কল্পকথার গল্প-বেশ বেশ-বিচিকলার নাম সন্দেশ! by আলী হাবিব

বাঙালি ভোজনরসিক। ভোজনশিল্পে বাঙালির তুলনা মেলা ভার। খেতে ও খাওয়াতে বাঙালির জুড়ি নেই। বাঙালির রন্ধনশিল্প তো অনেক আগেই সীমানা পেরিয়েছে। বিলেতে রীতিমতো হৈচৈ ফেলে দিয়েছে বাঙালির রন্ধনশিল্প। কিন্তু কেবল রাঁধতে জানলেই তো চলবে না, সেই রান্নার সমঝদারও চাই। উপযুক্ত সমঝদার না পেলে শিল্পেরই ক্ষতি। কাজেই রন্ধনশিল্পের পাশাপাশি ভোজনকে রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে বাঙালি।


খাওয়া নিয়ে বাঙালির মতো করে আর কেউ ভাবে না। বাঙালি খেতে জানে, খাওয়াতেও জানে। খেতে ভালোবাসে বাঙালি, খাওয়াতে ভালোবাসে। চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয়, বাঙালি ছাড়া এর মর্যাদা আর কেউ কি সেভাবে বুঝেছে? খাওয়া নিয়ে বাঙালির আবিষ্কারের অন্ত নেই। কিন্তু আজকাল এই খাওয়া ও খাওয়ানো নিয়ে বাঙালির দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘতর হচ্ছে। কারণ বাজারদর। বাজারদর বাঙালির শখ খেয়ে ফেলেছে। বাঙালি বাজারদরের কাছে রীতিমতো আত্মসমর্পণ করে বসে আছে। আগের মতো করে খেতে পারছে না। স্বার্থপরের মতো নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে একটু কব্জি ডুবিয়ে খাবে, সে উপায়ও নেই। এখানেও বাদ সাধছে বাজার। বাজারে গেলে খাওয়ার সাধ মিটে যাচ্ছে। খাওয়ানোর চিন্তা তো দূরঅস্ত।
তার পরও যদি বলা হয় 'আদেখলেপনা'-বাঙালির সেটা আছে। খাওয়া নিয়ে বাঙালির আদেখলেপনার শেষ নেই। খেতে কিংবা খাওয়াতে না পারলেও খাওয়া নিয়ে বাঙালির গল্পের অন্ত নেই। সেই আমল থেকে আজকের দিন পর্যন্ত খাওয়া নিয়ে বাঙালির কত যে গল্প জমা আছে, তার ইয়ত্তা নেই। 'খেয়েছিলাম সেই একবার...'-এই বলে গল্প শুরু হবে। গল্প শুনে মনে হবে, এখনো হাতে খাবারের গন্ধ লেগে আছে। কোথাকার দই ভালো, কোথাকার মিষ্টি-সব বাঙালির নখদর্পণে। কোনো বছর জোটে কী জোটে না। কিন্তু গল্পের শেষ নেই। খাওয়া নিয়ে কত লেখালেখি! আজকের দিনের পত্রপত্রিকার পাতায় রেসিপি তো মাস্ট। সেই রেসিপির জন্য আবার ফটোসেশন। পত্রপত্রিকার পাতা কেন, টেলিভিশন খুললে প্রতিদিন রান্নাবান্নার অনুষ্ঠান। কিন্তু এসব খানায় খাজনার চেয়ে যে বাজনাটা বেশি সেটাও বিলক্ষণ চোখে পড়ার মতো। খাওয়াদাওয়া নিয়ে রীতিমতো বই লেখা হচ্ছে। সেলিব্রিটিদের নিয়ে আসা হচ্ছে টেলিভিশনের পর্দায়। স্বয়ং বিদ্যাসাগর এই খাদ্য নিয়ে লিখতে কার্পণ্য করেননি। 'লুচি-কচুরি-মতিচুর শোভিতং/জিলেপি-সন্দেশ-গজা বিরাজিতম্।/যশ্যাঃ প্রসাদেন ফলারমাপ্লুমঃ/সরস্বতী সা জয়তানি্নরন্তম্' বিদ্যাসাগর মশায় একা নন, রামনারায়ণ তর্করত্নও উত্তম ফলার, মধ্যম ফলার ও অধম ফলার নিয়ে লিখেছেন। 'ঘিয়ে ভাজা তপ্ত লুচি,/দু'চারি আদার কুচি/কচুরি তাহাতে খান-দুই।/ছকা আর শাকভাজা,/মতিচুর বঁদে খাজা, ফলারের জোগাড় বড়ই'-এই নাকি উত্তম ফলার। কিন্তু আমাদের তো আজকাল অধম ফলার জোগাড় করাটাই চিন্তার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাহলে কী আর করা? স্মৃতি রোমন্থন ছাড়া আর উপায় কী? খেতে না পেয়ে আগের দিনের খাওয়া নিয়েই ভাবতে বসতে হয়। আহা, কী সব দিন ছিল? খাওয়া ও খাওয়ানোর প্যাটার্নই পাল্টে গেল! সেকালের ভোজনরসিক কবি লিখেছিলেন, 'ওগ্গর ভত্তা রম্ভঅ পত্তা/গাইক ঘিত্তা দুগ্ধজুত্তা/মোইলি মচ্ছা নালিচ গচ্ছা/দিজ্জই কান্তা, খাই পুণ্যবন্তা।' সরল অনুবাদ এ রকম, গরম ভাপ ওঠা ভাত পাতে পড়বে। তার সঙ্গে থাকবে গাইয়ের দুধ ও ঘি। তার সঙ্গে মৌরলা মাছ, সঙ্গে নালতে শাক। কান্তা দিচ্ছে আর যিনি খাচ্ছেন, তিনি পুণ্যবান। 'খেয়ে পুণ্যবান'! ব্যাপারটা ভাবুন একবার। একটা চিত্রকল্প তৈরি করে নিন মনে মনে। বেশ জমিয়ে বাজার করে এনেছেন। বাড়িতে একটা উৎসবের আমেজ। রান্না হচ্ছে। রান্নার গন্ধ ভেসে আসছে বাতাসে। সারা বাড়িতে রান্নার গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। পাত পেড়ে বসেছেন। হাসিমুখে গিনি্ন ভাত তুলে দিচ্ছেন পাতে। খাচ্ছেন। কিন্তু আজকের দিনের বাস্তবতা তো অন্য রকম। আজ মৌরলা মাছ চেনেন কয়জন? আর নালতে শাক? উঠেই গেছে। মাছের বাজারে শেষ কবে গিয়েছেন মনে পড়ে? মনে পড়বে না কেন? বাজারে গেলেই তো একবার মাছের বাজারে ঢুঁ মারা হয়। কিনতে নয়, দেখতে। বাজারে কী কী মাছ উঠল। কোন মাছের কী দাম সেটা জানতে। জানার জন্য কেনার দরকার নেই। মাছের দাম করারও প্রয়োজন পড়বে না। কেনার জন্য বিশেষ কিছু লোককে বাজারে পাওয়া যাবেই। তাঁরা দাম করবেন। আমি-আপনি হয়তো দূর থেকে সে দামটা জেনেই তৃপ্ত। বাড়িতে ফিরে ফ্যানের নিচে বসে (অবশ্য তখন যদি ঘরে বিদ্যুৎ থাকে) স্ত্রীর কাছে অন্তত বলা যাবে, উহ্ মাছের দিকে আর তাকানো যাচ্ছে না। কী দাম!
কিন্তু খেতে তো হবে। কী খাবেন? ওই কবির কবিতা ধরেই এগিয়ে যাওয়া যাক। গব্যঘৃতের ব্যাপারে বলেছেন কবি। এটাও এখন আর চেখে দেখার উপায় নেই। চেষ্টা করলে চোখে দেখা যেতে পারে। বাজারে তো আজকাল কৃত্রিম ঘি বেরিয়েছে। নকল ঘি। সেটাতেই এখন রসনা তৃপ্তির সুযোগ খুঁজছে বাঙালি। কী আর করা? আর দুধ? সেটা যে কতটা খাঁটি, তা এখন রীতিমতো গবেষণার বিষয়। ঢাকা শহরে আজকাল এক ধরনের গরুর দুধ পাওয়া যায়। যাঁরা এই দুধ সাপ্লাই করে বেড়ান, তাঁদের কাছে এই দুধের নাম 'প্লাস্টিকের দুধ'। গরুর দুধ থেকে ছানা বের করে নেওয়ার পর যে পানি পড়ে থাকে সেই পানিতে এক ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে এই দুধ তৈরি করা হয়। এই দুধের খবর যাঁরা জানেন, তাঁরা কেমন করে 'দুগ্ধজুত্তা' হবেন? কবি যে বলেছেন 'ওগ্গর ভত্তা', সেই ভাতেও কি আগের মতো তৃপ্তি পাওয়া যায়? বাজারে চালের যা দাম, তা না হয় উপেক্ষাই করা গেল। কারণ আমাদের তো আর ভাত ছাড়া চলছে না। চালের সঙ্গে কাঁকর ফাও, সেটাও না হয় মেনে নেওয়া গেল। কিন্তু চাল যেটা কিনছেন, সেটা আসল তো? আজকাল অধিক উৎপাদনের জন্য অনেক ধরনের 'উচ্চ ফলনশীল' জাতের ধান বেরিয়েছে। সেই ধানের চাল রিফাইন করে আপনার কাছে যে অন্য চাল হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে না, সে নিশ্চয়তা কে দেবে? তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে কী? মাছ, মাংস, দুধ, ঘি আপাতত জুটছে না। উপায় কী? আচ্ছা, না হয় এসব জোটানো গেল। কিন্তু ঘরের লক্ষ্মীটিও তো কর্মজীবী নারী। তিনি বাড়িতে ফেরেন ক্লান্ত ও শ্রান্ত হয়ে। তার পরও তো দুজনের আয়ে সংসারের টানাটানি দশা থেকে মুক্তি নেই। রোজ আমিষ জোটানো কষ্ট। তাহলে?
তা না হয় একটু শাকপাতার দিকেই দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে। সে আমলে মাঠে-ঘাটে, বাড়ির আনাচে-কানাচে নানা ধরনের শাক পাওয়া যেত। ঘরের বধূদের সে আমলে তো বাড়ির বাইরে যাওয়া বারণ ছিল। কাজের মেয়েদের পাঠানো হতো শাক তুলতে। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম তাঁর একটি বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, 'নটে রাঙ্গা তোলে শাক পালঙ্গ নালিতা/তিক্ত ফলতার শাক কলতা পলতা।/সাঁজতা বনতা বন পুঁই ভদ্র পলা,/হিজলী কলমী শাক জাঙ্গি ডাঁড়ি পলা।/নটিয়া বেথুয়া তোলে ফিরে ক্ষেতে ক্ষেতে,/মহুরী শূলকা ধন্যা ক্ষীর পাই বেতে।' আজকের দিনে এসব শাক কোথায় পাওয়া যাবে? অনেকের কাছে নামগুলোই নতুন। তাহলে? কী দরকার ওই শাক-পাতা খেয়ে? বাজারে যদিবা কিছু শাক পাওয়া যায়, তো এক আঁটি শাকের দাম কত? 'শাক দিয়ে মাছ ঢাকা' জাতীয় একটা কথা চালু আছে। মাছ ঢাকা দূরে থাক, নিজের বাজারের কাঙালিপনা ঢাকতে এক আঁটি শাক কিনতে পারাটাও এখন সৌভাগ্যের ব্যাপার। কারণ শাকও এখন আক্রা।
অগত্যা নিরামিষ সবজিতেই মনোনিবেশ করা যেতে পারে। সে আমলের মুনি-ঋষিরা তো এসবই খেতেন। এড়িয়ে চলতেন মাছ-মাংস। সে পথেই আনন্দ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। সে গুড়েও বালি। করবেন কী? ওসব বাদ দেওয়া যাক। কিছুই এখন পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া যাচ্ছে না বললে ভুল হবে। জোটানো যাচ্ছে না। জোটাতে গেলে টেঁকের যে জোর থাকা দরকার, সেটা অনেকেরই নেই। নিরামিষ খাবেন তারও জো নেই। বাজারে যাওয়ার আগে খবরের কাগজের দিকে একটু নজর বুলিয়ে নিন। কী সব শিরোনাম-'সবজির দাম চড়া', 'সবজির দাম আবার চড়া', 'সবজির দাম বাড়ছেই', 'বেড়েই চলেছে সবজির দাম', 'সবজির দাম কমছেই না', 'সবজির দাম চড়া-কেজি ৫০ টাকার নিচে নেই'। দেখেশুনে একজন মনের দুঃখে বলেছেন, 'কী এক আজব দেশ/বিচিকলার নাম সন্দেশ!' সবজির বাজার চড়া এমন কড়া খবরে অনেকের মন খারাপ হয়ে যেতে পারে। একটা লাগসই জোক হলে ব্যাপারটা হালকা করা যেত।
জোক নয়, একটা সত্য গল্প শোনানো যাক। একটা ছোট ছেলে তার বাবার কাছে কিছু পয়সার আবদার করছে। 'আব্বা তাইর আনা পয়তা দ্যাও। তাইর আনা পয়সা দ্যাও।' চার আনা পয়সা। আজকের দিনে চার আনা কাকে বলে এটা অনেক শিশুই জানে না। যে পঁচিশ পয়সায় চার আনা হয়, সেই পঁচিশ পয়সার কয়েন আজকাল হয়তো খুঁজেই পাওয়া যাবে না। কিন্তু যখনকার গল্প বলছি, সে সময় পঁচিশ পয়সা বা চার আনার দাম ছিল। শিশুপুত্রটির সঙ্গে একটু খুনসুটি করার ইচ্ছে হলো বাবার। তিনি জানতে চাইলেন, চার আনা পয়সা দিয়ে কী হবে? শিশুটির জবাব, 'কতকতি খাবো।' আজকের দিনে চিপস কিংবা পটেটো ক্র্যাকার্স ইত্যাদি খুব পরিচিত। কটকটি বা খাগড়াই নামের মজার জিনিসটির সঙ্গে অনেকেরই হয়তো পরিচয় নেই। আগের দিনে চিপস কিংবা পটেটো ক্র্যাকার্স ছিল না। শিশুদের কাছে এই কটকটি নামের অধম খাদ্যটিই ছিল মহার্ঘ। সেই খাদ্যটি কিনে খাওয়ার শখ হয়েছে শিশুটির। সে তার জন্য পয়সা চাইছিল তার বাবার কাছ থেকে। বাবা আরেকটু খুনসুটি করার জন্য বললেন, 'চার আনা পয়সা নেই।' একটুও দেরি না করে বাবার মুখের ওপর শিশুটির জবাব, 'তাইর আনা পয়তা নেই আবার আব্বা হয়েতে।' অর্থাৎ চার আনা পয়সা যে দিতে পারে না তার আবার বাবা হওয়ার শখ হয়েছে!
আজ আমি-আপনি এবং আমাদের মতো অনেক বাবাই সন্তানদের এমন অনেক ছোটখাটো আবদার মেটাতে অপারগ। আমার সন্তান যেন থাকে 'শাকে-ভাতে'-এই সামান্য আশা করাটাও অনেকের কাছে দুরাশা। হায় পিতৃত্ব! কী অসহায়!
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.