গুপ্তহত্যা চলছেই, নির্বিকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী by সৈয়দ আবদাল আহমদ

দেশে গুপ্তহত্যা এক ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করেছে। এমন দিন নেই, যেদিন কেউ গুম কিংবা গুপ্তহত্যার শিকার হচ্ছেন না। মাঝে-মধ্যেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তরুণ-যুবকদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এদের কারও লাশ পাওয়া যাচ্ছে, কেউ বা নিখোঁজই থেকে যাচ্ছে। লাশ পাওয়া যাচ্ছে নদী, খাল, ডোবায়। মুন্সীগঞ্জের ধলেশ্বরী নদী থেকে গত মঙ্গলবার তিন জনের পচা লাশ পাওয়া যায়।

প্রথম এদের কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি। বুধবার এদের দু’জনের স্ত্রী এসে নিখোঁজ হওয়া স্বামীদের লাশ শনাক্ত করেন। এই তিনটি লাশ উদ্ধারের খবরে ঢাকা ও ফরিদপুর থেকে পাঁচটি পরিবার মুন্সীগঞ্জে এসেছিলেন। কিন্তু স্বজনদের না পেয়ে তারা ফেরত যান। অর্থাত্ এই পাঁচটি পরিবারেরও স্বজনরা গুম হয়েছেন। ঢাকার মোহাম্মদপুর থানাসংলগ্ন এলাকা থেকে গত বুধবার রাতে গুম হন যশোর জেলা বিএনপির অর্থবিষয়ক সম্পাদক ও ঝিকরগাছা উপজেলা বিএনপির সভাপতি নাজমুল ইসলাম। বৃহস্পতিবার সকালে গাজীপুরের দক্ষিণ শালনা এলাকায় গলায় গামছা পেঁচানো অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার করা হয়। বুধবার রাতে ঢাকার মিরপুরের একটি কমিউনিটি সেন্টার থেকে দাওয়াত খেয়ে নিজের গাড়ি চালিয়ে ধানমন্ডির ৩১ নম্বর সড়কের বাড়িতে ফিরছিলেন নাজমুল। হঠাত্ নাজমুলকে অজ্ঞাতরা ঘিরে ফেলে। নাজমুল তখন মোবাইল ফোনে যশোরের বাগারপাড়া উপজেলার বিএনপির সভাপতির সঙ্গে কথা বলছিলেন। অজ্ঞাতরা তাকে ঘিরে ফেললে তিনি শুধু বলেন—‘ভাই আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আমি এখন মোহাম্মদপুর থানার সামনে।’ এরপর মোবাইল ফোনে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

মুন্সীগঞ্জের ধলেশ্বরী নদীতে ভেসে ওঠা তিনটি লাশ কিংবা গাজীপুরের শালনার নাজমুলের লাশই নয়, গত নভেম্বর ও চলতি ডিসেম্বর মাসে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এরকম আরও অসংখ্য লাশ উদ্ধার হয়েছে। হত্যার ধরণ, লাশগুলোর অবস্থা এবং এ নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর রহস্যজনক নীরবতা থেকে মনে হচ্ছে গড়পড়তা হত্যাকাণ্ড থেকে এসব হত্যা চিত্র ভিন্ন। নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা যখন তাদের খোঁজ পেতে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ধরনা দিচ্ছেন, গণমাধ্যমে খবর ছাপা হচ্ছে, ঠিক সে সময় মানুষগুলোর খুন হওয়া একটা কিছু প্রমাণ করছে। অথচ সরকারের কোনো বাহিনী এর দায় নিচ্ছে না। আবার এসব ঘটনার কোনো কিনারাও হচ্ছে না। কারা বা কোন সন্ত্রাসী বাহিনী এসব ঘটাচ্ছে, তার কোনো তদন্তও হচ্ছে না। ফলে এ নিয়ে জনমনে আতঙ্ক ও উদ্বেগজনক অবস্থা বিরাজ করছে। এ বছরের এক হিসাবে দেখা গেছে, ঢাকা ও আশপাশের এলাকা থেকে ৩০ জন গুম কিংবা নিখোঁজ হয়েছেন। এদের ১৫ জনের লাশ পাওয়া গেছে। বাকিরা এখনও নিখোঁজ। বেশিরভাগেরই রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে। বাকিরা বিভিন্ন পেশার।
দেশে গুম হওয়া, নিখোঁজ হওয়া ও গুপ্তহত্যার যখন এমন ভীতিকর অবস্থা বিরাজ করছে, তখন আওয়ামী লীগ নেত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন সাংবাদিকদের বলেছেন—‘দেশে গুপ্তহত্যা হচ্ছে কিনা তার কাছে কোনো তথ্য নেই। গুপ্তহত্যার খবর তিনি জেনেছেন পত্রিকা পড়ে।’ দেশের নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব যার কাঁধে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে তার জ্ঞান যদি হয় এতো মামলি, তাহলে তার পক্ষে কীভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।
রাজনৈতিক মহল বেশ কিছুদিন ধরেই গুম হওয়া ও গুপ্তহত্যার ব্যাপারে অভিযোগ করে আসছিল। মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এ নিয়ে সরকারকে সতর্ক করছিল। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বরাবরই বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছিল। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল এর মধ্যে বলেছেন—‘গুপ্তহত্যা সমাজে এমন এক ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করেছে যে, এর অবসানের জন্য রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়েছে। সাধারণভাবে মানুষের ধারণা, সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটাচ্ছে। এই ধারণা থেকে মানুষ অসহায়বোধ করতে শুরু করেছে। কারণ, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস হলে তো সাধারণ মানুষের যাওয়ার কোনো জায়গা থাকে না।’
অধিকারের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আদিলুর রহমান খান বিবিসিকে জানান, বাংলাদেশে গত কয়েক মাসে হঠাত্ করে অপহরণ ও গুপ্তহত্যার ঘটনা বেড়ে গেছে। এ ধরনের গুপ্তহত্যার পেছনে আমরা মনে করি নিরাপত্তা বাহিনীর হাত রয়েছে। তিনি বলেন, আগে ড্রেস পরে নিয়ে গেছে, বিচারবহির্ভূত কিলিং হয়েছে, ক্রস ফায়ার হয়েছে। এখন অন্য ধরনের কিলিং হচ্ছে। তিনি জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় বিএনপির যশোর জেলার একজন নেতাসহ মোট চারজনের মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। র্যাব বলেছে—গত নয় দিনে মোট আটটি মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে।
গুম হওয়া দলের নেতা নাজমুলের মৃত্যুর পর গুপ্তহত্যা নিয়ে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি সংবাদ সম্মেলন করেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেন, সরকার পাইকারি হারে গুপ্তহত্যা চালাচ্ছে। বিরোধী দল তথা বিএনপির নেতাকর্মীরাই এর শিকার হচ্ছেন। এর উদ্দেশ্য একটিই—যাতে সরকারের অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ কিংবা প্রতিবাদ না হয়। মির্জা ফখরুল বলেন, গুম ও গুপ্তহত্যার সঙ্গে সরকার জড়িত। প্রতি তিন ঘণ্টায় একজন করে গুপ্তহত্যার শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, সম্প্রতি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, বিশেষ করে র্যাবের পরিচয় ধরে নিয়ে যাওয়ার বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে, যাদের লাশ পরে উদ্ধার হয়েছে বিভিন্ন স্থান থেকে। গত মঙ্গলবারও মুন্সীগঞ্জের ধলেশ্বরী নদী থেকে তিনটি লাশ উদ্ধার করা হয়, যাদের গুলি চালিয়ে হত্যার পর লাশ বস্তায় ভরে নদীতে ডুবিয়ে দেয়া হয়। কয়েকদিন আগেও ধলেশ্বরী নদী থেকে আরও তিনটি লাশ উদ্ধার হয়েছিল। যার একটি ছিল ঢাকার ৫০ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ইসমাইল হোসেনের। ঢাকার জনপ্রিয় ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলম গুম হওয়ার পর আজও জানা যায়নি তিনি বেঁচে আছেন না মরে গেছেন।
গুপ্তহত্যা নিয়ে শুধু বিএনপির মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরই নন, প্রায় সব রাজনৈতিক দলের নেতাই উদ্বেগ জানিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন। গত বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের বিজয় দিবসের আলোচনায় প্রখ্যাত ভাষা সৈনিক আবদুল মতিন আক্ষেপ করে বলেছেন, যেভাবে খুন, গুম ও গুপ্তহত্যার ঘটনা ঘটছে, তাতে মনে হয় এ রাষ্ট্রে সবচেয়ে সস্তা মানুষের জীবন। এ অবস্থা চলতে দেয়া যায় না।
বিভিন্ন মহল থেকে এর মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের পদত্যাগের দাবি উঠেছে। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন নির্বিকার। গুপ্তহত্যা সম্পর্কে গত বুধবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিগত ১০ বছরের তুলনায় ২০১১ সালে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো। এটা আমার কথা নয়, দেশ-বিদেশের পত্রপত্রিকার কথা। অবশ্য কোনো পত্রিকার নাম তিনি উল্লেখ করেননি।

No comments

Powered by Blogger.