কপোতাক্ষ অববাহিকার জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধানে কয়েকটি প্রস্তাব by এস এম আতিয়ার রহমান

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা মরা কপোতাক্ষ নদ নিয়ে। ইতিহাসপ্রসিদ্ধ এ নদের ভূমিকা আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির পাশাপাশি ভৌগোলিক, আর্থ-সামাজিক এবং পরিবেশ ও প্রতিবেশগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাতটি জেলার ৩৫টি উপজেলার এক কোটি মানুষ এ নদের অববাহিকায় বসবাস করে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ নদের প্রভাব তাদের জীবনধারার ওপর প্রভাব বিস্তার করে আছে।


এক কথায় বলা যায়, কপোতাক্ষ নদ হচ্ছে এ অববাহিকার কোটি মানুষের জীবন-মরণ সমস্যা। ভরাট বা মরা কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসনের ওপর নির্ভর করছে এ অববাহিকার মানুষের সুখ-দুঃখ, সমৃদ্ধি-প্রবৃদ্ধি। বলা চলে, কপোতাক্ষ বাঁচলে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন বাঁচবে। কেবল এ অববাহিকার জনপদই নয়, দেশের অর্থনীতিতেও তা গতিসঞ্চারকের ভূমিকা পালন করতে পারবে। এর প্রধানতম কারণ হচ্ছে, কপোতাক্ষ অববাহিকা হচ্ছে কৃষির অত্যন্ত সমৃদ্ধ সুফলা এলাকা। ধান, পাট, আখসহ যাবতীয় অর্থকরী ফসল, শাকসবজি, আম, কাঁঠালসহ উৎকৃষ্ট ফলমূলের উৎপাদনস্থল এই অববাহিকা। এ এলাকার মাটি ও পানির গুণে উৎপাদিত কৃষিপণ্য, মৎস্য_এমনকি খাসির মাংস এতটাই সুস্বাদু ছিল যে অতীতে কলকাতা নগরীর অন্যতম আকর্ষণ ছিল এ অববাহিকার এসব পণ্য। কলকাতার ডাব আর নারিকেলের ৫০ ভাগ চাহিদা পূরণ করত খুলনা-সাতক্ষীরা উপকূলীয় এলাকা। আর তাই কপোতাক্ষ দিয়ে এক সপ্তাহে কমপক্ষে দেড় থেকে ২০০ বড় বাণিজ্য নৌকা (গয়নার নৌকা) কলকাতায় বাণিজ্যে যাতায়াত করত। চলত লঞ্চ-স্টিমার। আর তাই তো মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর কাব্যে এ নদকে 'দুগ্ধ স্রোতস্বিনী'রূপে আখ্যায়িত করেছেন।
কপোতাক্ষ নদের নামকরণের আদি তথ্য এখন বিস্মৃতপ্রায়। কে কবে এ নদের নাম কপোতাক্ষ রেখেছিল বা কিভাবে এ নাম হলো, তার হদিস পাওয়া দুষ্কর। তবে কপোতাক্ষের পানি কবুতরের চোখের মতো স্বচ্ছ-সলিল ছিল বলেই নাকি এ নদের নাম কপোতযুক্ত আক্ষি=কপোতাক্ষি=কপোতাক্ষ হয়েছে_এমনটিই বিধৃত বা জনশ্রুতি আছে। সে যা-ই হোক, কপোতাক্ষের সেই যৌবন নেই, নেই সেই স্রোতস্বিনী রূপ। এমনকি অনেক জায়গায় নেই নদের মূল প্রশস্ত চরটুকুও। এখন কপোতাক্ষ কেবলই স্মৃতি। আর মরা কপোতাক্ষ এ অববাহিকার মানুষের চরম দুর্গতির কারণ। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত যে নদকে 'দুগ্ধ স্রোতস্বিনী' নামে আখ্যায়িত করেন, সে নদের এই চরম দুরবস্থা, এমনকি অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার পেছনে মূল কারণ উজান থেকে পানির স্রোত ভাটিমুখী না হওয়া, পলি ভরাট এবং চর সৃষ্টি হলেই তা দখল, ভরাট এবং খাস দেখিয়ে অদূরদর্শী, উপজেলার এক শ্রেণীর সংশ্লিষ্ট ঘুষখোর সরকারি কর্মচারী কর্তৃক বরাদ্দ প্রদান। এসব ভরাট জমিতে চাষবাসের নামে স্থায়ী অবকাঠামো গড়ে তুলে কপোতাক্ষের মূল অংশকে গ্রাস করে ফেলা হয়েছে ধীরে ধীরে। অথচ কপোতাক্ষ যে গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রাণপ্রবাহ, যা আটকে গেলে কেবল এ নদই মৃত হবে তা নয়; এ জনপদও বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়তে পারে_এ বিষয়টি এত দিন আমাদের মাথায় ঢোকেনি। কপোতাক্ষ দখল, ভরাট ও এর বুকে অবৈধ অবকাঠামো গড়ে তুলে দ্রুত সুদীর্ঘ এ নদকে শেষ করে দিতে যে মচ্ছব গত দুই দশক ধরে চলেছে অবলীলাক্রমে; এখন তার ফলে সেই স্বার্থান্বেষী শ্রেণী নয়, বরং হাজার হাজার সাধারণ মানুষ স্থায়ী দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। কৃষি প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা সমৃদ্ধ সেই জনপদ এখন বানভাসি, জলাবদ্ধতার এক চিত্র; যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। হাজার হাজার মানুষের স্বপ্ন ভেঙে গেছে। তাদের শেষ সম্বলটুকুও নেই। সমৃদ্ধ কৃষক পরিবার, যারা শ্রম দিয়ে সোনার ফসল ফলাত, সে ক্ষেতে এখন পানি আর পানি। চোখের সামনেই যেন সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। পাঁচ-সাত বছর আগে কেবল বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতার কারণে আমন ফসল মারা যেত। এখন আউশ, আমন, বোরো_তিন ফসলই হচ্ছে না। ফলে কোনো রকম টিকে থাকার আর পথ দেখছে না এ অববাহিকার মানুষ। কেবল কপোতাক্ষ নয়, এ অবস্থা দেশের বেশির ভাগ নদ-নদীর। তবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সমস্যা একটু ব্যতিক্রমধর্মী। এ এলাকার নদ-নদীর প্রধানতম সমস্যা এখন পলি ভরাট। ওপর থেকে পানি প্রবাহ না থাকায় দ্রুত পলি ভরাট হয়ে নাব্য হারাচ্ছে, মরে যাচ্ছে অসংখ্য নদী। প্রকৃতির এ রুদ্ররোষের সঙ্গে আমাদের কিছুটা কৌশল ও ব্যবস্থা গ্রহণও জরুরি ছিল। কিন্তু তা না করে ভূমিহীনদের নামে এসব ভরাট নদ-নদী বরাদ্দ দেওয়ার সময় ভবিষ্যৎ প্রয়োজনটুকু মাথায় না রেখে একেবারে ভরাট নদীর মাঝখানটুকুও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। ফলে এসব ভরাট নদীর মাঝখানেই উঠছে ঘরবাড়ি ও বৃক্ষরাজি। কোনো প্রয়োজনে পানি নিষ্কাশনের পথটুকুও রাখা হচ্ছে না। ডুমুরিয়া, কেশবপুর, মনিরামপুর, ফুলতলা ও অভয়নগরের অংশ নিয়ে বিলডাকাতিয়ার জলাবদ্ধতা সমস্যা প্রায় দুই দশক ধরে বিরাজমান ছিল। দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল তখন বিলডাকাতিয়ার জলাবদ্ধতা সমস্যা। এখানেও কপোতাক্ষের মতো নদী পলি ভরাট হয়ে যায়। মূল নদী হামকুড়া ভরাট হয়ে পানি নির্গমন বা নিষ্কাশনের প্রধান পথ রুদ্ধ হয়ে স্থায়ী জলাবদ্ধতা সমস্যার সৃষ্টি করে। দেখা যায়, যতটা তাড়াতাড়ি না হামকুড়া নদী ভরাট হয়েছিল, তার চেয়ে তাড়াহুড়ো করে খাসজমি দেখিয়ে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বেশি। আর এ খাসজমি সংশ্লিষ্ট অফিসের লোক বেনামে, অবৈধ অর্থে আত্মীয়-স্বজন ও বিত্তবানের ছেলেমেয়ের নামে করা হয়েছে। প্রকৃত ভূমিহীনরা পেয়েছে কম। ফলে হামকুড়া নদী অচিরেই শেষ হয়ে যায়। হামকুড়া নদী এবং তার নিচের অংশে ভদ্রা, শোভনা নদীর বিষয়ও যদি স্থায়ী বরাদ্দ দেওয়ার আগে মাঝামাঝি ২০০-৩০০ ফুট নির্দিষ্ট করে রাখা হতো এবং কৈয়া নদীর মতো একমুখী পানি নিষ্কাশন সুবিধা সৃষ্টি করা যেত, তবে মূল ডুমুরিয়া উপজেলা এবং আশপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল যে স্থায়ী জলাবদ্ধতা গ্রাস করার পথে এগোচ্ছে, তা রোধ করা সম্ভব হতো। এমনকি কৈয়া নদীতে যেমন নৌকা চলে; হামকুড়া, ভদ্রা ও শোভনা নদীতেও এমন অবস্থা তৈরি করা সম্ভব ছিল। কিন্তু ভরাট নদ-নদী, খাল-বিল দ্রুত বরাদ্দ দিয়ে দেশে সে ব্যবস্থার আর কোনো সুযোগ রাখা হচ্ছে না। ফলে কপোতাক্ষের মতো হাজারো সমস্যা আমরা নিজেরা ডেকে আনছি। তাই সময় এসেছে, ভরাট নদ-নদী স্থায়ী বরাদ্দ দেওয়ার আগে ভবিষ্যৎ প্রয়োজন বিবেচনার। কপোতাক্ষ সমস্যার সমাধানে এখন কৈয়া ক্লোজারের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেতে পারে। ২৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ কপোতাক্ষ নদকে দেশের একটি মেগা পুনঃ খনন প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করে প্রথমত এর পুনরুদ্ধার, পুনঃ খনন এবং শেষদিকে এক বা একাধিক ক্লোজার নির্মাণ করা যেতে পারে। সম্ভাব্যতা যাচাই করে এমন স্থানে ক্লোজার করা যেতে পারে, যেখান থেকে বছরের চার-পাঁচ মাসের অতিরিক্ত বৃষ্টি বা বানের পানি নামতে থাকবে। জোয়ারের পানি উঠবে না। এ নদের উৎস গড়াই থেকে মিষ্টি পানির প্রবাহ এই কপোতাক্ষ দিয়ে বছরে অন্তত পাঁচ-ছয় মাস সুন্দরবনে পতিত হলে এ বনের ১৫-২০ শতাংশ পুনর্জাগরিত হবে, পাবে মিষ্টি পানির প্রবাহ ও সেই সঙ্গে নিউট্রিয়েন্ট। ব্যাপক পুনঃ খননের জন্য ২৪০ কিলোমিটারের কপোতাক্ষ নদকে প্রতি কিলোমিটারে পাঁচ-দশ হাজার শ্রমিক দিয়ে শুষ্ক মৌসুমের মাঘ-ফাল্গুন-চৈত্র_এ তিন মাস একনাগাড়ে হাতে ও ঝুড়িতে খনন, এর মাটি দিয়ে দুই ধারে স্থায়ী রাস্তা ও কালভার্ট, স্লুইসগেট নির্মাণের মাধ্যমে নতুন চলাচলের ২৮০ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি হবে; যেমন কৈয়া নদীর দুই ধারে ওয়াপদা বাঁধ রয়েছে। প্রয়োজনে রাস্তা তৈরিতে স্ক্যাভেটর মেশিন ও রুলারসহ অন্যান্য সরঞ্জাম ব্যবহার এবং এক-দুই বছর পর রাস্তা পাকা করা যেতে পারে। কপোতাক্ষ সমস্যাটি সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করে প্রয়োজনে বিদেশি প্রকল্পের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে; যেমনটি করা হয়েছিল বিলডাকাতিয়ার ক্ষেত্রে। তবে কপোতাক্ষ সমস্যার সমাধান না হলে এ অববাহিকার বিস্তীর্ণ জনপদ বাসযোগ্যতা হারাবে, তা এখনই অনুমেয়। এ বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, একনেকে কপোতাক্ষ খননে ২৬১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পাস হয়েছে। এখন প্রত্যাশা, আগামী শুষ্ক মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যাতে এ প্রকল্পের কাজ শুরু করা যায়। এ ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব বা দীর্ঘসূত্রতার অবকাশ নেই। কারণ শুষ্ক মৌসুমে প্রকল্পের ৯০ ভাগ কাজ শেষ করতে না পারলে আবার ভোগান্তি নেমে আসবে সামনের বর্ষা মৌসুমে। তাই পূর্বপ্রস্তুতি বা কার্যক্রম এখনই শুরু হোক, যাতে শুষ্ক মৌসুমে পুরোদমে কাজ করে প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জিত হয় তথা সাধারণ মানুষ জলাবদ্ধতা সমস্যার এই চরম ভোগান্তি থেকে মুক্তি পায়। আবার তারা বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন দেখে সবুজ প্রান্তরে সোনালি ফসলের।

লেখক : উপ-পরিচালক, জনসংযোগ ও প্রকাশনা বিভাগ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। arahman.ku@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.