয়র জানালেন।
কিন্তু নগরের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নাগরিক সুযোগ-সুবিধাগুলো বাড়ানোর জন্য শুধু এগুলোই যথেষ্ট হবে কি না সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন। রাজশাহী নগরের উন্নয়নকে তিনি গোটা বরেন্দ্র অঞ্চলের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে মনে করেন। শিক্ষানগর নামে পরিচিত রাজশাহী শহরের ব্যবসা-বাণিজ্য মূলত শিক্ষার্থী ও শিক্ষাসম্পৃক্ত জনগোষ্ঠীর ওপর নির্ভরশীল। বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যখন বন্ধ থাকে তখন পুরো শহরটির ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা চলে আসে।
মেয়র খায়রুজ্জামান তাই মনে করেন, রাজশাহী নগর ও তার আশপাশে শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা প্রয়োজন। দেশের শিল্পোদ্যোক্তাদের ঢাকা-কেন্দ্রিকতা ত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এ বিষয়ে তিনি বললেন, ‘তৈরি পোশাকসহ ক্ষুদ্র-মাঝারি বিভিন্ন শিল্পের উদ্যোক্তাদের আমরা আহ্বান জানিয়েছি, আপনারা রাজশাহীতে আসুন, শিল্প গড়ুন। তাঁরা আমাকে বলেছেন, তিনটা জিনিস নিশ্চিত করতে হবে। এক, গ্যাস সরবরাহ, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ এবং নাটোর থেকে রাজশাহী পর্যন্ত মিশ্র গেজের রেললাইন, যাতে করে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত রেলগাড়িতে পণ্য পরিবহন করা যায়। আশার কথা, গ্যাস অচিরেই এসে যাচ্ছে, রাজশাহীর অদূরে কাটাখালীতে ৫০ মেগাওয়াটের একটি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ ইউনিট স্থাপনের অনুমোদন ও কার্যাদেশ ইতিমধ্যেই দেওয়া হয়েছে, আর রেললাইনের কাজটার জন্যও উদ্যোগ চলছে। আশা করা যায়, এক-দেড় বছরের মধ্যে এসব কাজ সম্পন্ন হলে কিছু শিল্প-উদ্যোক্তাকে রাজশাহীমুখী করা যাবে।’ তিনি আরও বললেন, রাজশাহীতে শিল্প স্থাপনের জন্য সরকারের তরফ থেকে প্রণোদনার ব্যবস্থা করা উচিত, ব্যাংকের সুদের হার কমিয়ে ১০ শতাংশের নিচে নামানো উচিত।
রাজশাহীর শিল্পায়নের ব্যাপারে আশাবাদী সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনুও, যিনি পরপর তিনবার নির্বাচিত হয়ে ১৬ বছর মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন। মঙ্গলবার রাতে এক রেস্টুরেন্টে বসে চা খেতে খেতে তিনি আমাকে বললেন, ‘রাজশাহী কৃষিপ্রধান অঞ্চল, এখানে কৃষিভিত্তিক শিল্পের সম্ভাবনা বেশ উজ্জ্বল।’ তিনি জানালেন, ইতিমধ্যে দুটি প্রসিদ্ধ শিল্প গ্রুপ রাজশাহীতে শিল্প স্থাপন করেছে। একই ধরনের মন্তব্য করলেন রাজশাহী চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মো. আবু বাক্কার: ‘ঢাকা ও তার আশেপাশে জমির দাম যেভাবে বেড়েছে, সেখানে জমি কিনে বড় ধরনের শিল্পকারখানা গড়া এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। তা ছাড়া যে রকম শ্রমিক অসন্তোষ, দাঙ্গা-হাঙ্গামার খবর পাওয়া যায়, তাতে আমার মনে হয়, ঢাকাকেন্দ্রিক শিল্পায়নে স্যাচুরেশন চলে এসেছে। রাজশাহীতে গ্যাস সরবরাহ শুরু হলে আর অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার উন্নয়ন ঘটলে বুদ্ধিমান শিল্পোদ্যোক্তারা রাজশাহীর দিকে চলে আসতে শুরু করবেন।’
তবে কি রাজশাহীকে শিক্ষানগর থেকে শিল্পনগরে রূপান্তরের কথা ভাবছেন সাবেক মেয়র, বর্তমান মেয়র এবং ব্যবসায়ী নেতারা? এবং এ বিষয়ে কী ভাবেন রাজশাহীর সাধারণ মানুষ? বিনোদপুরে দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ পড়া দুই তরুণী বললেন, লেখাপড়া শেষে চাকরি চাই, কিন্তু রাজশাহীতে কর্মসংস্থানের অভাব, তাই চাকরি খুঁজতে ঢাকা যেতে হবে। রাজশাহীতে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠলে কর্মসংস্থান হবে। তখন তাঁদের জীবিকার জন্য ঘর ছাড়তে হবে না। শিল্পায়ন ছাড়া রাজশাহীর এই দীনদশা কাটার উপায় নেই বলে প্রায় সবাই মনে করেন। তবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে কিছুু তরুণ শিক্ষার্থী বললেন, শিল্প-কারখানা স্থাপনের কথা যতই বলা হোক, রাজশাহীতে সেটা বেশি মাত্রায় ঘটবে না কারণ এখান থেকে বন্দর অনেক দূরে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এমএ ক্লাসের এক শিক্ষার্থী বললেন, রাজশাহীকে বরং ভারতের বেঙ্গালুরুর মতো আইসিটি নগর হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিলে ভালো হবে। মনে পড়ল, আগের দিন সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনুও এমন কথা বলেছিলেন। একবার রাজশাহীকে আইসিটি নগর ঘোষণার কথা উঠেছিল, কিন্তু তারপর আর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ৯৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই নগরের বিশেষত্ব এর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। এই বিশেষ পরিচয়েই এটির আরও উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। এখানকার পরিবেশ শান্ত, কোলাহলমুক্ত, সারা শহরে প্রচুর গাছপালা, পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পদ্মা নদী, নগরে আছে ২৯টি পার্ক। শিক্ষা ও গবেষণার জন্য এমন উপযোগী পরিবেশ আর হয় না।
মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আয় বাড়েনি রাজশাহীর সাধারণ মানুষের। কিন্তু রাস্তাঘাটে মানুষের ঊর্ধ্বশ্বাস ছুটে চলা নেই; তাদের চোখমুখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলে মনে হয় না তারা নিদারুণ অসুখী। মঙ্গলবার সন্ধ্যার পরে আলো-আঁধারিময় সরু অলিগলি দিয়ে রিকশায় সাহেববাজার থেকে সিরইল মোল্লা মিলের গলির দিকে যেতে যেতে পঞ্চাশোর্ধ্ব রিকশাচালককে জিজ্ঞাসা করি, কেমন চলছে জীবন। তিনি বললেন, ‘আমরা হলাম গরিব মানুষ, ঠিক আছে? আমাদের জীবন যেমন করে চলে তেমনি চলছে।’ আরও পরিষ্কার করে বললাম, জীবনটা খুব কষ্টের হয়ে উঠেছে কি না। উত্তরে তিনি বললেন, ‘কষ্টের কী আছে।’
মনে পড়ল, আগের দিন সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু কথা প্রসঙ্গে আমাকে বলেছিলেন, ২০০৪ সালে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের সমীক্ষায় বিশ্বের মাঝারি আকারের শহরগুলোর মধ্যে রাজশাহী চিহ্নিত হয়েছিল সবচেয়ে সুখী শহর হিসেবে।
রাজশাহী, ১৪ জুলাই ২০১০
 মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.