পারসোনা-কাহিনী ও পারসোনাল কাহিনী byশাহনেওয়াজ বিপ্লব

ভিজাত বিউটি পারলার পারসোনার হিডেন ক্যামেরার ঘটনা নিয়ে অনেক কিছু হয়ে গেল এরই মধ্যে। সংবাদমাধ্যম এবং বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগের সাইট ফেইসবুক ও বাংলা ব্লগ ঘটনাটিকে ইতিমধ্যে সারা বিশ্বে পেঁৗছে দিয়েছে। ঘটনার পর পরই পারসোনা কর্তৃপক্ষ ও অভিযোগকারীর স্বামী পোশাক পরিবর্তনের কক্ষে ক্যামেরা পাওয়ার ঘটনাটি নিছক ভুল বোঝাবুঝি আর ব্যক্তিগত ঘটনা বলেই ধামাচাপা দিতে চেয়েছেন।


কিন্তু এই স্পর্শকাতর ঘটনাটি ব্যক্তি বা পারসনের গণ্ডি পেরিয়ে ইতিমধ্যে বাংলাদেশের সবার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যক্তিগত পরিসরে ঘটে যাওয়া ঘটনার দোহাই দিয়ে পারসোনার স্বত্বাধিকারী কানিজ আলমাস অথবা অভিযোগকারী চিকিৎসকের স্বামী_কেউই এ ঘটনা ধামাচাপা দিতে পারেননি। এমনকি ঘটনার চার দিন পর দেশের অন্যতম জাতীয় দৈনিক 'পারসোনার সিসিটিভিতে আপত্তিকর কিছু পাওয়া যায়নি' শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করলে ওই পত্রিকার পাঠকরা খবরটির বিপরীতে ৮৬টি মন্তব্যে পত্রিকাটির সাংবাদিকতার মান ও সংবাদ বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। কথা হচ্ছে, তথ্যপ্রযুক্তির এই সময়ে ফেইসবুক আর ব্লগের হাত ধরে বিশ্বজুড়ে যখন সরকারগুলোর পতন হচ্ছে একের পর এক, সে সময় কোনো ঘটনাই এখন আর নেহাত ব্যক্তিগত ঘটনা নয়। ফেইসবুক ও ব্লগের কল্যাণে ব্যক্তিগত ঘটনাগুলোও এখন সবার। ধরা যাক, নাইজেরিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হোটেলে একটি মেয়েকে পাঁচজন পুরুষ পর পর ধর্ষণ করেছে_এই ইন্টারনেট ক্লিপটি সাড়া ফেলে দিয়েছে সর্বত্র। ১০ মিনিটের এই ক্লিপে দেখা যায়, মেয়েটি পাগলের মতো চেঁচাচ্ছে, 'আমাকে তোমরা মেরে ফেলো।' কিন্তু তার বদলে সে ধর্ষিত হয়। নাইজেরিয়ার এনজিওগুলো বলছে, তারা এ নিয়ে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখবে; তাদের আন্দোলন আরো শক্তিশালী করবে ক্লিপটি, প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে যে নাইজেরিয়ার মতো দেশে প্রতিনিয়ত কত ধর্ষণ হয় আর সে ব্যাপারে সরকার কতটা উদাসীন। এই প্রচার একটা বড় ন্যায় প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করবে। যদিও অনেকে আপত্তি করেছেন, ওই মেয়েটির কী হবে? ধর্ষণের অত্যাচার, মানসিক যন্ত্রণা_সব যদি সে কাটিয়েও ওঠে, তার সবচেয়ে নৃশংস ও অসহায় মুহূর্তগুলো তো পাবলিকের হয়ে গেল। কিন্তু কথা হচ্ছে, কিসের বিনিময়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে? একজনের প্রতি একটা নৃশংস অন্যায়ের ওপর ভর করে?
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেইসবুক বা ব্লগগুলোর নিয়মই হচ্ছে এমন, কাঁধে অন্যের ভালো কিংবা মন্দের দায়িত্ব না থাকা সত্ত্বেও এরা তথ্যের প্রতি দায়বদ্ধ থাকার দায়ে অন্যের ব্যক্তিগত যন্ত্রণা, অন্যের ব্যক্তিগত অপমান, অন্যের ব্যক্তিগত জীবন পাবলিকের সামনে নিলাম করছে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলো সব সময় ব্যক্তিগত তথ্যেই ভরপুর। কারো অসুখ হয়েছে, কেউ গাছে পানি দিল, কারো বাবার এখনই হার্ট অ্যাটাক হলো, ক্ষণে ক্ষণে ব্যক্তিগত আপডেট। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের আপডেট, প্রশংসা আর সহানুভূতি ব্যবহারকারীদের জীবন আলোড়িত করে রাখে। বেঁচে থাকার পথ দেখায়। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের বন্ধুরা পরস্পরের ব্যাপারগুলোতে শেয়ার করবে। কথা হলো, কী শেয়ার করবে? কতটা? নিজের কথাটা যদি স্রেফ নিজের কথা হয়, চেঁচিয়েমেচিয়ে সাততলা ছাদ থেকে বলাই যায়। কিন্তু নিজের কথায় হামেশাই অন্যের অনুভূতি জড়িয়ে থাকে। জাস্ট ফর ফান, জাস্ট ফর ইনফরমেশন, জাস্ট লাইক দ্যাট_এই কথাগুলো আমরা বড় হেলায় বলি।
এখানে 'জাস্ট' কথাটার ওপর একটু মন দিলে 'ব্যক্তিগত'র মানেটা বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠবে। নাইজেরিয়ার ধর্ষিতা মেয়েটির ক্লিপ যারা ইন্টারনেটে প্রচার করেছে, তারা কি অন্যের সাংঘাতিক ক্ষতি করবে বলে করেছে? নাইজেরিয়ার এনজিওগুলো তো বলেছে, পরবর্তী আন্দোলনের পদক্ষেপ হিসেবে এই প্রচার অত্যন্ত শক্তিশালী। কিন্তু কিসের বিনিময়ে এই আন্দোলনের ভিত প্রস্তুত হচ্ছে? একজনের আত্মা-নিংড়ানো কষ্ট দিয়ে? তার ব্যক্ত বা অব্যক্ত যন্ত্রণা বিলিয়ে সংগ্রহ করা হবে সই? নীতি, নৈতিকতা_এসব বিতর্কের মধ্যে শুধু এটুকু বলা যায়, ইন্টারনেট না থাকলে হয়তো ধর্ষিতা মেয়েটির যন্ত্রণাটা কেবল তারই থাকত, কয়েক কোটি মানুষের কাছে প্রদর্শনী হয়ে যাওয়ার লাঞ্ছনাটা তাকে সহ্য করতে হতো না। ইন্টারনেট যেমন কয়েক শ যোজন এগিয়ে দিয়েছে আমাদের, তেমনি 'ব্যক্তিগত'কে দলেপিষে মণ্ড পাকিয়ে দিয়েছে। এ আসলে একটা পাঁচ বছরের ছেলের হাতে একে-ফিফটিসিঙ্ ধরিয়ে দেওয়ার মতোই। প্রাণ সব সময় হাতে। আমি সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে নেই, আমি তো কারো সম্পর্কে কিছু বলিনি, আমি তো কারো খারাপ করিনি_এসব কোনো কারণ নয়। এসব যুক্তির একটাই উত্তর_তুমি দিনযাপন করছ ইন্টারনেট-যুগে। অতএব তুমি যখন-তখন উন্মোচিত হতে পারো। ইন্টারনেট জমানায় 'ব্যক্তিগত'র আরেক নাম হলো 'উন্মোচিত'। জীবন এখানে খোলা পাতা। একেকটা ক্লিপে হাজির সব দলিল-দস্তাবেজ। কিছুই কারো ব্যক্তিগত নয়। কেবল পারসোনার ঘটনা নয়_আমি, আপনি, কানিজ আলমাস অথবা উদ্ধত আঁতেল_সবাই ইন্টারনেটের কাছে 'ব্যক্তিগত' গচ্ছিত রেখেছি। আমার ব্যক্তিগত কখন, কার, কোন ইচ্ছার বশে 'সবার' হয়ে যাবে, কেউ জানে না। আর তেমন কাণ্ড ঘটতে পারে এ আশঙ্কায় বন্ধু, প্রেমিক, চাচা, দূরসম্পর্কের আত্মীয়_সবার সঙ্গে সম্পক ছেদ করে যদি চিলেকোঠায় খিল দিয়ে বসে থাকতে হয়, সেটা তো জীবন নয়। সুতরাং শিখতে হবে পাত্তা না দেওয়া। এ যুগেই ইন্টারনেটে প্রেম, বন্ধুত্ব, শেয়ারিং, কেয়ারিং, বিচ্ছেদের যন্ত্রণা, কাদা-ছোড়াছুড়ি, গালাগাল_দ্যাটস অল ইন দ্য গেইম। সব কিছুর জন্য তৈরি থাকতে হবে। এ খেলার শর্তই এই। আমরা কি বলতে পারি, ফুটবল খেলে গোলটা নেব, কিন্তু ফাউলটার দায় আমার নয়?
লেখক : গবেষক, তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ, ভিয়েনা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রিয়া, shahnewaybiplob@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.