চৈতন্যের মুক্ত বাতায়ন-ছাত্র আন্দোলনে দুর্যোগের সূত্রপাত by যতীন সরকার

বিশ শতকের ষাটের দশকে পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসক আইয়ুবের অনুগত সহচর পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনেম খানের উদ্যোগে এনএসএফ (ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন) নামে একটি স্বৈরাচার-সমর্থক ছাত্রসংগঠন গড়ে উঠেছিল বটে, কিন্তু সে সংগঠনের নানা কুকর্মের জন্য এর প্রতি সাধারণ ছাত্রসমাজ খুবই বিরূপ হয়ে উঠেছিল। সেই বিরূপতা এমন পর্যায়ে পেঁৗছে যায় যে একপর্যায়ে এনএসএফ নেতারা তাঁদের অবস্থান পরিবর্তনে বাধ্য হয়ে পড়েন।


সে সময় দুই প্রধান ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে অনেক ব্যাপারেই ঐকমত্য থাকলেও ছাত্র ইউনিয়নের পরিচিতি ছিল মূলত সমাজতন্ত্র-অনুরাগী আর ছাত্রলীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদী রূপে। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের চৈতন্যে যে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসে, তাতে এ অঞ্চলে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠতে থাকে এবং সে আন্দোলনই ক্রমে স্বাধিকারের পথ বেয়ে স্বাধীনতার দিকে যাত্রা করে। সে যাত্রাপথের প্রধান শক্তি হয়ে ওঠে যে ছাত্রসমাজ, ১৯৬৯ সালে ১১ দফা কর্মসূচির মধ্যে জাতীয়তাবাদ আর সমাজতন্ত্রমুখিনতা একাকার হয়ে যায়। এ কর্মসূচিতে শুধু ছাত্রলীগ আর ছাত্র ইউনিয়নই ঐক্যবদ্ধ হয় না, এতে সম্পৃক্ত হয়ে যান এনএসএফের নেতারাও।
অথচ কেন এই ছাত্রসমাজের মধ্যে উল্টোরথের দৌড়ের প্রবণতা দেখা গেল স্বাধীন বাংলাদেশে? স্বাধীনতার প্রায় অব্যবহিত পরেই কিন্তু অন্য রকম মনে হয়েছিল। তখন ছাত্রলীগেরই একটি অংশ সমাজতান্ত্রিক বোলচালে ছাত্র ইউনিয়নকেও ছাড়িয়ে যায়। তাদেরই নেতৃত্বে জাসদ (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল) নামে একটি রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান নিয়ে মাঠে নামে এ দল।
জাসদের জন্ম, বিকাশ ও পরিণতি নিয়ে অনেককেই অনেক কথা বলতে শুনেছি, এসব নিয়ে লেখা বইপত্রও কিছু পড়েছি। তবে জাসদের জন্মক্ষণটিতে দলটির তরুণ কর্মী-সমর্থকদের চোখে যে আশা ও উৎসাহের দীপ্তি দেখেছি, তা একান্তই চমৎকৃত হওয়ার মতো।
এসব তরুণের অনেকের সঙ্গেই আমার আলাপ হয়েছে। তারা একান্ত আন্তরিকতার সঙ্গেই কামনা করত যে দেশে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ঘটুক, সমাজতন্ত্র তথা মুক্তিযুদ্ধের সব মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দেশটি সোনার বাংলায় পরিণত হোক। এ রকম কামনাকে বাস্তব করে তোলার জন্য তারা চরম আত্মত্যাগের জন্যও ছিল প্রস্তুত। দলের নেতাদের ওপর ছিল তাদের নিশ্ছিদ্র আস্থা। সে আস্থা তারা জনগণের একটি অংশের ভেতরও সঞ্চারিত করতে পেরেছিল।
কিন্তু জাসদের নেতাদের মধ্যে বোধের ছিল প্রচণ্ড ঘাটতি। তাঁরা যতটা না আদর্শ-অনুগত হয়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন, তার চেয়ে বেশি ছিলেন উপদলীয় কোন্দল-তাড়িত। সেই কোন্দলটির সূত্রপাত ঘটেছিল মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রামের সময়েই। বিশেষ করে সে সময়ে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রসংগঠনটির একটা বড় অংশই মুক্তিসংগ্রামে তাজউদ্দীনের নেতৃত্ব মেনে নিতে পারেনি। এর ফলে যে বিভাজনের সৃষ্টি হয়েছিল, সেই বিভাজনটিই স্বাধীন বাংলাদেশে স্পষ্ট ও প্রকট হয়ে ওঠে।
ছাত্রলীগের যে চার নেতা_নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন_১৯৭১ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন, সেই নেতাদেরই চূড়ান্ত বিভক্তি ঘটল। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, মুক্তিসংগ্রাম চলাকালেই তখনকার আওয়ামী লীগের দুই প্রভাবশালী তরুণ_শেখ ফজলুল হক মনি (শেখ মুজিবের ভাগ্নে) ও সিরাজুল আলম খানের ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বের মধ্যেই এই বিভক্তির সূচনা। সে সময় 'মুজিব বাহিনী' প্রতিষ্ঠায় তাঁদের দুজনেরই সম্পৃক্ততা ছিল যদিও, তবু স্বাধীনতার পর তাঁদের মতবিরোধ দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। তাঁদেরই প্রণোদনায় স্বাধীন বাংলা ছাত্রপরিষদের চার নেতা দুই অংশে ভাগ হয়ে পড়েন। যে অংশটির মুখে ছিল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান, তাদের অন্তরেও হয়তো ছিল সে স্লোগান বাস্তবায়নের প্রত্যয়। কিন্তু সে প্রত্যয় বাস্তবায়নের জন্য দারকার ছিল যে শিক্ষা ও প্রস্তুতির, সেটির অভাব ছিল একান্তই প্রকট। শুধু আন্তরিকতা দিয়েই যে কোনো লক্ষ্যে পেঁৗছানো যায় না, উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রস্তুতির অভাবে যে অচিরেই লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে হয়, তাঁরা তারই প্রমাণ রাখলেন।
অন্যদিকে ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা সমাজতন্ত্র সম্পর্কে অনেক বেশি স্পষ্টতর বোধের অধিকারী ছিলেন। কাকে বলে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, এর সঙ্গে ইউটোপীয় বা কাল্পনিক সমাজতন্ত্রের কী পার্থক্য, ইউটোপীয় সমাজতন্ত্র কিভাবে, কাদের হাত ধরে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে পরিণত হয়, জাতীয়তাবাদী সমাজতন্ত্রের নাম করে হিটলারের মতো মানবশত্রুরাও কী করে সমাজতন্ত্রের চূড়ান্ত বিকৃতিসাধনে তৎপর হয়, বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন অবস্থায় সমাজতন্ত্রে পেঁৗছানোর বিভিন্ন পথের সৃষ্টি হয় কিভাবে, সমাজতন্ত্রের শত্রু ও মিত্র কারা_এসব বিষয়ে ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের অনেক বেশি সচেতনতা ছিল এবং প্রতিনিয়ত পড়াশোনার মধ্য দিয়ে এসব বিষয়ে অবহিতি অর্জনের জন্যও তাঁরা সচেষ্ট থাকতেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর নানা ঘটনাপরম্পরার আবর্তে পড়ে ক্রমেই তাঁরা বেপথু হয়ে যেতে থাকেন। সে রকম বেপথু হওয়ার সূচনা ঘটে আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে।
তবে এ রকম টানাপড়েনের কারণও যে নিহিত ছিল এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের বহুধাবিভক্তির মধ্যে, সে কথাটাও অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে। পাক শাসনামলেই, ১৯৬৫ সালে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রুশ-চীন দ্বন্দ্বের গাড্ডায় পড়ে এখানকার আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট পার্টিতেও দ্বিধাবিভক্তি এসে যায়। সেই দ্বিধাবিভক্তির অনিবার্য প্রভাবে পড়ে সব কয়টি সমাজতন্ত্র-সমর্থক গণসংগঠনের মতো ছাত্র ইউনিয়নও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। সাধারণ্যে এর এক ভাগ 'মস্কোপন্থী' ও অন্যভাগ 'চীনপন্থী' নামে পরিচিতি পায়। প্রথম ভাগের নেতৃত্বে আসেন মতিয়া চৌধুরী এবং দ্বিতীয় ভাগে রাশেদ খান মেনন। অচিরেই এ দেশের মূল চীনপন্থীরা যখন বহু খণ্ডে বিভক্ত হতে থাকেন, তখন তাঁদের সমর্থকরাও খণ্ড খণ্ড হয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত মতিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন সংগঠনটিই মূল ছাত্র ইউনিয়নরূপে শক্তিমন্ত ও প্রভাবশালী হয়ে পড়ে এবং অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ছাত্রলীগের সঙ্গে তার ঐক্য গড়ে ওঠে। স্বাধীন বাংলাদেশে এই ছাত্র ইউনিয়নের মূল রণধ্বনি হয় 'এসো দেশ গড়ি'।
তবে এই রণধ্বনিকে বাস্তবে রূপ দিতে (অর্থাৎ স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে) যে প্রয়োজন বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের কুপ্রভাব থেকে দেশটিকে মুক্ত রাখা_এবং তারই জন্য যে প্রয়োজন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম থেকে একমুহূর্তের জন্যও বিরত না থাকা_এ ব্যাপারে ছাত্র ইউনিয়নের সচেতনতা ছিল অত্যন্ত তীব্র ও তীক্ষ্ন। সেই সচেতনতা থেকেই ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক হারে বোমাবর্ষণের প্রতিবাদে ছাত্র ইউনিয়ন ১৯৭৩ সালের পয়লা জানুয়ারি ঢাকায় 'ভিয়েতনাম সংহতি দিবস' পালন করে মার্কিন প্রেসিডেন্টের কুশপুত্তলিকা দাহ করে। এদিন ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের মার্কিনবিরোধী বিক্ষোভ প্রদর্শনকালে পুলিশের নির্বিচার গুলিবর্ষণে ছাত্রনেতা মতিউল ইসলাম ও মীর্জা কাদের নিহত এবং পরাগ মাহবুবসহ সাতজন আহত হন।
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ছাত্রহত্যার ঘটনার সংবাদ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে জনতার সর্বস্তরে আলোড়নের সৃষ্টি হলে বেশ কিছু অবাঞ্ছিত ও দুঃখজনক ঘটনা ঘটে যায়। ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা অতিরিক্ত আবেগতাড়িত হয়ে এমন কিছু কাজ করে বসে, যা না করাটাই শোভন ও সংগত হতো। এদের এই আবেগ-তাড়নাজাত কর্মকাণ্ডের ফলে সে সময় ছাত্র ইউনিয়নের ওপর কিছুটা হলেও বিপর্যয় নেমে আসে। তবে স্বল্প সময়ের মধ্যেই সে বিপর্যয় কেটে যায় এবং সংগঠনটি আবার গুছিয়ে বসতে সমর্থ হয়।
বলা যেতে পারে, মতিউল-কাদেরের আত্মদান বৃথা যায়নি। ওই বছরেরই পয়লা আগস্ট বাংলাদেশ ভিয়েতনামের বিপ্লবী সরকারকে স্বীকৃতি দেয়, ঢাকার সঙ্গে হ্যানয়ের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং ঢাকার তোপখানা রোড থেকে মার্কিন তথ্যকেন্দ্র (ইউএসআইসি) সরিয়ে নেওয়া হয়। তা ছাড়া নির্জোট আন্দোলনের (ন্যাম) সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশ স্পষ্টতই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শিবিরে অবস্থান নেয়। এসবের ফলে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের সম্পর্কও বিশেষ ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। সেই ঘনিষ্ঠতার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ছাত্রসমাজে প্রগতিচেতনার যে জাগরণ সূচিত হয়, তা খুবই সুফলদায়ক হবে_সেদিন অনেকের মনেই এ রকম আশাবাদের সৃষ্টি হয়।
কিন্তু বিশেষ বিশেষ ঘটনাপরম্পরায় সেই আশাবাদ বাস্তব রূপ লাভ করতে পারেনি। সে বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনায় এখনই প্রবৃত্ত হচ্ছি না। তবে স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হওয়ার মহাদুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে ছাত্র আন্দোলনসহ সর্বক্ষেত্রেই যে মহাদুর্যোগ নেমে আসে এবং সে দুর্যোগ যে একুশ শতকের শেষ দশকেও কাটিয়ে উঠতে পারছি না, সে বিষয়টির কথাই এই মুহূর্তে বিশেষভাবে স্মরণ করছি। আর এর ভেতর দিয়েই চৈতন্যের বাতায়ন উন্মুক্ত করে দেওয়ার জন্য সবার প্রতি বিনীত আহ্বান জানাচ্ছি।
লেখক : শিক্ষাবিদ

No comments

Powered by Blogger.