ভিন্নমত-শেয়ারবাজার যখন পড়ে, তখন কোনো যুক্তি মানে না by আবু আহমেদ

মাদের শেয়ারবাজারটা অনবরত পড়ছেই। তবে পড়াটা একপর্যায়ে অবশ্যই থেমে যাবে। কিন্তু সমস্যা হলো, বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী, যাদের বড় অংশই আবার নতুন, তারা পড়াটাকে মনস্তাত্তি্বকভাবে গ্রহণ করতে পারছে না। তারাই বেশি হা-হুতাশ করে পড়তে দেখলে এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয় এই ভেবে যে, বাকি টাকাটাও তারা হারাবে কি? কিন্তু সত্য হলো, তারা বা সবাই ইতিমধ্যে পুঁজির বিরাট অংশ হারিয়েছে। আরো হারাতে পারে।


তবে সেই বাকি হারাটা হয়তো অবশ্যই হবে। একটি কথা আমাদের বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী জানে না_শেয়ারবাজার পড়ার সময় কোনো যুক্তি মানে না। আবার ওঠার সময়ও কোনো যুক্তি মানে না। ২০০৮ থেকে ২০১০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত শেয়ারবাজার যখন লাফিয়ে লাফিয়ে উঠল, তখন কি কোনো যুক্তি মেনেছিল? ওই লম্ফনের পেছনে কারণ কী ছিল? ১. সুদের হার অতি নিম্নে ছিল_বর্তমানের তুলনায় অর্ধেক। সুতরাং অনেক লোক শেয়ারবাজারের যৎসামান্য ডিভিডেন্ড এবং আশাকৃত ভালো ক্যাপিটাল গেইনকে সুদে টাকা খাটানোর চেয়ে বিনিয়োগের জন্য ভালো ক্ষেত্র বলে মনে করল। আমাদের অনেক বিনিয়োগকারীই জানে না, বাজার-সুদের হারের সঙ্গে শেয়ারের মূল্যের একটা বৈপরীত্যের সম্পর্ক আছে। এখন বা গত এক বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক তার মুদ্রানীতি পরিবর্তন করেছে এবং টাইট মুদ্রানীতির অধীনে অর্থ প্রাপ্তি কঠিন করেছে। ফলে অর্থের বাজারে এক ধরনের তারল্য সংকট বিরাজ করছে এবং সুদের হার বেড়েছে। টাইট মুদ্রানীতি গ্রহণ করে সুদের হারকে ঊর্ধ্বমূল্য করার মাধ্যমে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ভালো হচ্ছে কি না, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। তবে আমার মতো বিশ্লেষক এই নীতির সমর্থক নন। আমি মনে করি, বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নীতি শুধু শেয়ারবাজারকেই আঘাত করছে না, এই নীতি অর্থনীতিতে বিনিয়োগেরও বিরোধী এবং শেষ বিচারে ও কাঙ্ক্ষিত জিডিপি প্রবৃদ্ধিরও বিরোধী। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক আপাতত আমাদের এই যুক্তি গ্রহণ করতে রাজি নয়। তারা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্দেশিত ছক মতে মুদ্রানীতি গ্রহণ করতে যেন বদ্ধপরিকর। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, আজ শেয়ারবাজারে যে খরা তথা মন্দা যাচ্ছে, তার মূল কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসৃত বর্তমান মুদ্রানীতি। কেউ যদি ব্যাংকে এক বছরের জন্য স্থায়ী আমানত রেখে ১৪ শতাংশ সুদ পায়, সে কি এ মুহূর্তে_যেখানে ক্যাপিটাল গেইনের সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ_শেয়ারবাজারে টাকা খাটাবে? সে জন্যই বলছিলাম, বাজার-সুদের হার এবং শেয়ারবাজারে অর্থ প্রবাহের মধ্যে বৈপরীত্য সম্পর্ক আছে। দুঃখ হলো, এটা যেমন অনেক বিনিয়োগকারী বুঝতে অক্ষম, তেমনি সাংবাদিকদের মধ্যকার এক দলও। তারা শুধু খোঁজে_রেগুলেটর এসইসি এত কিছু করছে, তবু শেয়ারবাজার পড়ছে কেন? ২০০৮ থেকে ২০১০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত শেয়ারবাজারের ওই অভাবনীয় উত্থান ঘটল কেন? আমাদের অর্থনীতিতে দুধ-কলার নহর প্রবাহিত হচ্ছিল, না আমাদের তালিকাভুক্ত কম্পানিগুলো স্বর্ণের খনি আবিষ্কার করেছিল? শুধু সুদ কম ছিল বলেই কি ওই উত্থান ঘটেছিল? সুদের হার ওই উত্থানের জন্য আংশিক দায়ী ছিল। বাকিটা দায়ী ছিল শেয়ার হাউসগুলোর শত শত শাখা খুলে জেলা-উপজেলা পর্যন্ত তাদের কমিশন ব্যবসাকে সম্প্রসারণ করাটা। এর ফলে মনু মিয়ারা শেয়ারবাজারে এসে গেল। গোপালও হাই স্কুলের শিক্ষকতার ফাঁকে ফাঁকে শেয়ারবাজারের গ্রাহক হলো। আর মনু মিয়া দোকানের ঝুঁকির একটা অংশকে ব্রোকারেজ হাউসে বিনিয়োগ করে মিল্টনের কথায়। এখন মনু মিয়া বাজারে নেই, গোপালও নেই। মনু মিয়া হারিয়েছে তার দোকানের পুঁজি, আর গোপাল হারিয়েছে টিউশনি থেকে জমানো টাকা। মনু মিয়ার দোকানে মাল কমে গেছে। মনু মিয়া এখন সবাইকে বিনা মূল্যে চা খাওয়ায় না। তবে গোপালের টিউশনি ঠিকমতোই চলেছে। শুধু কয়েক বছর পিছিয়ে গেছে। তারা বাজারে প্রবেশ করেছে ২০১০ সালের জুনে। শেয়ারবাজারের জন্য অতি উত্তম সময়ে! শুরু হয়ে গেল নানা রকম শঙ্কা। বাজার পড়তে লাগল ১৫ নভেম্বর থেকে একটানা ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। প্রথম দিকে মনু মিয়া ও গোপাল কেউই লোকসান দিয়ে শেয়ার বেচতে চায়নি। পরে হতাশ হয়ে ২০১১ সালের মার্চে শেয়ারগুলো বেচল। ততক্ষণে পুঁজি ৪০ শতাংশ হয়ে গেছে। মনু মিয়া আর গোপালের বিনিয়োগবিদ্যা হলো শুধু শোনা কথা। অন্যরা আগে যেসব কথা বলত, সেগুলো শুনত এবং সেই অনুযায়ী কাজ করত। এই মনু মিয়া ও গোপাল হলো ২০০৯ ও ২০১০_এই দুই বছরে যে ১৫ লাখ মূলধন বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারে প্রবেশ করেছে, তাদের অন্যতম। তারা প্রবেশের পর শেয়ারের মূল্য সূচক দেড় বছরে দ্বিগুণ হলেও এটাও একটা ইতিহাস বটে। তবে কেউ সেই উত্থানকে থামাতে পারেনি। যারা থামাতে পারত, তারা থামায়নি। বরং তারা শুধু হাত দিয়েছে দিয়েছে। আর আজ রেগুলেটর তো অনেক মিটিং ও সিদ্ধান্ত দিচ্ছে শেয়ারবাজারকে চাঙ্গা করার জন্য, নিদেনপক্ষে ধরে রাখার জন্য। কিন্তু কোনো পদক্ষেপই কাজে আসছে না। কাজে আসছে না, তাই ইতিমধ্যে মনু মিয়া আর গোপালরা শেয়ারবাজার থেকে বেরিয়ে গেছে। সঙ্গে চলে গেছে তাদের টাকাও। আর আলতাফ সাহেবের মতো ৫০ কোটি টাকার বিনিয়োগকারী আরো ৫০ কোটি টাকা লাভ করে সেই ডিসেম্বরে বাজার ত্যাগ করেছেন। এরপর আর বাজারমুখী হননি। একদিন এসেছিলেন ব্রোকারেজ হাউসে। তবে শেয়ার কিনতে নয়, তামাশা দেখতে। তিনি ঘণ্টাখানেক থেকে বললেন, ব্রোকারেজ হাউসের চেয়ারগুলো খালি কেন? খালি কেন, সেটা তিনিও জানেন। তবে ওই জিজ্ঞাসা হলো ভেতরে তিরস্কার চেপে রেখে। যারা বোঝার, তারা তো বুঝেছে। তবু আলতাফ সাহেবকে ধন্যবাদ। তিনি অবস্থা থেকে বহু ফায়দা নিতে সক্ষম হয়েছেন। আমাদের বিনিয়োগকারীরা যখন শেয়ার ব্যবসায়ী হয়ে গেলেন, তখন আমাদের মতো অনেকের বুঝতে বাকি রইল না, এবার একটা অঘটন ঘটবে। এমন বাজারে ক্যাপিটাল গেইনস নেই। মানে, ওই ব্যবসা থেকে নিত্য লাভ নেই। সুতরাং সেসব ব্যবসায়ীও নেই। তারাও চলে গেছে, তাদের অর্থও চলে গেছে। নতুন অর্থ প্রবাহের সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। সুতরাং শেয়ারবাজার উঠবে কিভাবে? ৩৩ লাখের মধ্যে এখনো লেগে আছে তিন লাখ। তাদের অবস্থাও ভালো নয়। সে জন্যই এই পতন। আর সে জন্যই ডিএসইর টার্নওভার ৩০০ কোটি টাকা। এটা কত দিন চলে, কেউ বলতে পারবে না। তবে আপাতত চলবে।
যেহেতু পড়তি বাজারে ক্যাপিটাল গেইনস খুব একটা ঘটে না, সেহেতু এখন শেয়ার ব্যবসায়ীরা বাজারে নেই। ডিভিডেন্ড তাদের পোষায় না। আর সে জন্যই জুয়াড়িরাও বাজারে অনুপস্থিত। তাই গুজবও এখন কোনো কাজ করে না। গুজব শিল্পের এখন ভয়ানক দুর্দিন। আর মাঠে মারা পড়েছে সেসব উদ্যোক্তার ক্রুড প্ল্যান, যারা ১০ টাকার শেয়ার ২০০ টাকায় বেচার ফন্দি-ফিকির করছিল। ভাগ্যবান হলো সেসব উদ্যোক্তা, যারা ২০০৯-২০১০ সালে মনু মিয়া ও গোপালদের কাছে ১০ টাকার শেয়ার ২৫০ টাকায় বেচতে সক্ষম হয়েছিল। হায়রে সময়! তুমি আরেকটু অপেক্ষা করলে না কেন? কেন বাজারটার এত তাড়াতাড়ি পতন হলো! পতন হয়েছে তো বেশ হয়েছে। অন্তত মনু মিয়া ও গোপাল তো তাদের অর্ধেক পুঁজি বাঁচাতে পেরেছে। উত্থান আরো দীর্ঘমেয়াদি হলে সুনামিটা আরো প্রবল হতো।

লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.