প্রবন্ধ-সাহিত্য এবং রবীন্দ্রনাথ by মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান

আলংকারিক অর্থে জনক কথাটা এমনই যত্রতত্র ব্যবহার হচ্ছে যে আমার মন বলতে চায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা প্রবন্ধের জনক। বিদ্যাসাগরের আগে প্যারিচাঁদ মিত্র 'ডেভিড হেয়ারের জীবনচরিত' প্রবন্ধ রচনা করেন। একদিকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ভুদেব মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিবনাথ


শাস্ত্রী, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, প্রমথ চৌধুরী, ধুর্জটি প্রসাদ মুখোপাধ্যায়, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন অন্যদিকে আকরাম খাঁ, কাজী মোতাহার হোসেন মাঝে রবীন্দ্রনাথ রয়েছেন এক বড় প্রবন্ধকার হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রবন্ধসাহিত্য বিশাল। আয়তন অনুযায়ী তা পাঠকের তেমন মনোযোগ আকর্ষণ করেনি। রবীন্দ্রনাথ রচনাবলির প্রবন্ধের বর্ণানুক্রমিক তালিকা লক্ষ করা যায় অক্ষয় চন্দ্র চৌধুরী থেকে হিসাব পর্যন্ত কবি আট শতের অধিক প্রবন্ধ রচনা করেন। তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে যেমন 'অক্ষয় চন্দ্র চৌধুরী' জীবনস্মৃতি থেকে এবং 'গ্রহলোক' বিশ্বপরিচয় থেকে নিয়ে প্রবন্ধ তালিকায় স্থান দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা, সাহিত্য, কাব্য, ছন্দ, কৌতুক, আত্মা, ছবি, রূপ, অরূপ সৌন্দর্য, জগৎ, ধর্ম, উপনিষদ ইতিহাস, মহৎ ব্যক্তি, দেশহিতৈষা, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, ভারতীয় সভ্যতা, বাংলা সাহিত্য, বিশ্বসাহিত্য ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর অসংখ্য প্রবন্ধ রচিত হয়। তাঁর বক্তৃতা ও অভিভাষণগুলোও প্রবন্ধ হিসেবে চিহ্নিত। একসময় রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধগুলো আমি কার্ড-ইন্ডডেঙ্ করে পড়ি। এ ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের সুভাষিতগুলো তিনটি গ্রন্থ সংকলিত হয় : রবীন্দ্র প্রবন্ধে সংজ্ঞা ও পার্থক্যবিচার, রবীন্দ্ররচনার রবীন্দ্রব্যাখ্যা ও রবীন্দ্রবাক্যে আর্ট, সংগীত ও সাহিত্য।
১৬ জ্যৈষ্ঠ ১২৯৯ কবি গদ্য-পদ্যের মধ্যে তাঁর টানের কথা বললেন ইন্ধিরা দেবী চৌধুরানীকে লিখিত এক পত্রে : 'একটি কবিতা লিখে ফেললে যেমন আনন্দ হয়, হাজার গদ্য লিখলেও তেমন হয় না কেন, তাই ভাবছি। কবিতায় মনের ভাব বেশ একটি সম্পূর্ণতা লাভ করে, বেশ যেন হাতে করে তুলে নেবার মতো। আর গদ্য যেন এক বস্তা আলগা জিনিস- একটি জায়গায় ধরলে সমস্তটি অমনি স্বচ্ছন্দে উঠে আসে না- একেবারে একটা বোঝাবিশেষ।'
বছর দুয়েক পর ২০ নভেম্বর ১৮৯৪ আর এক পত্রে তাঁকে কবি বলেন, 'দিনে এবং রাত্রে যেমন কাজ এবং বিরামকে ভাগ করে নিয়েছে; সাহিত্যে, গদ্যে এবং পদ্যেও সেই রকম মানুষের ওই দুটি অংশকে ভাগ করেছে। গদ্য পরিষ্কার কাজের এবং পদ্য সুবৃহৎ বিশ্রামের। সেই জন্য পদ্যে আবশ্যক কথার কোনো আবশ্যক নেই। পদ্যে আমাদের জন্য যে জগৎ সৃজন করে সে জগতের কাছে আমাদের দৈনিক সংসার অত্যন্ত লুপ্তপ্রায় দেখায়। তাই যদি না দেখাত তাহলে নিত্যসৌন্দর্যের জগৎ, ভাবজগৎ, আমাদের কাছে দৃষ্টিগোচর হতো না। মানুষের জীবনে এ দুটো জিনিসই যখন সত্য এবং দুটো সত্য যখন দিন এবং রাত্রির ন্যায় একসঙ্গে দেখবার উপায় নেই, তখন গদ্য-পদ্য দুয়েরই আবশ্যক আছে।'
২৯ আগস্ট ১৯৩৯ সালের শান্তিনিকেতনে প্রদত্ত এক ভাষণে কবি বলেন, 'কাব্যভাষার একটা ওজন আছে, সংযম আছে; তাকেই বলে ছন্দ। গদ্যের বাছবিচার নেই, সে চলে বুক ফুলিয়ে। সেই জন্যই রাষ্ট্রনীতি প্রভৃতি প্রাত্যহিক ব্যাপার প্রাঞ্জল গদ্যে লেখা চলতে পারে। কিন্তু গদ্যকে কাব্যের প্রবর্তনায় শিল্পিত করা যায়। তখন সেই কাব্যের গতিতে এমন কিছু প্রকাশ পায়, যা গদ্যের প্রাত্যহিক ব্যবহারের অতীত। গদ্য বলেই এর ভেতরে অতিমাধুর্য-অতিলালিত্যের মাদকতা থাকতে পারে না। কোমলে-কঠিনে মিলে একটা সংযত রীতির আপনা-আপনি উদ্ভব হয়। নটীর নাচে শিক্ষিতপটু অলংকৃত পদক্ষেপ। অপর পক্ষে, ভালো চলে এমন কোনো তরুণীর চলনে ওজন-রক্ষার একটি স্বাভাবিক নিয়ম আছে। এই সহজ সুন্দর চলার ভঙ্গিতে একটা অশিক্ষিত ছন্দ আছে, যে ছন্দ তার রক্তের মধ্যে, যে ছন্দ তার দেহে। গদ্যকাব্যের চলন হলো সেই রকম- অনিয়মিত উচ্ছৃঙ্খল গতি নয়, সংযত পদক্ষেপ।'
'আজকেই মোহাম্মদী পত্রিকায় দেখছিলুম কে-একজন লিখেছেন যে, রবি ঠাকুরের গদ্যকবিতার রস তিনি তাঁর গদ্যেই পেয়েছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ লেখক বলেছেন যে শেষের কবিতায় মূলত কাব্যরসে অতিরিক্ত জিনিস এসে গেছে। তাই যদি হয় তবে কি জেনানা থেকে বার হবার জন্যে কাব্যের জাত গেল। এখানে আমার প্রশ্ন এই, আমরা কি এমন কাব্য পড়ি নি যা গদ্যের বক্তব্য বলেছে, যেমন ধরুন ব্রাউনিঙে। আবার ধরুন, এমন গদ্যও কি পড়িনি যার মাঝখানে কবিকল্পনার রেশ পাওয়া গেছে। গদ্য ও পদ্যের ভাশুর-ভাদ্রবউ সম্পর্ক আমি মানি না। আমার কাছে তারা ভাই আর বোনের মতো, তাই যখন দেখি গদ্যে পদ্যের রস ও পদ্যে গদ্যের গাম্ভীর্যের সহজ আদানপ্রদান হচ্ছে তখন আমি আপত্তি করি নে।'
১৩০১ সালে 'প্রাঞ্জলতা' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের দুর্বলতার কথা উল্লেখ করে বলেন : 'আমাদের বাংলা ভাষায়, কি খবরের কাগজে, কি উচ্চ শ্রেণীর সাহিত্যে সরলতা এবং অপ্রমত্ততার অভাব দেখা যায়- সকলেই অধিক করিয়া, চীৎকার করিয়া এবং ভঙ্গিমা করিয়া বলিতে ভালোবাসে, বিনা আড়ম্বরে সত্য কথাটি পরিষ্কার করিয়া বলিতে কাহারও প্রবৃত্তি হয় না। কারণ এখানে আমাদের মধ্যে একটা আদিম বর্বরতা আছে; সত্য প্রাঞ্জল বেশে আসিলে তাহার গভীরতা এবং অসামান্যতা আমরা দেখিতে পাই না, ভাবের সৌন্দর্য কৃত্রিম ভূষণে এবং সর্বপ্রকার আতিশয্যে ভারাক্রান্ত হইয়া না আসিলে আমাদের নিকট তাহার মর্যাদা নষ্ট হয়।'
দীনেশচন্দ্র সেনের 'বঙ্গভাষা ও সাহিত্য'-এর দ্বিতীয় সংস্করণ উপলক্ষে ১৩০৯ সালে রবীন্দ্রনাথ লেখেন : 'বাংলাদেশে ক্ষণে ক্ষণে ভাববিকাশ দেখিতে পাওয়া যায়, কিন্তু তাহার পরিণাম দেখিতে পাই না। ভাব আমাদের কাছে সম্ভোগের সামগ্রী, তাহা কোনো কাজের সৃষ্টি করে না, এইজন্য বিকারেই তাহার অবসান হয়।' ১৯৩৩ সালে 'শিক্ষার বিকিরণ' বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ বলেন, ''গল্প কবিতা নাটক নিয়ে বাংলাসাহিত্যের পনেরো-আনা আয়োজন। অর্থাৎ ভোজের আয়োজন, শক্তির আয়োজন নয়।... আমাদের সাহিত্যে রসেরই প্রাধান্য। সেইজন্যে যখন কোনো অসংযম কোনো চিত্তবিকার অনুকরণের নালা বেয়ে এই সাহিত্যে প্রবেশ করে, তখন সেটাই একান্ত হয়ে উঠে, কল্পনাকে রুগ্ন বিলাসিতার দিকে গাঁজিয়ে তোলে।'
বাংলা সাহিত্যে পৌরুষের অভাব ও পীড়াদায়ক ভাবরসের প্রাচুর্য লক্ষ করে রবীন্দ্রনাথ নিরাশ হননি, অতীতে দৈন্যকে উপেক্ষা করে তিনি যে আশার বাণী শোনালেন তা আজও প্রেরণার উৎস : '... সমাজ যখন পরিব্যাপ্ত ভাবাবেগে নিজের অবস্থাবন্ধনকে লঙ্ঘন করিয়া আনন্দে ও আশায় উচ্ছ্বসিত হইতে থাকে, তখনই সে হাতের কাছে যে তুচ্ছ ভাষা পায় তাহাকেই অপরূপ করিয়া তোলে, যে সামান্য উপকরণ পায় তাহার দ্বারাই ইন্দ্রজাল ঘটাইতে পারে। এইরূপ অবস্থায় যে কী হইতে পারে ও না পারে তাহা পূর্ববর্তী অবস্থা হইতে কেহ অনুমান করিতে পারে না।'
তাঁর 'আত্মপরিচয়' রবীন্দ্রনাথ নিজের রচনার প্রাচুর্য সম্পর্কে উল্লেখ করে মন্তব্য করেন, 'আমি জানি, আমার রচনার মধ্যে সেই নিরতিশয় প্রাচুর্য আছে, যাহা বহুপরিমাণে ব্যর্থতা বহন করে। অমরত্বের তরণীতে স্থান বেশি নাই, এই জন্য বোঝাতে যতই সংহত করিতে পারিব বিনাশের পারের ঘাটে পৌঁছিবার সম্ভাবনা ততই বেশি হইবে। মহাকালের হাতে আমরা যত বেশি দিব ততই বেশি সে লইবে, ইহা সত্য নহে। আমার বোঝা অত্যন্ত ভারী হইয়াছে- ইহা হইতেই বোঝা যাইতেছে ইহার মধ্যে অনেকটা অংশে মৃত্যুর মার্কা পড়িয়াছে।'
প্রমথ চৌধুরীকে এক পত্রে রবীন্দ্রনাথ বলেন : 'শাস্ত্রে আছে মৃত্যুতেই ভবযন্ত্রণার অবসান নেই, আবার জন্ম আছে। আমাদের যে লেখা ছাপাখানার প্রসূতিঘরে একবার জন্মেছে তাদের অন্ত্যেষ্টি সৎকার করলেও তারা আবার দেখা দেবে। অতএব সেই অনিবার্য জন্ম-প্রবাহের আবর্তন অনুসরণ করে প্রকাশকেরা যদি বর্জনীয়কে আসন দেন সেটাকে দুষ্কর্ম বলা চলবে না।' প্রবন্ধের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'ঘুষাঘুষি' প্রবন্ধে বলেন : 'ছবিতে যেমন চৌকা জিনিসের চারিটা পাশই একসঙ্গে দেখানো যায় না, তেমনি প্রবন্ধেও একসঙ্গে একটি বিষয়ের একটি, বড়োজোর দুইটি দিক দেখানো চলে।'
আবার 'পত্রালাপে' তিনি বলেন, 'নিজের নাসাগ্রভাগের সমসূত্র ধরে ভূমিকা থেকে উপসংহার পর্যন্ত একেবারে সোজা লাইনে চললে নিতান্তকলে- তৈরি প্রবন্ধের সৃষ্টি হয়, মানুষের হাতের কাজের মতো হয় না। সে রকম আঁটাআঁটি প্রবন্ধের বিশেষ আবশ্যক আছে, এ কথা কেউ অস্বীকার করিতে পারে না; কিন্তু সর্বত্র তারই বড়ো বাহুল্য দেখা যায়। সেগুলো পড়লে মনে হয় যেন সত্য তার সমস্ত সুসংলগ্ন যুক্তিপরম্পরা নিয়ে একেবারে সম্পূর্ণভাবে কোথা থেকে আবির্ভূত হলো। মানুষের মনের মধ্যে সে যে মানুষ হয়েছে, সেখানে তার যে আরো অনেকগুলি সমবয়সী সহোদর ছিল, একটি বৃহৎ বিস্তৃত মানসপুরে যে তার একটি বিচিত্র বিহারভূমি ছিল, লেখকের প্রাণের মধ্যে থেকেই সে যে প্রাণ লাভ করেছে, তা তাকে দেখে মনে হয় না; এমন মনে হয় যেন কোনো ইচ্ছাময় দেবতা যেমন বললেন, 'অমুক প্রবন্ধ হউক' অমনি অমুক প্রবন্ধ হলো : 'লেট দেয়ার বি লাইট অ্যান্ড দেয়ার ওয়াজ লাইট।'
প্রবন্ধে সংজ্ঞা রচনার গুরুত্ব সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেন, 'সংজ্ঞা রচনা করা যে দুরূহ তাহার প্রধান কারণ এই দেখিতেছি যে, একটি কথার সহিত অনেকগুলি জটিল ভাব জড়িত হইয়া থাকে, লেখকেরা সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞার মধ্যে তাহার সকলগুলি গুছাইয়া লইতে পারেন না- অনবধানতা দোষে একটা না একটা বাদ পড়িয়া যায়।'
রবীন্দ্র প্রবন্ধে সংজ্ঞা ও পার্থক্যবিচারে এর ভূমিকায় আমি বলি, 'লেখক তাঁর প্রবন্ধের যুক্তিসম্বন্ধ প্রতীয়মান করতে গিয়ে কোনো ক্ষেত্রে একটি শব্দ ব্যবহারের পূর্বে তার একটি সংজ্ঞা দিয়ে থাকেন, আবার কোনো ক্ষেত্রে দুটি সমার্থক শব্দ বা দুটি বিপরীতার্থক শব্দের পার্থক্য-নির্দেশ করে নিজের বক্তব্যকে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। গদ্য ও পদ্যের পার্থক্য রয়েছে, সে সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বেশ সচেতন ছিলেন। গদ্য লেখার সময় তিনি রীতিমত (তাঁর কথায়) লড়াই করতেন।'"
বাংলাভাষা পরিচয়ে কবি বলেন, 'খাঁটি বাংলা ছিল আদিম কালের সে বাংলা নিয়ে এখনকার কাজ ষোলো-আনা চলা অসম্ভব।' তাঁর কথা 'আমাদের শিক্ষার ক্ষেত্র যতই বাড়ছে ততই দেখতে পাচ্ছি, আমাদের চলতি ভাষার কারখানায় জোড়তোড়ের কৌশলগুলো অত্যন্ত দুর্বল।' তবে তিনি বলছেন, 'এ কথাও জেনে রাখা ভালো, খাস বাংলায় এমনসব বলবার ভঙ্গী যা আর কোথাও পাওয়া যায় না।' তাঁর কথা : 'আমাদের বোধশক্তি যে শব্দার্থজালে ধরা দিতে চায় না, বাংলা ভাষা তাকে সেই অর্থের বন্ধন থেকে ছাড়া দিতে কুণ্ঠিত হয়নি, আভিধানিক শাসনকে লঙ্ঘন করে সে বোবার প্রকাশ-প্রণালীকেও অঙ্গীকার করে নিয়েছে।'
১৩৪১ সালের বৈশাখে রবীন্দ্রনাথ 'গদ্যছন্দ' প্রবন্ধে বলেন, ''আজ সরস্বতীর আসনই বল, আর তাঁর ভাণ্ডারই বল, প্রকাণ্ড আয়তনের। সাবেক সাহিত্যের দুই বাহন, তার উচ্চৈঃশ্রবা আর তার ঐরাবত, তার শ্রুতি ও স্মৃতি; তারা নিয়েছে ছুটি। তাদের জায়গায় যে যান এখন চলল, তার নাম দেওয়া যেতে পারে লিখিতি। সে রেলগাড়ির মতো, তাতে কোনোটা যাত্রীর কামরা কোনোটা মালের। কোনোটাতে বস্তুর পিণ্ড, সংবাদপুঞ্জ, কোনোটাতে সজীব যাত্রী অর্থাৎ রসসাহিত্য। তার অনেক চাকা, অনেক কক্ষ; একসঙ্গে মস্ত মস্ত চালান। স্থানের এই অসংকোচে গদ্যের ভূরিভোজ।' ২৫ চৈত্র ১৩০১ সালে 'বাংলা জাতীয় সাহিত্য'-এ রবীন্দ্রনাথ বলেন, 'ছন্দের একটা অনিবার্য প্রবাহ আছে, সেই প্রবাহের মাঝখানে একেবারে ফেলিয়া দিতে পারিলে কবিতা সহজে নাচিতে নাচিতে ভাসিয়া চলিয়া যায়; কিন্তু গদ্যে নিজে পথ দেখিয়া গায়ে হাঁটিয়া নিজের ভারসামঞ্জস্য করিয়া চলিতে হয়, সেই পদব্রজ বিদ্যাটি রীতিমত অভ্যাস না থাকিলে চাল অত্যন্ত আঁকা-বাঁকা এলোমেলো এবং টলমলে হইয়া থাকে।'- বাংলা জাতীয় সাহিত্য ৮/৪১৮/৪১৯
হেমেন্দ্রবালা কেবীকে এক পত্রে রবীন্দ্রনাথ বলেন, 'মানবের ধর্মবিষয়টা নিয়ে অঙ্ফোর্ডে বক্তৃতা দিয়েছিলুম, সেটা বই আকারে বেরিয়েচে। বাংলা ভাষায় বক্তব্যটা সহজ করে তোলা সহজ নয়, চেষ্টা করতে হচ্ছে খুব বেশি করে।'- চিঠিপত্র ৯/১৮৮
রবীন্দ্রনাথের গান বা কবিতা, সুর বা ছন্দ, যেভাবে আমাদের মনকে স্পর্শ করেছে, তেমন করে তাঁর প্রবন্ধ আমাদের মনে সাড়া দেয়নি। আমি অন্যত্র বলি, 'রবীন্দ্র-প্রবন্ধের বিস্ময়কর বাঁধুনি ও চিত্তাকর্ষক প্রসঙ্গ-বৈচিত্র্য তেমন যেন আদর পায়নি। রবীন্দ্র-বাক্য বেদবাক্য নয়, তাঁর বক্তব্য সকলে স্বীকার করে নেবেন এমন কথাও নয়। কারো কাছে তাঁর কথায় কোথাও অত্যুক্তি, আবার কোথাও ঊনোক্তি ধরা পড়বে। কারো কাছে আবার তাঁর মন্তব্য বিনয়বিরুদ্ধ, বক্তব্য যুক্তিশাস্ত্রের পরখে অশাস্ত্রীয়ও মনে হতে পারে।' তাঁর রাজনৈতিক মত সম্বন্ধে শচীন্দ্রনাথ সেন ইংরেজিতে একটি বই লেখেন- 'পলিটিক্যাল ফিলসফি অব রবীন্দ্রনাথ'। এই বই সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, 'বইখানি পড়ে আমি নিজের মতের ঠিক চেহারাটা পেলুম না।' ওই গ্রন্থের আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রনৈতিক মত' প্রবন্ধে লিখেছিলেন : 'আমি জানি, আমার মত ঠিক যে কী তা সংগ্রহ করা সহজ নয়। বাল্যকাল থেকে আজ পর্যন্ত দেশের নানা অবস্থা এবং আমার নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দীর্ঘকাল আমি চিন্তা করেছি এবং কাজও করেছি। যেহেতু বাক্য রচনা করা আমার স্বভাব, সেইজন্যে যখন যা মনে এসেছে, তখনি তা প্রকাশ করেছি। রচনাকালীন সময়ের সঙ্গে, প্রয়োজনের সঙ্গে সেইসব লেখার যোগ বিচ্ছিন্ন করে দেখলে তার সম্পূর্ণ তাৎপর্য গ্রহণ করা সম্ভবপর হয় না। যে মানুষ সুদীর্ঘকাল থেকে চিন্তা করতে করতে লিখেছে তাঁর রচনার ধারাকে ঐতিহাসিকভাবে দেখাই সংগত।'
একদিকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'নিজের রচনা উপলক্ষে আত্মবিশ্লেষণ শোভন হয় না। তাকে অন্যায় বলা যায় এই জন্যে যে, নিতান্ত নৈর্ব্যক্তিকভাবে এ কাজ করা অসম্ভব- এইজন্য নিষ্কাম বিচারের লাইন ঠিক থাকে না।' আবার অপরদিকে নিজের লেখা সম্পর্কে ওকালতি করা ভদ্ররীতি নয় জেনেও প্রয়োজনে সেই প্রথার খাতিরে তাঁর দ্বারা ঔদাসীনের ভান করা হয়ে ওঠেনি। নিজের রচনা সম্বন্ধে বিচারক হওয়া বেদস্তুর জেনেও তিনি বলেছেন, দায়ে পড়লে ওকালতি করা চলে। আর বিপন্ন বোধ করলেও তিনি বেশ কোমর বেঁধেই ওকালতি করেছেন। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য বরাবরই বলে এসেছেন, ''নবসৃষ্টির যত দোষত্রুটিই থাকুক না কেন- মুক্তি কেবল ঐ কাঁটাপথেই- বাঁধা সড়ক গোলাপ ফুলের পাপড়ি দিয়ে মোড়া হলেও সে পথ আমাদের পৌঁছিয়ে দেবে শেষটায় চোরা গলিতেই।'' তাঁর মতে, অতীতকাল যত বড়ই হোক নিজের সম্বন্ধে বর্তমান কালের একটা স্পর্ধা থাকা উচিত, মনে থাকা উচিত তার মধ্যে জয় করবার শক্তি আছে। রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন কীর্তি থেকে প্রেরণা পেতে চেয়েছেন নিজের প্রাণে নবজন্মকে আহ্বান করার জন্য- নিজের চিত্তকে সাধনার বৃহৎ ক্ষেত্রে জাগরূক রাখবার জন্য। তার ওপর তিনি দাগা বুলোতে চাননি। তিনি বলতেন, ''অজন্তা কাংড়া ভ্যালি বা মোগল আর্টের উপর দাগা বুলিয়ে ব্যবসায়ী যাচনদারের কাছে ওরিয়েন্টাল আর্ট বলে খ্যাতি লাভ করলেও, এমন কেউ বেওকুফ নেই যে ঐ দাগা বুলিয়ে যাওয়াটাকেই শিল্প সাধনার চরম বলে মানবে।''
১৩৩৩ সালে 'সাহিত্য সম্মেলন' প্রদত্ত রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য দিয়ে এ প্রবন্ধের উপসংহার টানা যেতে পারে। 'বাংলাসাহিত্য আমাদের সৃষ্টি। এমন-কি, ইহা আমাদের নূতন সৃষ্টি বলিলেও হয়। অর্থাৎ ইহা আমাদের দেশের পুরাতন সাহিত্যের অনুবৃত্তি নয়। আমাদের প্রাচীন সাহিত্যের ধারা যে-খাতে বহিত, বর্তমান সাহিত্য সেই খাতে বহে না। আমাদের দেশের অধিকাংশ আচার-বিচার পুরাতনের নির্জীব পুনরাবৃত্তি। ... কেবল আমাদের সাহিত্যই নূতন রূপ লইয়া নূতন প্রাণে নূতন কালের সঙ্গে আপনযোগসাধনে প্রবৃত্ত। এইজন্য বাঙালিকে তাহার সাহিত্যই যথার্থভাবে ভিতরের দিক হইতে মানুষ করিয়া তুলিতেছে। ... বাঙালির চিত্তের আত্মপ্রকাশ একমাত্র বাংলা ভাষায়, এ কথা বলাই বাহুল্য। কোনো বাহ্যিক উদ্দেশ্যের খাতিরে সেই আত্মপ্রকাশের বাহনকে বর্জন করা, আর মাংস সিদ্ধ করার জন্য ঘরে আগুন দেওয়া, একই জাতীয় মূঢ়তা।'

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.