বৃত্তের ভেতর বৃত্ত-দক্ষিণ এশিয়ার সমস্যা-সম্ভাবনা by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

বিশ্বের সবচেয়ে বড় কর্মক্ষেত্র হবে দক্ষিণ এশিয়া'_এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছে বিশ্বব্যাংক। ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১১ বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, 'দক্ষিণ এশিয়া আগামী দুই দশকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হবে।' বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, আফগানিস্তান, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা_এই দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় দেশ হলো ভারত। নানা রকম সমস্যা সত্ত্বেও


ভারতকে এখন অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে মোটামুটি বড় শক্তিই বলা চলে। ভারতের রাজনৈতিক মঞ্চে রাজনীতিকদের মধ্যে যত রকম বিরোধিতা-দ্বন্দ্বই থাক না কেন, জাতীয় স্বার্থের ব্যাপারে তাঁরা এক মঞ্চে দাঁড়াতে কুণ্ঠাবোধ করেন না এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে তাঁদের এই দায়িত্ববোধ এবং দেশপ্রেম দেশটির সমৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করছে_এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ভারতের প্রায় ঠিক উল্টো চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে। শ্রীলঙ্কা ও নেপাল দীর্ঘদিনের গোষ্ঠী, দল কিংবা উপদলের দ্বন্দ্ব-সংঘাতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রক্তপাত ও প্রাণহানি ঘটেছে ব্যাপক। সম্প্রতি কিছুটা ভিন্ন চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে বটে, কিন্তু এখনো দেশগুলো পুরোপুরি অভ্যন্তরীণ সমস্যামুক্ত নয়। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক ভিত্তি চরম দুর্বল হয়ে পড়েছে দেশ দুটির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কারণে। এর ওপর দুটি দেশেই রয়েছে কট্টর মৌলবাদীদের চরম উৎপাত। সাম্রাজ্যবাদীদের হাতও ওদের দিকে প্রসারিত। এক কথায়, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান দেশ দুটি যেটুকু পেছনে নেমেছে এবং দেশগুলোর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখনো যে রকম গাঢ় মেঘে ঢাকা, এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সহজ বিষয় নয়। বাংলাদেশের চিত্র আমাদের কাছে আরো স্পষ্ট। প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সিংহভাগ ক্ষেত্রেই অযৌক্তিক রাজনৈতিক বিভেদ, অস্থিরতা, দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে রাজনীতির চর্চা, গোষ্ঠী কিংবা মহলবিশেষের হীনস্বার্থ চরিতার্থকরণে উদগ্রতা, নানা ক্ষেত্রে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ইত্যাদি নেতিবাচক বিষয়ের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসা যায়নি। কোনো কোনো মহলের তরফে শত চেষ্টা সত্ত্বেও এখনো তা সম্ভব হয়নি। সে অর্থে যত ছোট দেশই হোক না কেন, অর্থনীতির আকার-আকৃতি যত দুর্বলই হোক না কেন_ভুটান ও মালদ্বীপের চিত্র এ থেকে ভিন্ন। এর মধ্যেও বিশ্বব্যাংকের এই আশাবাদ দক্ষিণ এশিয়ার শান্তিপ্রিয় মানুষকে অনুপ্রাণিত করবে সন্দেহ নেই।
দক্ষিণ এশিয়ার সমৃদ্ধির লক্ষ্যেই গঠিত হয়েছিল একটি জোট, যা সার্ক নামে পরিচিত। কিন্তু সার্ক গঠনের উদ্দেশ্য সফল হয়নি_এটিই সত্য। আস্থার সংকটের পাশাপাশি পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে মানসিক দূরত্ব এর বড় অন্তরায় হয়ে আছে। আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক কিংবা আরো বিস্তৃতভাবে একে অন্যকে সহযোগিতা বর্তমান বিশ্বে এগিয়ে যাওয়ার কিংবা সমৃদ্ধি অর্জনের বড় মাধ্যম। আমরা যদি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কিংবা আসিয়ানের দিকে তাকাই, তাহলে এর সত্যতা খুব সহজে পেয়ে যাই। অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিটি দেশের জন্য আঞ্চলিক সহযোগিতার সুযোগ রয়েছে। যুগটা হলো বিশ্বায়নের এবং এ কারণেই পুরো বিশ্বকে এখন বলা যায় একটি 'ভুবন-গ্রাম'। 'গ্লোবাল ভিলেজ' কনসেপ্টের দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিছু বিষয় আছে, যেগুলো দ্বিপক্ষীয়; আবার অনেক বিষয় আছে আঞ্চলিক। শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, শিক্ষা-প্রযুক্তিসহ নানা দিকেই একে অন্যের সহযোগিতার বিষয়টি এখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বিচ্ছিন্নতা থেকে বেরিয়ে ন্যায়ভিত্তিক আঞ্চলিক সহযোগিতা সম্প্রসারণ ও সুদৃঢ় করে দক্ষিণ এশিয়াকে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক শক্তিশালী গোষ্ঠী গঠনের পথে সার্কভুক্ত দেশগুলো এখন পর্যন্ত হাঁটতে পারেনি। নিশ্চিত করতে পারেনি সহযোগিতার সম্প্রসারণ-প্রক্রিয়ায় এ অঞ্চলের দেশগুলোর পিছিয়ে পড়া মানুষের ন্যায্য উন্নয়ন, তাদের মানবাধিকার নিশ্চিতকরণ এবং মানব-মর্যাদার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো। সার্কভুক্ত দেশগুলোর উন্নয়নের জন্য, পারস্পরিক সহযোগিতা সম্প্রসারণের জন্য সংযোগ বা কানেকটিভিটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ, নতুন করে এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন। আমাদের স্মরণে আছে, ২০০২ সালে সার্ক শীর্ষ বৈঠকে দক্ষিণ এশিয়া অর্থনৈতিক গোষ্ঠী গঠনের সিদ্ধান্ত হয়, যা ২০০৪ সালে অনুষ্ঠিত সার্ক শীর্ষ বৈঠকে আরো গুরুত্ব পায়। কিন্তু তা-ও কার্যকর করা যায়নি। কেন করা যায়নি এ নিয়ে বিস্তর কথা আছে। তবে এ ক্ষেত্রে আস্থার সংকট বড় একটি সমস্যা হিসেবে জিইয়ে আছে।
অর্থনৈতিক গোষ্ঠী গড়ে তুলতে কিছু বিষয় নিশ্চিত করা সর্বাগ্রে জরুরি। যেমন অর্থনৈতিক গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে অবাধ চলাচলের ব্যবস্থা, বিনিয়োগ স্থানান্তর, শ্রমিক বিনিময়, অবাধ পণ্য পরিবহন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সঙ্গে ব্যবসায়িক স্বার্থে অভিন্ন বাণিজ্যনীতি, আর্থ-সামাজিক বিষয়াদিতে নীতির সমন্বয় ইত্যাদি। আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে প্রায় ২৩ শতাংশ, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে প্রায় ৬৫ শতাংশ আঞ্চলিক আমদানি-রপ্তানির (পণ্য) চিত্র যেখানে বিদ্যমান, সেখানে সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে এ হার মাত্র ৫ শতাংশ। এক দিনে সব কিছু সম্পন্ন করা কিংবা অর্জন সম্ভব নয়, এও সত্য। আসিয়ান কিংবা ইউরোপিয়ান জোটও তা পারেনি। কিন্তু তারা পারার লক্ষ্যে কাজ করেছে, নীতিগত দিক থেকে অভিন্ন অবস্থান নিয়েছে, আস্থার ভিত মজবুত করতে সক্ষম হয়েছে_যা সার্কভুক্ত দেশগুলো পারেনি। এখানে প্রায় আনুষ্ঠানিকতাসর্বস্ব সম্মেলন হচ্ছে, সিদ্ধান্ত গৃহীত হচ্ছে; কিন্তু কোনো কিছুই যথাযথভাবে কার্যকর করা যাচ্ছে না। সার্কের অঙ্গীকার তো দুর্বল নয়, উদ্যোগও কম নয়, তবুও কেন প্রত্যাশিত ফল মিলছে না? এর প্রথমত জবাব_আদর্শিক অবস্থানের মধ্যে বিস্তর ফারাক, সন্দেহযুক্ত মনোভাব ইত্যাদি। দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক অবস্থানগত দিকের বিদ্যমান অসম চিত্র। এই চিত্র নিরসনের লক্ষ্য ছিল সার্ক গঠনের মুখ্য উদ্দেশ্য, কিন্তু তা যেন প্রায় ভেস্তেই গেছে।
সার্কের আওতায় ইতিমধ্যে যেসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এর যদি ৮০ শতাংশও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়, তাহলে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার চিত্র পাল্টে যেতে বাধ্য। সার্কভুক্ত দেশগুলোর রাজনৈতিক নেতারাও নিশ্চয়ই এসব বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করবেন না। দক্ষিণ এশিয়ায় বিশ্বরাজনীতির নিয়ন্ত্রক কিংবা মোড়লরা অনেক রকম বিষ প্রয়োগ করছেন, বিভক্তির দাগ মোটা করতে সচেষ্ট রয়েছেন তাঁদের হীনস্বার্থ চরিতার্থকরণের লক্ষ্যে। দক্ষিণ এশিয়া খনিজ সম্পদসমৃদ্ধ অঞ্চল এবং ক্রমেই এর নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে। এ অঞ্চলের মানুষ অধিক কর্মক্ষমও বটে। কিন্তু সচেতনতার দিক থেকে এ অঞ্চলের মানুষ অনেকটাই পিছিয়ে এবং পশ্চাৎপদ রাজনৈতিক ভাবনা, মৌলবাদের আছর আধুনিক কিংবা অগ্রসরমান বিশ্বের সামনে এ অঞ্চল ক্রমেই বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এত সব নেতিবাচক চিত্র সত্ত্বেও বিশ্বব্যাংক দক্ষিণ এশিয়াকে নিয়ে এত বড় আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। এই আশাবাদ অমূলক নয়। দক্ষিণ এশিয়া এখন অন্যতম উৎপাদনকেন্দ্র। জনশক্তি এ অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এই জনশক্তি ইতিমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উৎপাদনসহ নানা ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখাতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বের শ্রমবাজারে এ অঞ্চলের জনশক্তির (বাংলাদেশের সম্ভাবনা এ ক্ষেত্রে অধিকতর উজ্জ্বল, যদি দূরদর্শী পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়) বাজার ক্রমবিস্তৃত হচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতি হচ্ছে, যদিও শ্রীলঙ্কা ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার ২৫ শতাংশ শ্রমিকের শিক্ষাগত যোগ্যতা কম। এ অঞ্চলের শ্রমিকরা যদি আরো দক্ষ এবং প্রযুক্তিগত দিকে আরো অগ্রসরমান হতেন, তাহলে সম্ভাবনা আরো বিস্তৃত করার পথটা প্রশস্ত করা যেত। (ভারত ও শ্রীলঙ্কা এ ক্ষেত্রে তুলনামূলক ভালো অবস্থানে আছে) শিক্ষার আরো উন্নয়ন অবশ্যই দরকার। শিক্ষার উন্নয়ন শুধু কাজের ক্ষেত্রই তৈরি কিংবা বিস্তৃত করবে না, বরং চাকরির ক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তি উৎপাদনে সহায়ক হবে।
এত সব সম্ভাবনার দ্যুতি ছড়ানো নির্ভর করছে আর্থ-সামাজিক উৎকর্ষ সাধন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর। পাশাপাশি মৌলবাদের শিকড় উৎপাটনসহ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মূলোচ্ছেদ করাও জরুরি। একই সঙ্গে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ভৌগোলিক কারণেই এ অঞ্চলকে বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত মনে করা হয়। তা ছাড়া এখানে শ্রমমূল্যও তুলনামূলক কম। বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান অর্থনীতিবিদ কল্পনা কোচলার মতে, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সম্ভাবনা এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু সচেতন মহল নিশ্চিত করেই জানে কিংবা দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশ-জাতির বৃহৎ স্বার্থে জাতীয় ঐকমত্য না হওয়ার কারণে আমাদের অনেক অর্জনের যেমন বিসর্জন ঘটছে, তেমনি অনেক সম্ভাবনারও অপমৃত্যু ঘটছে। আমাদের রাজনীতিকরা কি এই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার ব্যাপারে সচেষ্ট? যদিও এই আশা অনেকটাই দুরাশা, তবুও সচেতন জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশা_তাঁরা সংকীর্ণতার ঊধর্ে্ব উঠে দেশ-জাতির স্বার্থকেই শেষ পর্যন্ত প্রাধান্য দেবেন। এই দায়বদ্ধতা প্রদর্শনে অপারগ কেউই তো আধুনিক বিশ্বে রাজনীতির মাঠে বিচরণের উপযুক্ত হতে পারেন না। এতসব নেতিবাচক চিত্র যদি জিইয়েই থাকে, তাহলে উন্নয়ন-অগ্রগতির সব আশাই মিটমিট করে জ্বলবে, উজ্জ্বল হবে না, দুর্গতি ঘুচবে না।

লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.