জনশক্তি রপ্তানি, রেমিট্যান্স প্রবাহ ও কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয় by আবু এন. এম. ওয়াহিদ

ত ১৭ জুলাই ফিরোজ মান্নার লেখা একটি সংবাদভাষ্য পত্রিকান্তরে ছাপা হয়েছে। রিপোর্টটি বেশ বিস্তারিত, সুলিখিত এবং সুপাঠ্য। জনশক্তি রপ্তানির ব্যাপারে কর্মজীবী অভিবাসী শ্রমিক এবং বাংলাদেশ সরকার দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় জর্জরিত। তার কিছু পুরনো আর কিছু নতুন। পুরনো সমস্যাগুলোর মধ্যে আছে শ্রমিকদের বিদেশ যাওয়ার আগে গন্তব্য দেশের ভাষা, সামাজিক রীতিনীতি ও সে দেশের সংস্কৃতিজ্ঞান না থাকা, কর্মদক্ষতার অভাব,
জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতি, প্রতারণা, ঠকাঠকি ও দৌরাত্ম্য, বিদেশে কর্মরত থাকা অবস্থায় শ্রমিকদের পাসপোর্ট-ভিসার নবায়ন-সংক্রান্ত জটিলতা, স্বাস্থ্যসেবা, শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তার অভাব এবং সর্বোপরি বিদেশি নিয়োগকারী ব্যক্তি ও কম্পানিগুলোর অহরহ চুক্তির বরখেলাফ_এক কাজের কথা বলে অন্য কাজ করতে দেওয়া, এক বেতন-ভাতা দেওয়ার কথা দিয়ে কম দেওয়া ইত্যাদি। নতুন সমস্যার মধ্যে প্রধান বিষয় হলো, ইদানীং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সরকারবিরোধী গণতান্ত্রিক অধিকারের অন্দোলন এবং এর সঙ্গে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা এবং বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার ফলে আন্তর্জাতিক শ্রমশক্তির বাজার সঙ্কুচিত হয়ে আসা ইত্যাদি।
ফিরোজ মান্নার রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এবং এই উদ্যোগ কিভাবে আরো জোরদার করে বাস্তবায়ন করা যায় সে বিষয়ে একটি বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য। জনশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধিকল্পে সরকার বর্তমান বাজার সম্প্রসারণ এবং নতুন বাজার খোঁজার জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পাঁচটি টিম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাঠাচ্ছে। যেসব দেশে উলি্লখিত টিমগুলো যাচ্ছে এবং পর্যায়ক্রমে যাবে, সেসব দেশ হলো_অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইতালি, বেলজিয়াম, জার্মানি, স্পেন, জাপান, হংকং, তাইওয়ান, বুলগেরিয়া, রুমানিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, পোল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, বতসোয়ানা, জিম্বাবুয়ে, মিসর, মালয়েশিয়া, সুইডেন, আলজেরিয়া, অ্যাঙ্গোলা, কঙ্গো, রাশিয়া, কানাডা, সুদান, গ্রিস, লাইবেরিয়া, তানজানিয়া, এস্তোনিয়া, আজারবাইজান, নাইজেরিয়া, সিয়েরালিওন প্রভৃতি। এর বাইরে নতুন শ্রমবাজার আবিষ্কারের জন্য যেসব দেশে লোক পাঠানো দরকার তা হলো_দক্ষিণ কোরিয়া, জাম্বিয়া, মরিশাস, সিশেল, ব্রুনাই দারুসসালাম, ফিজি, পাপুয়া নিউগিনি, তিউনিসিয়া, তুরস্ক প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
এ ছাড়া পুরনো এবং নতুন শ্রমবাজারে রপ্তানির জন্য প্রতিবছর এক লাখ নতুন দক্ষ শ্রমিক সৃষ্টির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে সরকার এগোচ্ছে। এটা নিঃসন্দেহে একটি বাস্তবভিত্তিক ও উৎসাহব্যঞ্জক পরিকল্পনা। কিন্তু সমস্যা হলো, দক্ষ শ্রমিক তৈরির জন্য দেশে বর্তমানে রয়েছে মাত্র ৩০টি প্রশিক্ষণকেন্দ্র, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপর্যাপ্ত। এই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে আরো ৩৬টি নতুন ও আধুনিক প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটিও অত্যন্ত সময়োপযোগী ও যুগান্তকারী একটি সিদ্ধান্ত। রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, এসব প্রশিক্ষণকেন্দ্রে বিদেশে গমনেচ্ছু শ্রমিকদের ৪৬ ধরনের দক্ষতা শিক্ষা দেওয়া হবে। যেহেতু দক্ষতাগুলোর পূর্ণ তালিকা ফিরোজ মান্না প্রকাশ করেননি, তাই বোঝা যাচ্ছে না সরকার কোন কোন পেশার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। আশা করি, পর্যাপ্ত পরিমাণ জরিপ ও গবেষণা করেই সরকার পেশাভিত্তিক দক্ষতাগুলোর অগ্রাধিকার ঠিক করেছে। এ প্রসঙ্গে আমি কয়েকটি পেশার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে বলব। আর তা হলো_রেস্টুরেন্টের জন্য কুক, ওয়েটার, বাস-বয়, কাপড় সেলাই, চুল কাটা, ড্রাইভিং ও এর সঙ্গে বেসিক অটোমেকানিক ট্রেনিং, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা খাতে যেমন_নার্সিং, মেডিক্যাল টেকনোলজি, প্রফেশনাল ক্লিনিং, এল্ডারলি কেয়ার, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা ফেসিলিটিতে অন্যান্য সাধারণ সেবামূলক কাজ। কারণ এসব পেশায় দক্ষ শ্রমিকদের চাহিদা বিদেশে সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া এসব কাজে কর্মসংস্থানের স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তা এবং সর্বোপরি বেতন ও সুযোগ-সুবিধা অন্যান্য কাজের তুলনায় অনেক বেশি।
এই দুটি বিষয় ছাড়া জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে আরো অনেক জটিল সমস্যা রয়েছে, সরকারকে অনতিবিলম্বে কার্যকর সমাধান দিতে হবে। যেমন_বিদেশে যাওয়ার আগে এজেন্টদের সম্ভাব্য প্রতারণা থেকে শ্রমিকদের মুক্তি দিতে হবে। এ উদ্দেশ্যে উপযুক্ত আইন করে প্রতারণায় ধরা পড়লে এজেন্টদের জেল, জরিমানা ও লাইসেন্স বাতিলের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
বিদেশে থাকাকালীন পাসপোর্ট-ভিসা নবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোতে যথেষ্টসংখ্যক দক্ষ কূটনৈতিক জনবল নিয়োগ দিতে হবে। কারণ দূতাবাসগুলো থেকে সব সময় একটি অজুহাত শোনা যায়, তাদের অফিসে প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাব। তা ছাড়া বিদেশে যাওয়ার পর কোনো শ্রমিক বিদেশি নিয়োগকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দ্বারা চুক্তি বরখেলাফের শিকার হলে তাঁকে সংশ্লিষ্ট দূতাবাস থেকে বিনা মূল্যে সব ধরনের প্রশাসনিক ও কূটনৈতিক সহায়তা দিতে হবে।
জনশক্তি রপ্তানিতে এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে সফল দেশ ফিলিপিন্স। ফিলিপিন্সের জনসংখ্যা ৯ কোটি ২০ লাখ_যা বাংলাদেশের অর্ধেকের চেয়ে একটু বেশি। তাদের প্রায় সোয়া কোটি লোক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মরত। এর মধ্যে নারী ও পুরুষ শ্রমিক মোটামুটি সমান সমান। লিগ্যাল-ইলিগ্যাল মিলিয়ে শুধু সৌদি আরবেই আছে ফিলিপিন্সের প্রায় ৪০ লাখ মানুষ, যেখানে পাকিস্তান এবং ভারত মিলে ৫০ লাখের বেশি হবে না। সৌদি আরবে বাংলাদেশির সংখ্যা ২৫ থেকে ৩০ লাখের মতো। ফিলিপিনোরা যেমন সংখ্যায়, তেমনি উৎপাদন-ক্ষমতা এবং আয়-উপার্জনের বিবেচনায়ও সবার ওপরে। অভিবাসী শ্রমিকদের মাধ্যমে ফিলিপিন্সে রেমিট্যান্স আসে বছরে প্রায় দুই হাজার ৫০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি, যা কিনা বাংলাদেশের দ্বিগুণ। আমি মনে করি, ফিলিপিন্সের কৌশল থেকে বাংলাদেশের অনেক কিছু শেখার আছে।
২০০৯ সালে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিতে আমি গিয়েছিলাম ফিলিপিন্সের মুসলিমপ্রধান অঞ্চল মিন্দানাও প্রদেশের জাম্বোয়াঙ্গা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওই সম্মেলনে আমার সঙ্গে দেখা হয় ফিলিপিন্স পরিকল্পনা কমিশনের একজন সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়েছেন। বর্তমানে তিনি একটি ফিলিপিনো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। ওই সম্মেলনে তিনি একটি মনোমুঙ্কর বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তার দীর্ঘ বক্তৃতায় বিদেশে কর্মরত ফিলিপিনো শ্রমিকদের কয়েকটি বিরল ও বিশেষ গুণের কথা তিনি বলেছিলেন। বক্তৃতা শেষে খাওয়ার টেবিলে বসে আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় ফিলিপিনো অভিবাসী শ্রমিকদের বিষয়ে তিনি আরো কিছু আলোকপাত করেছিলেন। দুই বছর আগের ঘটনা এবং বয়স বাড়ার কারণে স্মৃতিশক্তি কমতে শুরু করেছে বলে ওই ফিলিপিনো অধ্যাপকের নামটা আজ মনে করতে পারছি না বলে বাস্তবিকই দুঃখিত। আমার ধারণা, জনশক্তি রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ সরকার যে উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, তাতে ফিলিপিনো অধ্যাপকের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য এবং ধারণাগুলো কাজে লাগালে দেশ ও জাতি বিশেষভাবে উপকৃত হতে পারে। বিদেশে গমনেচ্ছু শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের সময় মনে রাখতে হবে, কর্মক্ষমতা ও দক্ষতার সঙ্গে গন্তব্য দেশের ভাষা, সংস্কৃতি ও সামাজিক রীতিনীতির সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত হতে হবে। এ ছাড়া তাঁদের আরো কিছু মৌলিক মানবিক গুণ শিক্ষা দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে ওই অধ্যাপকের নিজের বর্ণনায় একটি অভিজ্ঞতার কথা বলেই আজকের নিবন্ধ শেষ করব। তিনি বলেছিলেন, ২০০৮ সালে তিনি ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে স্পেনের বার্সেলোনায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন এক বছরের জন্য। বার্সেলোনায় তিনি একদিন তাঁর এক স্প্যানিশ বন্ধুকে নিয়ে একটি রেস্টুরেন্টে ডিনার খেতে গেছেন। সেখানে গিয়ে দেখেন, ওই রেস্টুরেন্টে বেশ কয়েকজন ফিলিপিনো শ্রমিক কর্মরত। খেতে খেতে আলাপ প্রসঙ্গে তিনি তাঁর বন্ধুকে বললেন, অর্থনৈতিক বিশ্বমন্দা যেভাবে দেশে দেশে আঘাত হানছে, তাতে ফিলিপিনোরা বুঝি আর কোথাও বেশি দিন থাকতে পারবে না। বন্ধুটি তাঁকে বললেন, অন্য দেশের কথা জানেন না, তবে স্পেনে যেসব অভিবাসী ফিলিপিনো শ্রমিক আছে তাদের তারা কোনো অবস্থায়ই ফিরিয়ে দেবে না। অধ্যাপক কারণ জানতে চাইলে বন্ধুটি ব্যাখ্যা দিলেন এভাবে : ফিলিপিনোরা তাদের দেশে যেসব কাজ করে, সেসব কাজের জন্য স্পেনিয়ার্ডদের পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও নিয়োগকারীরা স্পেনিয়ার্ড কিংবা অন্য বিদেশিদের তুলনায় ফিলিপিনো শ্রমিকদের অনেক বেশি পছন্দ করে। কারণ ফিলিপিনোরা তুলনামূলকভাবে কম সময়ে স্প্যানিশ ভাষা শিখতে পারে, তারা খুব বন্ধুবৎসল, তাদের মুখে সব সময় হাসি লেগেই থাকে, তারা খুব নম্র-ভদ্র, কথা বোঝে, সহজেই ডিরেকশন ফলো করতে পারে। তারা সততা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ করে। ফিলিপিনোদের মধ্যে কাজে ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা বলতে গেলে নেই। তারা সব সময় পরিষ্কার জামাকাপড় পরে। সব শেষে বন্ধুটি অধ্যাপককে বললেন, 'অ্যাবাভ অল, ইউ ফিলিপিনোজ টেক শাওয়ার এভরি ডে।'

লেখক : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি, এডিটর, জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ, awahid@tnstate.edu

No comments

Powered by Blogger.