সাদাকালো-যুদ্ধাপরাধের বিচার ও জামায়াতের নয়া কৌশল by আহমদ রফিক

যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবি করেছিল সেক্টর কমান্ডারদের ফোরাম। সেই সঙ্গে আরো অনেক ব্যক্তি ও সংগঠন; অনেক লেখালেখি দীর্ঘদিন ধরে। অবশেষে বর্তমান সরকারের শাসনামলে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু, ট্রাইব্যুনাল গঠন। অমনি উঠে এসেছে অনেক প্রশ্ন আইনি যৌক্তিকতা নিয়ে, বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে। বিএনপি-জামায়াত জোটের জামায়াতই শুধু নয়, বিএনপির নেতৃস্থানীয় কারো কারো মুখে শোনা গেছে অদ্ভুত সব কথা। অথচ বিএনপির স্থপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান একজন নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, জেড ফোর্সের প্রধান।


বিচারপ্রক্রিয়ার শুরুতে বিষয়টা ঘিরে যথেষ্ট আবেগ লক্ষ করা গিয়েছিল। যেমন পত্রপত্রিকায় লেখালেখিতে, তেমনি টিভি চ্যানেলের নানাবিধ প্রোগ্রামে। তেমনি আশপাশে কান পাতলে সাধারণ মানুষের মধ্যেও দেখা গেছে আবেগের প্রকাশ, অবিলম্বে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি। এখন আড়াই বছরে সব ঠাণ্ডা। সব ফ্রন্টেই হিমশীতলতা। বিলম্বিত তাল-লয় সংগীতে চলতে পারে, কিন্তু রাজনীতির জরুরি অঙ্গনে তা একেবারে অচল। তাই একটি দৈনিকের শিরোনামে আক্ষেপ : 'দেড় বছরেও বিচার শুরু হলো না।'
কেমন করে হবে? প্রধান কেঁৗসুলি বলেছেন, '৪০ বছর আগের অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া চলছে। অনেক পরিস্থিতিরই সৃষ্টি হয়, যখন কেঁৗসুলিদের কিছু করার থাকে না।' তাঁর বক্তব্য যথেষ্ট স্পষ্ট না হলেও এটুকু বুঝতে কষ্ট হয় না যে ৪০ বছর আগেকার বিষয়ের তথ্য-উপাত্ত-উপকরণ নিয়ে, প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য নিয়ে সম্ভবত যত সমস্যা। তখনই প্রশ্ন উঠতে পারে নান্দনিক ভঙ্গিতে : 'এত দিন কোথায় ছিলেন? অর্থাৎ হাওয়া গরম থাকাকালে, হাড়গোড়, সাক্ষ্যপ্রমাণ মাটিতে মিশে যাওয়ার আগে কেন বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হলো না?'
এ প্রশ্নের যথাযথ জবাব দিতে গেলে অনেক কালি খরচ করতে হবে, যা আদৌ সম্ভব নয়। কিছু অপ্রিয় সত্য বলতে হবে। তবে সম্ভব এটুকু বলা যে নানা রাজনৈতিক জটিলতায়, ইচ্ছা-অনিচ্ছার দোলায় বহুজনের আকাঙ্ক্ষিত বিচারপ্রক্রিয়াটি শুরু হয়নি, অথবা শুরু করা যায়নি। নব্বইয়ের দশকে নির্বাচিত প্রথম সরকারের আমলেও বিষয়টা আমলে আনা হয়নি, এমনকি পরবর্তী দুই সরকারের আমলেও এ বিষয়ে কোনো চেষ্টা বা সদিচ্ছা কোনোটাই দেখা যায়নি। কী বলা যাবে এ সম্পর্কে? অনিচ্ছা না রাজনীতির কূটনীতি? কিন্তু বছর দুই আগের হঠাৎ আবেগে বিষয়টা একেবারে সামনে চলে আসে, অন্তর্ভুক্ত হয় আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে এবং বিশেষ গুরুত্বে। পুরনো হিসাব-নিকাশ পাল্টে যায়।
ক্রমে যত আইনি জটিলতার প্রকাশ। আইনজীবী নই বলে ওই সবের সূক্ষ্ম জটিলতা দুর্বোধ্য। তবে এটুকু বোধ্য, যা আগে বলা হয়েছে_সময় বড় প্রতারক। তার পরও রয়েছে শব্দের তাৎপর্যগত রকমফের। প্রত্যক্ষ যুদ্ধাপরাধী অর্থাৎ পাকিস্তানি সেনারা তো সব হাওয়া যে যার আস্তানায়। আর দেশি রাজাকারকুলের যুদ্ধাপরাধ নিয়ে বোধ হয় সমস্যার জটিলতা এসে যাচ্ছে। অথচ সমস্যা ছিল না পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা (জেনোসাইড) নিয়ে।
বিদেশি পত্রপত্রিকায় অনেক লেখা হয়েছে একাত্তরে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর সংঘটিত গণহত্যা নিয়ে। বিদেশি সাংবাদিকরা এ দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে দিনের পর দিন পাকিস্তানি বর্বরতার লোমহর্ষক বিবরণ পত্রস্থ করেছেন। 'টাইম', 'নিউজউইক', 'নিউ ইয়র্ক টাইমস', 'ওয়াশিংটন পোস্ট' থেকে লন্ডনের 'টাইমস', 'ডেইলি টেলিগ্রাফ', 'গার্ডিয়ান' ইত্যাদি দৈনিক-সাপ্তাহিকে গণহত্যার অনেক সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। কোন্ আইনে এগুলোকে অস্বীকার করা যাবে? তা ছাড়া কিছুসংখ্যক স্থানীয় মানুষ এখনো বেঁচে আছেন, যাঁরা ওই ভয়াবহ নৃশংসতার সাক্ষী।
কিন্তু ওই যে বলেছি, পাকিস্তানি বর্বরগুলো হাতের নাগালে নেই। কিন্তু অনুপস্থিতিতেও তো বিচার চলে। তবে সূক্ষ্ম আইনি সমস্যা হয়তো আছে। তবে বিহারি ও বাঙালি রাজাকার, আলবদর-আলশামসের ঘাতক বাহিনীর নেতা-কর্মীরা সবাই বহাল তবিয়তে বাংলাদেশে বিরাজমান। আর তাদের কার্যকলাপের কিছু না কিছু প্রত্যক্ষ প্রমাণ এখনো বিদ্যমান। এরা ফারুক-রশিদের মতো স্বঘোচিত খুনি না হলেও একাত্তরের মাসগুলোতে পত্রপত্রিকায় বিবৃতির মাধ্যমেও পরোক্ষ খুনি, বেতারের প্রোগ্রামেও তেমন প্রমাণ ধরা রয়েছে।
যেমন বিদেশি পত্রপত্রিকায়, তেমনি স্থানীয় সাক্ষ্যে নারী নির্যাতনের ঘটনা নজিরবিহীন। আর এ ব্যাপারে প্রত্যক্ষ অপরাধী রাজাকার বাহিনীর সদস্য। এসবের প্রমাণ যে একেবারে নেই তা নয়। সব শেষে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে জামায়াত ও তাদের অঙ্গসংগঠন আলবদর, আলশামসের প্রত্যক্ষ ভূমিকা তো প্রমাণনির্ভর। এর পরও বর্তমান বিলম্বিত প্রক্রিয়ার কারণ বোঝা মুশকিল।
অবশ্য সমস্যাও আছে। আন্তর্জাতিক আইনি রীতিনীতি নামক জুজুর ভয়ে কি পিছিয়ে যাচ্ছে বিচারপ্রক্রিয়া এবং সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পিছু হঠা? যে তৎপরতা নিয়ে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তা এখন ঢিমেতালে চলছে। আর সে জন্যই মানুষের মনে সন্দেহ-সংশয়_এ বিচার শেষ হবে তো? অপরাধী শাস্তি পাবে তো? কারণ এ প্রক্রিয়া যত দেরি হবে, সুবিচারের সম্ভাবনা ততই দূরে সরে যাবে।
এমন এক নেতিবাচক আবহাওয়ার কারণেই বোধ হয় সরকার পক্ষের মুখপাত্র মাঝেমধ্যেই জনগণকে নিশ্চিন্ত করতে চান এই বলে যে, 'বাংলার মাটিতে ঘাতক দালালদের বিচার হবেই।' সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী ও উপদেষ্টা পরিষদের যৌথ সভায় শুরুতেই আমাদের আশ্বস্ত করেছেন এই বলে যে 'দেশের শান্তি ও গণতন্ত্রের স্বার্থে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হবেই।' আমরা তাঁর বক্তব্য সদর্থেই গ্রহণ করছি।
কিন্তু পরিস্থিতি এমনই এক পর্যায়ে যে অপরাধীকুল নিজেরাই যেন আগের মতো আর আতঙ্কের মানসিকতায় নেই। তাদের কথাবার্তায় তেমনই মনে হচ্ছে। রীতিনীতিগত জটিলতার কারণেই বোধ হয় যুদ্ধাপরাধ এখন মানবতাবিরোধী অপরাধের শাব্দিক ভাষ্যে রূপান্তরিত। বলতে হয়, শাব্দিক ভাষ্যে কী বা আসে-যায়। কারণ হত্যা, ধর্ষণ, অগি্নসংযোগ, নির্যাতন যেমন যুদ্ধাপরাধ হিসেবে পাকিস্তানি সেনাদের কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট; তেমনি সংশ্লিষ্ট রাজাকার, আলবদর প্রমুখ ঘাতক-দালালের ক্ষেত্রে। যুদ্ধাপরাধের উলি্লখিত বিষয়গুলো মানবতাবিরোধী অপরাধও বটে। রাজাকার, আলবদর প্রমুখ ঘাকত দলের সবাই সরাসরি যুদ্ধে, প্রত্যক্ষ যুদ্ধে সংশ্লিষ্ট না থাকায় মানবতাবিরোধী ওই সব অপরাধে তাদের বিচার সম্ভবত অপেক্ষাকৃত সহজ হতে পারে। হয়তো তাই মানবতাবিরোধী অপরাধ শিরোনামেই বিচারপ্রক্রিয়া চলছে।
যে নামেই হোক, মানুষ চাইছে অপরাধীদের শাস্তি। ইতিমধ্যে দলের চাঁই কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, শুরু হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহের মাধ্যমে চার্জ গঠনের সম্ভাব্য প্রক্রিয়া। ইতিপূর্বে জামায়াতের মধ্যবর্তী নেতৃত্ব গ্রেপ্তারকৃত নেতাদের খরচের খাতায় লিখে নতুন করে দল সংগঠিত করার চিন্তাভাবনা করেছিল। কিন্তু হঠাৎ কী এমন ঘটল যে 'বিচারের বিরুদ্ধে রাজপথে যাচ্ছে জামায়াত' অর্থাৎ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে যাচ্ছে। তাদের কি বিএনপির কাছ থেকে কোনো ধরনের আশ্বাস মিলেছে যে তারা এ ব্যাপারে জামায়াতকে সমর্থন জানাবে?
শুরুতে বিএনপির মনোভাব এ ব্যাপারে কিছুটা নেতিবাচকই ছিল। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ তথা যুদ্ধাপরাধ বলে কথা। যত দেরিই হোক, দেরিতে অপরাধ খারিজ হয়ে যায় না, বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধ-মানবতাবিরোধী অপরাধ। ইসরায়েল কত বছর পর নাৎসি ঘাতক আইখম্যানকে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ধরে এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিল এবং যথারীতি তার বিচার ও শাস্তি হয়েছিল। আর বাংলাদেশে তো মাত্র ৪০ বছরের অতীত ঘটনা।
আমার ধারণা, সম্প্রতি জামায়াত নেতারা বিচারপ্রক্রিয়ার ঢিলেঢালা ঠাণ্ডা মেজাজ দেখে কিছুটা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে। সে জন্য তারা নতুন করে রাজপথ গরম করার কথা ভাবতে শুরু করেছে। এমনকি কারাগারের বাইরে অবস্থানরত জামায়াত নেতাদের বিশ্বাস, বর্তমান সরকার তাদের শাসনকালে বিচার পর্ব যদিও বা শেষ করতে পারে, অপরাধের সাজা কার্যকর করতে পারবে না। এমন মতামতও উঠে আসছে যে জনগণ তাদের নেতাদের শাস্তি কার্যকর করতে দেবে না।
এতটা আত্মবিশ্বাস কোথা থেকে এল? বিএনপির আশ্বাস, নাকি সৌদি আরবের সমর্থন? অথবা মার্কিন লবির পরোক্ষ আশ্বাস? কারণ যা-ই হোক, পরিস্থিতির কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। ওই যে প্রবাদবাক্য 'ডাল মে কুছ কালা হ্যায়' এবং তা উভয়ত। অর্থাৎ বিচারপ্রক্রিয়ার জটিলতা এবং খুঁটির শক্তি। আর সে জন্যই তারা কি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের পক্ষপাতী এবং সেই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারের পক্ষে? যাতে অপরাধের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে তালগোল পাকানো যায়। সেই সঙ্গে রাজপথে হট্টগোল। একা এবং বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে।
কিন্তু জামায়াতের জানা দরকার যে এ বিষয়ে রাজপথে নেমে তারা বড় একটা সুবিধা করতে পারবে না, যেমন বিএনপি পারেনি তাদের নিজস্ব ইস্যুতে কোনো রকম সুবিধা আদায় করতে। অন্যদিকে জনতার সমর্থন? বাংলাদেশের অনেক পরিবার একাত্তরের বর্বরতার স্মৃতি বহন করছে। তাদের যন্ত্রণার অংশীদারের সংখ্যাও নেহাৎ কম নয়। সেখানে বিএনপির তৃণমূল স্তরেরও অনেকের দেখা মিলবে। কাজেই ব্যাপারটা এত সহজ নয়। গণরায় নিতে চাইলেও তা সুবিধাজনক হবে না তাদের জন্য।
তাই আমাদের দাবি, সরিসার মধ্যে যেন ভূত আশ্রয় নিতে না পারে। অপরাধ বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনাল যেন শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে দক্ষতার সঙ্গে বিচারপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে পারে। হয়তো একাধিক কারণে সব অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনা যাবে না, সে আক্ষেপ আমাদের থাকবেই। কিন্তু অপরাধী রাঘববোয়ালগুলোর বিচার ও শাস্তি বিধান করা গেলে অন্তত কিছুটা স্বস্তি মিলবে। আমাদের প্রত্যাশা, এমন একটি জাতীয় ইস্যুতে ট্রাইব্যুনাল ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা নিয়ে যুক্তিসংগত পথ ধরে গন্তব্যে পেঁৗছাবে। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে অর্থহীন করে তুলবে না। তবে ভালো হতো যদি শুরুতেই বিএনপির সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনায় বসে সমঝোতায় পেঁৗছানো যেত। এ বিষয়ে মীর শওকত আলীরা তখন বিচারের পক্ষে কঠিন অবস্থানে। তাতে কাজটা কিছু সহজ হতো। জামায়াতের এ বিষয়ে বিএনপির ঘাড়ে চাপা সহজ হতো না।

লেখক : রবীন্দ্র গবেষক, কবি, প্রাবন্ধিক ও ভাষাসংগ্রামী

No comments

Powered by Blogger.