সময়ের প্রতিধ্বনি-শিরশ্ছেদ মানবতাবিরোধী by মোস্তফা কামাল

০০৪ সালে পেশাগত কাজে পাকিস্তান সফরে গিয়েছিলাম। তখন নিজের আগ্রহেই পাকিস্তানের নর্থইস্টার্ন প্রদেশে আফগানিস্তান সীমান্ত অঞ্চলে গিয়েছিলাম। ওই অঞ্চলটি পাকিস্তানের সামরিক ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। আফগানিস্তানের কান্দাহার প্রদেশ বরাবর পাকিস্তানের খাইজার এজেন্সি। এজেন্সিতে পাঠান মুসলিম সম্প্রদায়ের বসবাস। পাকিস্তানে পাঠানদের বলা হয় গোঁড়া মুসলিম। সেখানে গিয়ে দেখলাম, প্রতিটি মানুষের হাতে অস্ত্র। কারো হাতে কালাশনিকভ,


কারো হাতে চাইনিজ পিস্তলসহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র। এসব দেখে রীতিমতো ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়লাম। বিস্ময়ের সঙ্গে আমার সফরসঙ্গী পাকিস্তানি সাংবাদিক খুদা ইয়ার খানের কাছে জানতে চাই, এ কী! আমাকে কোথায় নিয়ে এলেন! সবার হাতে হাতে অস্ত্র, বিষয়টা কী!
খুদা ইয়ার খান আমাকে আশ্বস্ত করে বললেন, ভয় নেই। আপনাকে কিছু করবে না।
তারপর তিনি খাইবার এজেন্সির যুবক আফ্রিদির কাছে নিয়ে গেলেন। সম্ভবত ছেলেটি তাঁর পূর্বপরিচিতি। তাঁর হাতেও ছিল একটি কালাশনিকভ। তাঁর ওষুধের দোকানে আরো কয়েকটি কালাশনিকভ দেখা গেল। আমার ভেতরে আতঙ্ক আরো বাড়তে লাগল। আমি ভয়ে-আতঙ্কে আফ্রিদির কাছে জানতে চাইলাম, আপনাদের হাতে হাতে অস্ত্র! কারণটা কী?
আফ্রিদি বললেন, এখানে খুনের বদলা খুন। এটাই এখানকার আইন। ধরুন আমার পরিবারের কোনো সদস্যকে অন্য পরিবারের কেউ হত্যা করল, তাহলে আমিও ওই পরিবারের সেই হত্যাকারীকে অথবা হত্যাকারী পালিয়ে গেলে তাঁর ভাই-বোন, মা-বাবা যাকেই পাওয়া যাবে, তাকেই হত্যা করব। এসব করতে গিয়ে পরিবারে পরিবারে প্রায়ই খুনোখুনি হয়। খুনোখুনিতে কখনো কখনো পুরো পরিবার নিঃশেষ হয়ে যায়।
কথাগুলো সত্যিই বিস্ময়কর মনে হলো। এটাও কি এই সভ্য দুনিয়ায় সম্ভব? তারপর আবার প্রশ্ন করলাম, খুনোখুনির বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন? এটা কি সমর্থন করেন?
আফ্রিদি বললেন, সমর্থন করি না। কিন্তু কিছুই করার নেই। দীর্ঘদিন ধরে চলমান বিধানকে তো আমি আফ্রিদি বদলাতে পারব না। তবে এ ধরনের নির্মম আইন থাকা উচিত নয়।
সেই একই ধরনের আইন সৌদি আরবে। খুনের শাস্তি শিরশ্ছেদ! তা-ও আবার প্রকাশ্য দিবালোকে! সভ্য দুনিয়ায় মধ্যযুগীয় এই আইন বলবৎ থাকে কী করে, তা কোনোভাবেই উপলব্ধি করতে পারছি না। তবে এ কথার অর্থ এই নয় যে আমরা হত্যাকারীর পক্ষে যুক্তি উপস্থাপনের চেষ্টা করছি। অপরাধীর শাস্তি হোক_এটা সবাই চায়। কিন্তু সেই শাস্তি যদি হয় বর্বরোচিত! তাহলে নিশ্চয়ই এ যুগে সেটা কেউ সমর্থন করবে না। করার কথা নয়।
বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হত্যাকারীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে। ফায়ারিং স্কোয়াডেও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিধান রয়েছে কোথাও কোথাও। সৌদি আরব তথা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রকাশ্য দিবালোকে শিরশ্ছেদের বিধান রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশ এই বিধান রহিত করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিধান চালু করেছে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো হত্যাকারীর বিচার কী হবে সে বিষয়ে বিকল্প কিছু প্রস্তাব দিয়েছে। প্রস্তাবগুলো হচ্ছে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, নির্জন কোনো দ্বীপপুঞ্জে নিঃসঙ্গ রাখা প্রভৃতি। উন্নত দেশগুলোও অবশ্য অনেক আগেই হত্যাকারীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারার পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান চালু করে। এ ক্ষেত্রে হত্যাকারীকে মৃত্যু পর্যন্ত জেলেই কাটাতে হয়। ফ্রান্স, নরওয়েসহ ইউরোপের অধিকাংশ দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের অনেক স্টেটে ফাঁসির পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
সৌদি আরব মধ্যযুগের সেই পুরনো বিধান অনুযায়ী গত শুক্রবার প্রকাশ্য দিবালোকে আট বাংলাদেশি শ্রমিকের শিরশ্ছেদ করেছে। অভিযোগ করা হয়, ২০০৭ সালে বাংলাদেশি ফারুক, মতিয়ার, মাসুদ হোসেন, সুমন, শফিক, মামুন, সুমন মিয়া ও আবুল হোসেন নাকি সৌদি আরবে একটি দোকানে ডাকাতি করেছিলেন। তখন তাঁরা জনৈক মিসরীয়কে হত্যা করেন।
অভিযোগের ভিত্তি কতটা মজবুত তা আমরা জানি না। আমরা ধরে নিচ্ছি, অভিযোগ পুরোপুরি সত্য। কিন্তু অভিযুক্তরা আত্মপক্ষ সমর্থনের যথেষ্ট সুযোগ পাননি। অভিযুক্তদের পক্ষে আইনজীবী দেওয়া হলেও আদালতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের তেমন সুযোগ দেওয়া হয়নি। বলতে গেলে, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে একতরফা রায় হয়েছে। রায়ের পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আবেদন করেছিলেন। কিন্তু সৌদি সরকার বাংলাদেশের অনুরোধ রাখেনি। লাশও ফেরত দেয়নি। বাংলাদেশের প্রতি সৌদি সরকারের এ কেমন আচরণ?
রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্র জানিয়েছে, আরো পাঁচ বাংলাদেশির ঘাড়ে শিরশ্ছেদের খৰ। তাঁদের ব্যাপারেও ক্ষমার আবেদন করা হয় দূতাবাসের মাধ্যমে। কিন্তু সৌদি কর্তৃপক্ষের কোনো সাড়া মেলেনি। আসলে তারা বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধের বিষয়টি আমলেই নিচ্ছে না। এর নেপথ্যে অন্য কোনো কারণ আছে কি না আমাদের জানা নেই।
আমরা জানি, বাংলাদেশের সঙ্গে সৌদি আরবের কূটনৈতিক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামাবাদে ওআইসির বিশেষ সম্মেলনে যোগ দিয়ে মুসলিম উম্মাহর সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার উদ্যোগ নেন। তখন কোনো কোনো দেশের আপত্তি থাকলেও বঙ্গবন্ধু তা তোয়াক্কা করেননি। ১৯৭৬ সাল থেকে সৌদি আরব বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ শুরু করে। এখনো প্রতিবছর দেড় থেকে দুই লাখ বাংলাদেশি সৌদি আরব যাচ্ছেন। সেখানে বর্তমানে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে ৫৩ লাখ বাংলাদেশি বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। তাঁরা সৌদি আরবের অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখছেন।
শুধু তা-ই নয়, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে যে কয়টি সরকার (কী সামরিক কী বেসামরিক) ক্ষমতাসীন হয়েছে, প্রতিটি সরকারই কিন্তু সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দুটি ধারার রাজনৈতিক দল হলেও সৌদি আরব নীতিতে তাদের মধ্যে কোনো মতপার্থক্য নেই। শেখ হাসিনা কিংবা খালেদা জিয়া ক্ষমতাসীন হওয়ার পর প্রথম বিদেশ সফর শুরু করেন সৌদি আরব থেকে। সৌদি বাদশাহর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করে তাঁর দোয়া ও আশীর্বাদ নিয়ে আসেন। ধর্মীয় কারণেই বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকার সৌদি বাদশাহর আশীর্বাদকে মূল্য দেয়। মুসলিম ভ্রাতৃপ্রতিম সৌদি আরবের প্রতি বাংলাদেশিদের আবেগ, অনুভূতি এবং সৌদি আরবের উন্নয়ন-প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশিদের অবদানের বিষয়টি সৌদি সরকারের বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
লাখ লাখ বাংলাদেশির মধ্যে কিছু কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকতেই পারে। ডাকাতির ঘটনায় আট বাংলাদেশির শিরশ্ছেদ হওয়ার কথা নয়। আবার আটজন মিলে যে একজনকে হত্যা করেছেন, সেটাই প্রমাণিত সত্য নয়। তাই আটজনের শিরশ্ছেদ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে বিচারিক প্রক্রিয়া নিয়েও। বিচারিক প্রক্রিয়ার পুরো কার্যক্রম পরিচালিত হয় আরবি ভাষায়। ভাষাগত জটিলতার কারণে শুধু বাংলাদেশি নন, অন্যান্য দেশের প্রবাসীদের সুবিচার পাওয়া অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে বিচারিক প্রক্রিয়া কতটা স্বচ্ছ ছিল এবং ভাষাগত জটিলতা এ ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল কি না সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখা দরকার। আর বিষয়টি নিয়ে সৌদি আরব সরকার চিন্তাভাবনা করতে পারে।
আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। সৌদি আরবের মক্কায় পবিত্র ক্বাবা শরিফ আল্লাহর ঘর। বিশ্বের মুসলমানদের কেবলা। তা ছাড়া আমাদের মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মস্থান। সংগত কারণেই দেশটি মুসলমানদের তীর্থস্থান। প্রতিবছর সারা পৃথিবী থেকে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান হজ করতে সৌদি আরবে যান। ইতিমধ্যেই সেখানে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলি্ল হজ পালনের জন্য উপস্থিত হয়েছেন। সেই পবিত্র ভূমিতে মানবতাবিরোধী শিরশ্ছেদের ঘটনা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এ ধরনের শাস্তির বিধান ছিল আদিম এবং মধ্যযুগে। একবিংশ শতাব্দীতে এ ধরনের বিধান থাকতে পারে না।
আমরা যদি ইসলাম ধর্মের কথা বলি, তাহলেও বলব, ইসলাম তো মানবতার ধর্ম। সেই ধর্মের দোহাই দিয়ে মানবতাবিরোধী কাজ চলতে পারে না। মানবতাবিরোধী যেকোনো আইনের আমরা ঘোর বিরোধী।
একই সঙ্গে বলতে চাই, শুধু সৌদি আরব নয়, সারা বিশ্বেই বাংলাদেশিরা ছড়িয়ে আছেন। সরকারি-বেসরকারি হিসাবে প্রায় দুই কোটি বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রবাস জীবন যাপন করছেন। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশিদের এমন কোনো কাজ করা উচিত নয়, যাতে দেশের ভাবমূর্তির ওপর আঘাত আসে।
আমরা বিভিন্ন সময় দেখেছি, বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের অন্যায় ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ সরকারের কাছে আসে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই থেকে শুরু করে মারামারি, খুনোখুনি পর্যন্ত করছেন কিছু বাংলাদেশি। তাঁদের কারণে অন্য সব প্রবাসীকে হেয় হতে হয়। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অভিযোগ পাওয়ার পরও সরকারের অনেক সময় কিছু করার থাকে না। দূতাবাস থেকে এসব বিষয়ে উদ্যোগ নিলেও কোনো ফল হয় না। প্রবাসী বাংলাদেশিদের সচেতনতা ছাড়া এ সমস্যার দ্রুত কোনো সমাধান সম্ভব নয়।
তবে কর্মী হিসেবে যাঁদের বিদেশে পাঠানো হয়, তাঁদের সচেতনতা বাড়ানো উচিত। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো এ দায়িত্ব পালন করতে পারে। বিদেশে কর্মী পাঠানোর সময় তাঁদের প্রাথমিক কিছু প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট দেশের আইন-কানুন ও বিধিবিধান সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দেওয়া উচিত। এমনকি কর্মীর অভিভাবকরাও বিষয়টি নিয়ে ভাবতে পারেন। আপনার যে ছেলেটিকে বিদেশে পাঠাচ্ছেন, দেশে তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ আছে কি না, কোনো ধরনের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিল কি না, তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা আছে কি না_এসব অভিযোগ থাকলে তাকে বিদেশে না পাঠানোই ভালো। কারণ আপনার এক ছেলের কারণে সবার মাথা অবনত হবে এবং দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে_তা হয় না।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mkamal1970@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.