সদরে অন্দরে-কার স্বার্থে এই সম্প্রচার নীতিমালা by মোস্তফা হোসেইন

দিনের আলো নিভে যাওয়ার আগেই একটি টেলিভিশনেরও বাতি নিভে গেল। বন্ধ হয়ে গেল সম্প্রচার। একটিমাত্র নির্দেশে। সেই সঙ্গে বেকার হয়ে যায় চার শতাধিক সাংবাদিক-কর্মচারী। মনে আসছে বাংলাদেশের প্রথম সংবাদভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল সিএসবি নিউজের সম্প্রচার বন্ধ হওয়ার কথা। সিএসবি নিউজ ভবনের টপ ফ্লোরে বসে কাজ করছিলাম তখন। সন্ধ্যার আগমুহূর্তের ঘটনা। হঠাৎ একজন এসে বলল, র‌্যাব-পুলিশ ঢুকেছে অফিসে।


অনেক সশস্ত্র ব্যক্তি ঘিরে রেখেছে পুরো ভবন। কক্ষ থেকে বের হতেই একজনকে দেখলাম নির্দেশ দিতে। এইচআর অ্যান্ড অ্যাডমিন হেড মাহমুদ ভাই একটু সময় চাইলেন। বললেন, মিনিটখানেক সময় দিন। সম্প্রচার বন্ধের ব্যাপারে আমরা একটা ঘোষণা প্রচার করতে চাই। আগন্তুকের ভালো ঠেকেনি কথাটা। ক্ষোভের সঙ্গেই বললেন, আগে বন্ধ করুন, পরে ইচ্ছামতো ঘোষণা প্রচার করবেন না হয়। সাংবাদিক-কর্মচারীদের চোখের পানি বইয়ে দিয়ে চ্যানেলটির মৃত্যু হলো।
অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি টিভি চ্যানেলের অপমৃত্যু দেখার পর প্রশ্ন আসছিল মনে, টেলিভিশন চ্যানেল চালানোর জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই কেন বাংলাদেশে? নেই কোনো নীতিমালাও। লাইসেন্স প্রদান থেকে শুরু করে পরিচালনা_কোনো ক্ষেত্রেই কিছু নেই। লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে বিবেচিত হয় সরকারের ঘনিষ্ঠতা, যাকে আমরা স্পষ্টতই রাজনৈতিক সুবিধার আওতায় ফেলতে পারি। দলীয় বিবেচনাই সেখানে প্রাধান্য পায়। আবার রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্যই সরকার কোনো চ্যানেলকে মুহূর্তের নির্দেশে বন্ধ করে দিতে পারে। দেশের গণমাধ্যমজগতে এমন অনিশ্চিত অবস্থা কোনোমতেই প্রযোজ্য হতে পারে না। এর একটা বিহিত হওয়া প্রয়োজন। অন্তত শৃঙ্খলা ফিরে আসা উচিত এই জগতে।
এই অনিশ্চিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে গণমাধ্যমসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দীর্ঘদিন ধরেই সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছেন এতদ্বিষয়ক আইন ও নীতিমালা প্রণয়নের জন্য। হয়তো বিষয়টি সরকারও উপলব্ধি করেছে। আমরা আশান্বিত হয়েছিলাম সরকারের এ বিষয়ে কিছু উদ্যোগ নেওয়ার পর। যে কারণে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগকে অনেকেই সাধুবাদ জানিয়েছিলেন। মনে করা হচ্ছিল, তথ্য অধিকার আইনের মতোই আরেকটি আইন প্রণয়নের সুযোগ সম্প্রসারিত হচ্ছে বাংলাদেশে। শুধু তা-ই নয়, আইন পাসের রেকর্ডধারী এই দেশটি অচিরেই এ বিষয়ে সুন্দর একটি আইন মানুষকে উপহার দেবে_এটা অনুমান করতে থাকেন অনেকেই।
অতিসম্প্রতি সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়নের পর অনেকেই খুশি হয়েছেন। কিন্তু সেই খুশি মোটেও টেকসই হয়নি। কারণ এই নীতিমালা এমনই ধাঁচে গড়া শব্দসমষ্টি, যা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে যথেষ্ট বলে গণ্য হতে পারে। উপরন্তু এই নীতিমালাকে গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার পরিপন্থী হিসেবে গণ্য করাও অস্বাভাবিক নয়। যদি দফাভিত্তিক বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে দেখা যাবে, এই নীতিমালা আমাদের সংবিধানের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। গণতন্ত্রকে হত্যা করার মতো বেশ কিছু উপাদান রয়েছে এই নীতিমালায়। প্রস্তাবিত নীতিমালায় উলি্লখিত কিছু বিষয় সরকারের ঘোষিত নীতিমালারও পরিপন্থী। কোন টেলিভিশন কোন টক শো চালাবে, কোনটা চালাবে না_এমন আইন কিংবা নীতিমালা কি সরকার করতে পারে? অদ্ভুত কিছু বিষয় সংযোজন করা হয়েছে সেখানে। এই নীতিমালা যে কতটা নেতিবাচক একটি নির্দেশনাকে বহন করে, তার কয়েকটি দিক উল্লেখ করলেই বোঝা যাবে। না, এমনও বলার সুযোগ নেই যে শুধু টক শোতেই বাধা প্রদান করা হচ্ছে। প্রকারান্তরে টেলিভিশন চ্যানেলের সংবাদ প্রচারেও বিঘ্ন ঘটাতে প্রণীত হয়েছে এই নীতিমালা। শুধু গুণকীর্তন করার মধ্যেই কি সীমাবদ্ধ থাকবে চ্যানেলগুলো? কী অদ্ভুত কথা! সেখানে বলা আছে, সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের বক্তব্য কিংবা মতামত প্রচার করা যাবে না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কোনো বিদ্রোহ, নৈরাজ্য ও হিংসাত্মক ঘটনা প্রদর্শন করা যাবে না। ওয়াজ মাহফিল, উরস, পূজা, বড়দিন, বুদ্ধপূর্ণিমা ইত্যাদি ধর্মবিষয়ক বিজ্ঞাপন প্রচারের আগে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে।
প্রস্তাবিত এই নীতিমালা কার্যকর হলে কারো বিরুদ্ধে যায় এমন কিছু প্রচার করা যাবে না। সরকার যে উদ্দেশ্যে এই অদ্ভুত নীতিমালা করতে চেয়েছিল, সেই উদ্দেশ্য কি আদৌ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে? একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে যদি আমরা দাবি করতে যাই, তাহলে ব্যক্তির মতকে প্রাধান্য দিতেই হবে। কোনো মন্ত্রী কিংবা গোটা সরকারও যদি কোনো ভুল পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তাহলেও কি সমালোচনা করার অধিকার থাকবে না? সরকারের সমালোচনা করতে না পারলে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের প্রয়োজন কী? আর সমালোচনা যদি প্রচার করা না যায়, সরকার তার নিজের ভুলগুলো বুঝবে কিভাবে? এটা কি দেশ কিংবা গণতন্ত্রের জন্য শুভ হতে পারে? সরকার বোধ হয় বিটিভি ১, ২, ৩_এমনি করে ডজন-দেড় ডজন চ্যানেল তৈরি করার চিন্তা করছে। গণমাধ্যমকে বলা হয় দ্বিতীয় সংসদ। দ্বিতীয় সংসদের কণ্ঠরোধ করা আদৌ যুক্তিসংগত হবে কি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে?
আমাদের সংবিধান সব ধর্মমতের মানুষকে নিজের ধর্মকর্ম স্বাধীনভাবে উদ্যাপন করার অধিকার প্রদান করেছে। সেখানে ধর্মীয় অনুষ্ঠান করার জন্য প্রশাসনের অনুমতির প্রয়োজনীয়তার কোনো নির্দেশনা নেই। কিন্তু ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সংবাদ সম্প্রচার করতে হলে কোন কারণে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হবে, তা বোধগম্য নয়।
সম্প্রচার নীতিমালার নামে যে বিষয়টি উপস্থাপিত হয়েছে, তার রচয়িতাদের উদ্দেশ্য নিয়েও সংগত কারণে প্রশ্ন আসতে পারে। তারা আসলে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার মিশন নিয়ে নেমেছে? জানা মতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোনো বক্তৃতা কিংবা বিবৃতিতেই এমন বিষয় পাওয়া যায়নি, যেখানে সরকার মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে আঘাত করতে চায়। শুধু তা-ই নয়, তাদের নির্বাচনী ইশতেহারও যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তাহলেও দেখতে পাব যে তারা দেশে অবাধ তথ্যপ্রবাহে বিশ্বাস করে এবং সেই বিশ্বাস বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধও। এটা জেনেও কিভাবে এমন একটি প্রস্তাবনা উপস্থাপিত হলো, তা ভেবে দেখা দরকার।
এই নিবন্ধ লেখার সময় বেসরকারি একাধিক টেলিভিশন চ্যানেলের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের অভিমত জানা গেছে। তাঁদের কথা_এই নীতিমালার মাধ্যমে সরকারকে নাস্তানাবুদ করার কোনো প্রয়াস নেওয়া হয়েছে কি না তা দেখতে হবে। যারাই এই প্রস্তাবনা নিয়েছে, তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্পষ্টতই বলা যায়_তারা বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকেও বিটিভি বানাতে চায়। কিন্তু বেসরকারি চ্যানেলগুলো তো বেসরকারি। সরকারের ছায়া হিসেবে কেন কাজ করবে? তারা ঘটনা নিয়ে এগিয়ে যাবে। এতে সরকারের পক্ষে ও বিপক্ষে অনেক কিছুই থাকতে পারে।
সম্প্রতি সম্প্রচার শুরু করেছে এমন একটি চ্যানেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক স্পষ্টত বললেন, এই নীতিমালায় প্রশংসনীয় কিছু দিকও আছে। বিশেষ করে নৃশংস কোনো ঘটনার ছবি না দেখানোর যে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে, সেটি খুবই ভালো। তাঁর কথা, 'আমরা নিজেরাই বীভৎস ছবি প্রচার করি না। আতঙ্কিত হয় এমন কিছু ছবি দেখাই না। অহেতুক মানুষ ক্ষুব্ধ হয় এমন কোনো ছবিও প্রচার করি না। সেই আলোকে নীতিমালার এই অংশটুকুকে প্রশংসিত উদ্যোগ বলে মনে করি।'
এই মুহূর্তে দেশে একটি সম্প্রচার আইন থাকা জরুরি। এতে কর্মরত সাংবাদিক-কর্মচারীদের চাকরির নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। প্রিন্ট মিডিয়ায় কর্মরত সাংবাদিক-কর্মচারীদের প্রতি কোনো অবিচার হলে তারা আইনগত সুবিধা পেয়ে থাকে। তারা নিজেদের পদের আলোকে বেতন-ভাতা দাবি করতে পারে এবং প্রতিষ্ঠানগুলোও সেই সুবিধা প্রদানে এগিয়ে আসতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক-কর্মচারীদের কোনো ব্যবস্থা নেই। কোনো প্রতিষ্ঠান হয়তো খুবই কম বেতন দিয়ে সাংবাদিক-কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে থাকে। কোথাও আবার সন্তোষজনক সুবিধাদি প্রদান করে থাকে। যেহেতু কোনো আইন নেই, সেই কারণে কর্মঘণ্টা থাকে বেশি। সেই অনিয়মগুলো দূর করতে হলে সম্প্রচার আইন দ্রুত প্রণয়ন প্রয়োজন। তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নকালে যেমন বিশেষজ্ঞমহলের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করা হয়েছে, তেমনি সম্প্রচার আইন প্রণয়নকালেও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করা প্রয়োজন।
mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.