দ্বীপচরের স্বপ্নহীন কিশোরীদের কথা by জাহিদ রহমান

দেশের উত্তরাঞ্চলে তিস্তাবক্ষে রয়েছে অসংখ্য দ্বীপচর। দ্বীপচরগুলোর নামগুলোও বাহারি এবং বৈচিত্র্যময়। কালিকাপুর, চর হলদিবাড়ী, চর পারুলিয়া, চর আরাজি, চর গোবর্ধন, চর কালিকাপুর, চর খারিয়া, চর ফলিমারী, চর হরিণছড়া, চর তালপট্টি, চর ডাওয়াবাড়ী, চর গুড্ডিবাড়ী এরকম আরও অনেক চর রয়েছে এখানে। একটু বাতাস উঠলেই তিস্তার পানি যেন হেসেখেলে দোল খায়। পানির এই দোল খাওয়ার দৃশ্য যে কোনো নাগরিকের হৃদয়ে
অন্যরকম অনুরণন তোলে। কিন্তু প্রকৃতির এই অপরূপতা চরের কিশোরীদের হৃদয়ে সেভাবে অনুরণন তোলে না, যতটা আগন্তুক নাগরিক হৃদয় উদ্বেলিত হয়। চরের হতদরিদ্র পরিবারের কিশোরীরা কিশোরী বা তরুণী হিসেবে পূর্ণতা পাওয়ার আগেই তাদের সব স্বপ্নের যেন সমাপ্তি ঘটে। আর তাই এই অপরূপ দৃশ্য উপভোগ বা হৃদয়ঙ্গম করার আগেই লাল শাড়ি পরে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় কিশোরীদের। তারপর অল্প বয়সেই দায়িত্বশীল নারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে হয়। এখানেই গল্প শেষ নয়। বিয়ের স্বল্প সময়ের মধ্যেই আবার মাতৃত্বকে বরণ করাটাও যেন নিয়তি। চরের কিশোরীদের জীবনের সুন্দর স্বপ্নগুলো এভাবেই সংকুচিত হয়ে আসে, মুখ থুবড়ে পড়ে।
অবিশ্বাস হলেও সত্য, তিস্তার বেশিরভাগ দ্বীপচরে কিশোরী বা তরুণী মেয়েদের দেখা পাওয়া ভার। সেই তুলনায় চরে কিশোরী বধূর সংখ্যা অনেক বেশি। চরে বাল্যবিয়ের প্রচলন হার অনেক বেশি বলেই এমনটি হয়েছে। অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দেওয়াটা চর সংস্কৃতিরই অংশ। এর পেছনে অবশ্য নানাবিধ সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ জড়িত। মনস্তাত্তি্বক কারণও যে নেই তা নয়। 'মেয়ে বড় হলে ভালো পাত্র পাওয়া যায় না'_ এ রকম একটি সংস্কার চালু আছে চরবাসীর মাঝে। স্বভাবতই মেয়ে একটু বড় হলেই বিয়ে দেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন অভিভাবকরা। চরে কিশোরী বয়সেই নব্বই ভাগ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। গড়পড়তায় দশ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে মেয়েদের বিয়ের হার সবচেয়ে বেশি। অথচ সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া শাস্তিমূলক অপরাধ। কিন্তু চরের বেশিরভাগ অভিভাবকের এ তথ্য জানা নেই। আবার যাদের জানা আছে তারাও বিষয়টি অনুসরণ করেন না, সমাজ ব্যবস্থা এবং অভাব দারিদ্র্যের কারণেই।
অল্প বয়সে মা হতে গিয়ে চরের অনেক কিশোরী বধূর মৃত্যুও হয়েছে। চর এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা মারাত্মক রকম অপ্রতুল থাকায় গর্ভবতী মেয়েরা সুচিকিৎসা পান না। গর্ভাবস্থায় অবহেলা আর উপেক্ষার শেষ নেই। আর এ কারণে এখানে মাতৃমৃত্যুর হারও অনেক বেশি। চর ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ অভিভাবক মনে করেন দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা বয়সে বেশি বড় হলে তাদের আর চাহিদা থাকে না। ফলে বয়সী মেয়েদের বিয়ে দেওয়াটা বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। সামাজিক নিরাপত্তার কারণেও অনেকে দ্রুত মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
তিস্তা চরের অনেক কিশোরীই এখন বাল্যবিয়ে সমর্থন করে না। নিকটজনদের দুর্গতি দেখে তাদের অল্প বয়সে বিয়ে পিঁড়িতে বসতে অনাগ্রহের শেষ নেই। সে কথাই বলছিলেন চর বোয়ালমারীর কিশোরী বুলবুলি। এই কিশোরী একটি উন্নয়ন সংগঠন পরিচালিত স্কুলে লেখাপড়া করে। বাল্যবিয়ের কুফল সে বেশ ভালোই জানে। স্কুলের শিক্ষকরাও এ বিষয়ে তাকে সতর্ক করেছে। বুলবুলি স্কুলে হাতের কাজ শিখছে। তার ইচ্ছা একটি সেলাই মেশিন কিনে জামা-কাপড় বানানোর কাজ করবে। কিন্তু পরিবারের মানুষগুলোর কাছে তার এই ইচ্ছার তেমন কোনো মূল্য নেই। বুলবুলির সরল স্বাকারোক্তি_ 'বাপে-মায়ে বিয়ে দিলে আমার তো আর কিছু করার নেই। বিয়ে করতেই হবে। তবে আমার মন চায় না এখনই বিয়ে করতে। আমি অনেক কাজ শিখতে চাই। চাকরি করতে চাই।'
zahidrahman67@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.