বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩৮৮ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মো. হাবিবুর রহমান তালুকদার, বীর প্রতীক অদম্য যোদ্ধা ১৪ জুন ১৯৭১। কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে দখল করলেন বাসাইল থানা।


পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে দখলকৃত থানা পুনরুদ্ধারে যেকোনো সময় আক্রমণ করতে পারে। এ জন্য বাসাইল থানার পাঁচ কিলোমিটার পশ্চিমে টাঙ্গাইল-বাসাইল সড়কের বাথুলী নামক স্থানে অবস্থান নিলেন মো. হাবিবুর রহমান তালুকদারসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা। তারপর কেটে গেল দুই দিন।
১৭ জুন ভোরে বাথুলীতে হাজির হলো এক দল পাকিস্তানি সেনা। তারা আক্রমণ করল মো. হাবিবুর রহমান তালুকদারদের দলের ওপর। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা আক্রমণ চালালেন। মো. হাবিবুর রহমান ও তাঁর সহযোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানি আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকলেন।
যুদ্ধ চলতে থাকল। এর মধ্যে আবদুল কাদের সিদ্দিকীও (বীর উত্তম) মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। তাঁর সঙ্গেও ছিলেন বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধে থেমে গেল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অগ্রযাত্রা। শেষে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে গেল। ওই এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলেই থাকল।
দুই দিন পর ১৯ জুন ভোরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাথুলীতে আবার হাজির হলো। এবার তারা ব্যাপক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে ব্যাপক বোমাবর্ষণ শুরু করল। মো. হাবিবুর রহমান ও তাঁর সহযোদ্ধারা এতে দমে গেলেন না। বীরত্বের সঙ্গে পাকিস্তানি আক্রমণ প্রতিহত করলেন।
বেলা আনুমানিক ১১টা। এমন সময় পাকিস্তানিদের ছোড়া শেল এসে পড়ে মো. হাবিবুর রহমান তালুকদারের কাছে। নিমেষে বিস্ফোরিত শেলের টুকরো এসে লাগল তাঁর পায়ে। আহত হয়েও তিনি দমে গেলেন না। অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে থাকলেন। কিন্তু বেশিক্ষণ পারলেন না। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়লেন। সহযোদ্ধারা দ্রুত মো. হাবিবুর রহমান তালুকদারকে উদ্ধার করে পাঠালেন চিকিৎসকের কাছে। প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর তাঁকে পাঠানো হয় হেডকোয়ার্টার চিকিৎসাকেন্দ্রে।
বাসাইল থানা টাঙ্গাইল জেলার অন্তর্গত। জেলা সদর থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। করটিয়া-সখীপুর সড়কে বাসাইলের অবস্থান। কাদেরিয়া বাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্পসহ সকল কর্মকাণ্ডের নিয়ন্ত্রণস্থল ছিল সখীপুর। মে-জুন মাসে যুদ্ধের প্রয়োজনে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহের জন্য কাদেরিয়া বাহিনী বেশ কয়েকটি থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৪ জুন বাসাইল থানা দখল করে।
বাথুলী যুদ্ধে আহত মো. হাবিবুর রহমান তালুকদার পরে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে আর অংশ নিতে পারেননি। পুরোপুরি সুস্থ হতে তাঁর প্রায় তিন মাস সময় লাগে। এরপর তিনি কাদেরিয়া বাহিনীর বেসামরিক বিভাগে কাজ করেন।
মো. হাবিবুর রহমান তালুকদার ১৯৭১ সালে টাঙ্গাইলের করটিয়া সা’দত কলেজের এইচএসসির ছাত্র ছিলেন। ছাত্ররাজনীতিও করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। টাঙ্গাইলের সশস্ত্র প্রতিরোধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রবল আক্রমণে টাঙ্গাইলে তাঁদের সশস্ত্র প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। তখন তাঁরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। পরে তিনি কাদেরিয়া বাহিনীতে যোগ দেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মো. হাবিবুর রহমান তালুকদারকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৪১৩। তিনি হাবিবুর রহমান তালুকদার খোকা নামে পরিচিত।
মো. হাবিবুর রহমান এখনো রাজনীতিতে সক্রিয়। তাঁর পৈতৃক বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার বাসাইল উপজেলার হাবলা গ্রামে। তাঁর বাবার নাম মোবারক আলী তালুকদার। মা মাহফুজা বেগম। তাঁর এক মেয়ে।
মো. হাবিবুর রহমান তালুকদার বলেন, পাকিস্তানি বৈষম্যের বিরুদ্ধে দেশ গড়ার জন্য আমরা যুদ্ধ করেছিলাম। রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু যে রকম গণতান্ত্রিক শান্তিময় দেশ আশা করেছিলাম, তা আজও পাইনি।
সূত্র: টাঙ্গাইলে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক কামনাশীষ শেখর এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর-১১।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.