চারদিক-ভোলার প্রাণভোমরা যখন গাছ by নেয়ামতউল্যাহ

‘নদীর তীরে বাস, ভাবনা বারো মাস’। না, শুধু নদীভাঙনের কথা নয়, আছে জলোচ্ছ্বাস, আছে সিডর, আইলা, রেশমির মতো টর্নেডো-ঘূর্ণিঝড়। উপকূলবাসী বাঁচতে চায় এ দুর্যোগের হাত থেকে। ভোলার প্রবীণেরা বলছেন, দুর্যোগের সংখ্যা বাড়ছে। হুমকির মুখে পড়েছে কৃষি ও কৃষক। ২০১০ সালে ভোলায় দুর্যোগ হলো কয়েকটি।
একটি হলো অতিমাত্রায় শীত, গাছের কোল্ড অ্যালার্জি। কৃষকদের বোরো বীজ অঙ্কুরিত হচ্ছে না। অঙ্কুরিত হয়নি রবিশস্য। যাও বা বোরো বীজ অঙ্কুরিত হলো, বাড়ছে না। রোদ না পেয়ে চারা লাল হয়ে ঝলসে গেছে। কৃষকেরা গরম আবহাওয়ার কারণে অপেক্ষা করেছেন। অধিকাংশ কৃষকের বীজতলা নষ্ট। বীজতলা নষ্ট হওয়ার অর্থ, ফসলের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়া। সদর উপজেলার তরমুজচাষিরা জানালেন, তাঁরা পাঁচবার বীজ পুঁতেছেন। প্রচণ্ড শীতে নাকি নষ্ট বীজ অঙ্কুরিত হয়নি।
এরপর এল লোনাপানি। শত বছরের পুরোনো কৃষক পর্যন্ত জানালেন, মার্চের শেষে জোয়ারের সঙ্গে লবণ আসার প্রশ্নই আসে না। তবুও তো এল! এই প্রথম এল। শুধু এলই না, সাত-আট দিনের মধ্যে পচে গেল তরমুজ, সয়াবিন, মরিচ, ডালখেত। কৃষি কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ভোলায় প্রায় ৩৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল লবণে ক্ষতির শিকার। এ বছর কৃষকের সয়াবিন পচেছে। গত বছর পোকায় কেটেছে সয়াবিন। বাজারের সব কীটনাশক ছিটিয়েও কাজ হয়নি।
লোনাপানির পর অনাবৃষ্টি। আমনের বীজতলা তৈরি করতে পারছেন না কৃষক। পারেননি আউশের চারা লাগাতে। এ সময় অমাবস্যা-পূর্ণিমায় উঠে এল জোয়ার। বুকসমান পানি। খেতের বীজতলা ভেসে যায়।
শীত মৌসুম এলে সাগর থেকে লোনাপানি মেঘনায় ঢুকে পড়ে। দিনে দিনে লোনাপানি ওপরে উঠছে। এ বছর তজুমদ্দিন পর্যন্ত লোনা পানি উঠেছে। যে পর্যন্ত লোনা পানি এসেছে, সে অঞ্চলে বোরো আবাদ হচ্ছে না। ভোলায় প্রতিবছর ৬০-৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়। কৃষক আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। যদি পুরো ভোলার নদী-খালের পানি লোনা হয়ে যায়, তবে কী হবে!
ভোলা একটি দ্বীপ। পোকা ধরা লাউয়ের মতো। একসময় ব-দ্বীপ ছিল। ভাঙনে রূপ পাল্টেছে। এ দ্বীপের চারপাশে রয়েছে আরও ছোট ছোট দ্বীপ। এগুলোকে লোকজন মাঝেরচর হিসেবে চেনে। তবে চরের সুন্দর সুন্দর নাম আছে। মধুপুর, গণেশপুর, হাজীপুর, চরনাসরিন, ভাষানচর, চরলক্ষ্মী, চরনাজিমুদ্দিনসহ আরও কত...। হিসাবে দেখা যায়, এ রকম চরের সংখ্যা ৫০-এর কাছাকাছি। চরের কোথাও ঘনবসতি, কোথাও সবুজ ফসল, আবার কোথাও শাঁসমূলীয় উদ্ভিদ। তবে ভোলা-দৌলতখান ও বোরহানউদ্দিনের চরাঞ্চলে গাছ নেই, কেমন ফাঁকা ফাঁকা। প্রচণ্ড রোদে ছায়ায় দাঁড়ানোর মতো কোনো গাছ নেই। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে জেলের নৌকা বাঁধার কোনো গাছ নেই। চর কুকরি-মুকরি ও মনপুরা বনে দেখেছি, বনের ভেতর হাজার হাজার দেশি পাখি বসত করে। ওরা খেতের ফসল থেকে কৃষকের ধান চুরি করে খেয়ে পেট ভরে। আর সন্ধ্যায় পাশের বনের গাছে করে রাতযাপন। গণেশপুর-কাচিয়া চরেও দেখেছি, হাজার হাজার পাখি সারা দিন খাদ্য খোঁটে। সন্ধ্যায় ফেরে নিরাপদে, যেখানে গাছ আছে, আছে বন। বনহীন, গাছহীন চরের পাখিও চায়, চরে বনায়ন হোক!
১৯৭০-এর ভয়াল ১২ নভেম্বর। জীবন হারায় উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ। তখন বনায়ন বলে কিছু ছিল না। ১৯৭৩ সালে উপকূলীয় অঞ্চলে শুরু হয় ম্যানগ্রোভ বনায়ন। বর্তমানে ম্যানগ্রোভ বনায়নের পরিমাণ এক লাখ ২৩ হাজার একর, যা প্রয়োজনের তিন ভাগের এক ভাগ। আরও গাছ চাই, চাই কৃষকের নিশ্চয়তা। এ জন্য ভোলা নতুন বাজার চত্বরে সপ্তাহব্যাপী (৪-১০ জুলাই) হয়েছিল বৃক্ষ ও কৃষিমেলা। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল, ‘সবুজ নগর সবুজ দেশ, বদলে দেবে বাংলাদেশ’ ও ‘দেশি ফলে বেশি লাভ, খাদ্য পুষ্টির নেই অভাব’।
মেলায় ছিল ২৫টি স্টল। স্টলে দর্শনার্থীদের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের লোকজন বোঝাচ্ছেন, ‘বীজ অঙ্কুরিত হবে কি হবে না, তার পরীক্ষা’, ‘শীতে দ্রুত বীজ অঙ্কুরিত করার পদ্ধতি’, ‘কীভাবে বীজ সংরক্ষণ করবেন’, ‘ঝড়-জলোচ্ছ্বাসেও বীজ যাতে নষ্ট না হয়’ সে পদ্ধতি, ‘রোগ ও পোকার আক্রমণে জৈব বালাইনাশকের ব্যবহার’, ‘উপকারী পোকা চেনার উপায় ও সংরক্ষণপদ্ধতি’, ‘কীটনাশক ব্যবহার না করে কীভাবে ক্ষতিকারক পোকা ধ্বংস করা যায়’, ‘রাসায়নিক সার ব্যবহার না করে কীভাবে জমির দুর্বলতা কাটানো যায়’ ইত্যাদি।
মেলায় প্রতিদিন শত শত মানুষ এসেছে। যাওয়ার সময় গাছ কিনেছে। তারা সচেতন। কিন্তু যে মানুষ অসচেতন, ভোলা শহরে আসার সুযোগ পেল না, তাদের কী হবে? তারা কি অসচেতন থেকে যাবে! নাট্যকর্মী বাহাউদ্দিন বললেন, ‘এ ধরনের ফলদ ও বনজ বৃক্ষের মেলা প্রতিটি ইউনিয়নে আয়োজন করা উচিত। শুধু মেলা করলেই হবে না। মেলায় একটি পরামর্শ কেন্দ্র থাকবে, যেখানে ইউনিয়নের প্রত্যেক কৃষকের সমস্যা শুনে পরামর্শ দেওয়া হবে। তবেই বাংলাদেশের প্রতিটি বাড়ি হয়ে উঠবে একটি খামার। প্রতিটি বাড়িই খাদ্যে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে।’

No comments

Powered by Blogger.