কল্পকথার গল্প-বাঙালির উন্নতির অন্তরায় by আলী হাবিব

কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রেমিক মনে মহা তোলপাড় তোলা এক পঙ্ক্তি লিখেছেন, 'তেত্রিশ বছর কাটল, কেউ কথা রাখেনি'। কী সাংঘাতিক কথা! তেত্রিশ বছর ধরে প্রেমহীন! ধৈর্য বটে! না শুধু প্রেম নয়, জীবনের কোনো আশাই তো পূরণ হলো না। মামাবাড়ির মাঝি তিন পহরের বিল দেখাতে নিয়ে গেল না। চৌধুরীদের বাড়ির রাস উৎসব দুরাশা।


'দেখিস, একদিন আমরাও...'- পূরণ হলো না সে আশা। সুনীল তবু একলা মানুষ। আমাদের তো একেক করে কেটে গেল চার চারটি দশক। কী হলো আমাদের? সব আশা কি পূরণ করতে পেরেছি আমরা?
আশায় কমতি ছিল না আমাদেরও। এক বুক আশা নিয়ে একদিন জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তির সংগ্রামে। ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, কিন্তু পরাধীনতা থেকে কি মুক্তি মিলেছে? আক্ষেপ করে অনেকেই বলে থাকেন, এ জাতির কিচ্ছু হবে না। হবে না কেন? অতীতে আমাদের যদি অনেক অর্জন থাকতে পারে, আমাদের পারবে না কেন? কেন পারব না আমরা? স্বর্গসুখ চেয়ে আমরা তো কোনো অন্যায় করিনি। কেন পারব না আমরা? নরকের একটা গল্পই তবে বলা যাক।
এক পুণ্যবান মানুষ দেহ রেখেছেন। স্বর্গেই নিশ্চিত স্থান হবে তাঁর। তাঁকে স্বর্গ ঘুরিয়ে দেখানো হলো। স্বর্গের কোন স্থানটি তাঁর পছন্দ জানতে চাওয়া হলো। সেখানে রচিত হবে তাঁর শেষ আবাস। বাড়ি বদলের মতো বাক্স-পেটরা কিংবা খাট-পালঙ্ক নিয়ে সেখানে যেতে হয় না। চাইলেই সব পাওয়া যায়। চিরশান্তির সেই স্বর্গধামে প্রবেশের আগে কোনো ইচ্ছে থাকলে সেটা পূরণ করা হবে- এই নিশ্চয়তা দিয়ে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হলো ইচ্ছের কথা। তিনি নিতান্তই ভদ্রলোক ছিলেন। ভাবলেন, স্বর্গে যখন চিরস্থায়ী ঠিকানা হয়েই গেছে, তখন নরকটা একটু ঘুরে দেখে আসতে পারলে ভালো হতো। তিনি তাঁর এই ইচ্ছার কথা জানালেন। আবেদন মঞ্জুর হলো। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো নরকে। ভদ্রলোক ঘুরে ঘুরে নরক দেখার আগে ভাবলেন এলাকাটা আগে ভালো করে দেখে নেওয়া যাক। তিনি দেখতে পেলেন একেক দেশের মানুষের জন্য আলাদা আলাদা নরক। সব নরকের সামনে দেশের নাম লেখা আছে। বেঁচে থাকতে ভদ্রলোক কারাগার দেখেছেন। কারাগারের পাহারায় কারারক্ষী থাকেন, দেখেছেন। ভেতরেও পাহারার ব্যবস্থা থাকে, এমনটি শুনেছেন। কারাবাসের অভিজ্ঞতা না থাকায় ভদ্রলোক ভেতরের খবর খুব ভালো একটা জানেন না। পরিচিতি দু-একজনের কাছে গল্প শুনেছেন। নরকে বেড়াতে গিয়ে তাঁর প্রথমেই অন্য রকম একটা অভিজ্ঞতা হলো। তিনি পথ দিয়ে যাচ্ছেন, তাঁকে দেখানো হচ্ছে, এটা আমেরিকানদের নরক, ওটা ব্রিটিশদের নরক, দূরে ওটা অন্য কোনো জাতির নরক। তখনও তিনি এসব নরকের ভেতরে যাননি। ভেতরের অবস্থা পরে দেখবেন ঠিক করেছেন। আগে বাইরেরটা ভালো করে দেখতে চান। তিনি দেখতে পেলেন সব নরকের দরজায় পাহারা। বেশ কড়াকড়ি। ভেতর থেকে কারো বাইরে উঁকি দেওয়ারও সুযোগ নেই। ভদ্রলোক জানতে চাইলেন, এসব নরকের দরজায় পাহারা বসানো কেন? স্বর্গের গাইড তাঁকে জানালেন. স্বর্গে বিনা অনুমতিতে কেউ যেন অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য পাহারা বসানো হয়। আর নরক থেকে কেউ যাতে পালিয়ে যেতে না পারে, সেজন্য পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কে, কবে, কেমন করে নরক থেকে পালিয়ে ফাঁক-ফোকর দিয়ে স্বর্গে প্রবেশের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন- স্বর্গের গাইড তাঁকে তেমন কয়েকটি ঘটনার বর্ণনাও দিলেন। ভদ্রলোক এই নরক থেকে পালানোর গল্প শুনে তো বিস্মিত। যাহোক ভারতীয়, পাকিস্তানি থেকে শুরু করে অনেক জাতির নরকের সদর দরজার সামনে দিয়ে তিনি চলে এলেন বাঙালিদের জন্য নির্দিষ্ট নরকের সামনে। বাঙালিদের সম্পর্কে ভদ্রলোকের তেমন ধারণা নেই। তিনি এই নরকের দরজা পেরিয়ে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। দেখলেন, এই নরকের দরজায় কোনো পাহারা নেই। খানিকটা বিস্ময়ের সঙ্গে তিনি জানতে চাইলেন, এই নরকের দরজার সামনে কোনো পাহারা নেই কেন? স্বর্গের গাইড তাঁকে সংক্ষেপে জানালেন, 'এটা তো বাঙালিদের কারাগার, ওই যে দেখুন সদর দরজায় লেখা আছে। এখানে কোনো পাহারা লাগে না।' শুনে ভদ্রলোক তো অবাক, যেখানে পালানো ঠেকাতে ভেতরে-বাইরে কড়া পাহারার ব্যবস্থা, নরকবাসীর অনুপ্রবেশ ঠেকাতে স্বর্গেও পাহারা বসাতে হয়েছে, সেখানে বাঙালিদের নরকে পাহারা লাগে না! ভদ্রলোক ধারণা করলেন, বাঙালিদের মতো জাতি আর হয় না। কত শান্ত জাতি। এখানে কেউ নরক থেকে পালাতে চেষ্টা করে না। তার পরও নিশ্চিত হতে তিনি স্বর্গের গাইডকে জিজ্ঞেস করলেন, 'এখান থেকে কেউই পালাতে চেষ্টা করে না?' স্বর্গের গাইড বললেন, 'এখান থেকেই সবচেয়ে বেশি নরকবাসী পালাতে চেষ্টা করে'। তাহলে! ভদ্রলোকের বিস্ময়। তাহলে কেন এই নরকে পাহারার ব্যবস্থা নেই। স্বর্গের গাইড বললেন, এই নরকে পাহারার কোনো প্রয়োজন হয় না। এখান থেকে কেউ পালাতে চাইলে বাঙালিরা সবাই মিলে তাঁকে ধরে রেখে দেয়। সেই কারণে নরক থেকে কোনো বাঙালির মুক্তি নেই।
ঠিক এই কারণেই বোধ হয় জাতি হিসেবে আজও আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারিনি। কেউ একজন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে গেলেই আমরা সবাই মিলে তাঁকে ঠেসে বসিয়ে দিতে একটুও ভাবি না। কেউ আমাদের উন্নয়নের পথ দেখালে অন্য কেউ সেই পথে কাঁটা বিছিয়ে দিতে আরেকজনের হাত বাড়ানো রয়েছে। এভাবে একে অন্যের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ালে কেমন করে এ জাতি সামনের দিকে এগিয়ে যাবে? সামনে এগিয়ে যাওয়ার সব পথ নিজেরাই রুদ্ধ করে রেখেছে বলেই বাঙালি চার দশক ধরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.