স্থানীয় উন্নয়ন-কেন এই অর্বাচীন সিদ্ধান্ত? by বদিউল আলম মজুমদার

শোনা যায়, সরকার সংসদ সদস্যদের প্রত্যেককে তাঁদের মেয়াদকালের জন্য স্থানীয় উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংসদ সদস্যরা এ টাকার পরিমাণ প্রকল্প সুপারিশ করবেন, যা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো বা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে ব্যয় করা হবে।


এ সিদ্ধান্তের লক্ষ্য হলো, নির্বাচনের আগে সংসদ সদস্যদের প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সহায়তা প্রদান করা।
আমাদের আশঙ্কা, এটি একটি অতি অর্বাচীন সিদ্ধান্ত—এটি গ্রহণের ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। উপেক্ষা করা হয়েছে ইতিহাসের শিক্ষাকেও। এ ছাড়াও এর মাধ্যমে সংবিধান পদদলিত হবে এবং আদালতের রায়কেও উপেক্ষা করা হবে। এর পরিণতিও অশুভ হতে বাধ্য।
আমাদের প্রতিবেশী ভারতে (এমপিএলএডি-Member of Parliament Legislative Area Development) এমন একটি স্কিম চালু আছে। ভারতের প্রতি লোকসভা ও রাজ্যসভার সদস্যকে বার্ষিক দুই কোটি রুপি স্থানীয় উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রদান করা হয়। এ অর্থও সরাসরি সংসদ সদস্যরা ব্যয় করেন না—জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমোদনে তা ব্যয় হয়।
দুর্ভাগ্যবশত ভারতীয় এ স্কিমের কার্যকারিতা সম্পর্কে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। ভারতীয় লোকসভার ‘পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি’র সাবেক চেয়ারম্যান এরা সেজ্যুইয়ানের মতে, ‘অল্প করে বলতে গেলে, এই স্কিমের ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত বিশৃঙ্খল। ধারণাগত দিক থেকেই এতে মৌলিক গলদ রয়েছে। সাধারণভাবে সংসদ সদস্যদের দায়িত্ব আইন প্রণয়ন এবং সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ। এমপিএলএডি স্কিম সংসদ সদস্যদের ভূমিকায়ই পরিবর্তন ঘটিয়েছে। তাঁদেরকে প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং প্রকল্প সম্পন্নের কাজে জড়িত করেছে। এ প্রক্রিয়ায় সংসদ সদস্যরা জেনে-শুনেই প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছেন এবং তারা লোকসভার সদস্য এবং সংসদীয় কমিটির সদস্য হিসেবে এ স্কিমের অধীনে তাঁর নিজের এবং সহকর্মীদের উদ্যোগে গৃহীত কার্যক্রম সম্পর্কিত ব্যয়ের সঠিকতা, প্রজ্ঞা ও কৃচ্ছ্রতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার যোগ্যতা ও নৈতিক অধিকার হারিয়ে ফেলেছেন। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে গত ৫০ বছরের সরকারের ব্যর্থতাকে সংখ্যা এবং বৈচিত্র্যের দিক থেকে ম্লান করে দিয়েছে এমপিএলএডি স্কিমের অধীনে সৃষ্ট মাত্র গত সাত বছরের অনিয়ম। এ স্কিম সম্পর্কে সরকারের দায়িত্ব এড়ানো এবং প্রশাসনে সংসদ সদস্যদের সম্পৃক্ততা সংসদের কাছে নির্বাহী বিভাগের দায়বদ্ধতাকে খর্ব করেছে এবং এভাবে রাষ্ট্রে সংসদীয় ব্যবস্থার কার্যকারিতাকেই দুর্বল করে তুলেছে।’ (ফ্রন্টলাইন, ১৫ মার্চ ২০০২)
ভারতীয় সংসদ সদস্যরা সরাসরি এ অর্থ স্পর্শ না করলেও, তাঁদের অনেকেই এর মাধ্যমে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনই প্রেক্ষাপটে এমপিএলএডি স্কিম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পাঁচজন সংসদ সদস্য কমিশন দাবি করছে, এমন ভিডিও গোপনে ধারণ করে স্টার নিউজ চ্যানেল ২০০৬ সালের ২৫ জানুয়ারি তা প্রচার করে। পরবর্তী সময়ে এ অভিযোগ তদন্ত করার লক্ষ্যে কিশোর চন্দ্র ডিও-এর নেতৃত্বে ভারতীয় লোকসভার একটি কমিটি গঠিত হয়। অভিযুক্তরা হলেন—এস এ চার্টিল, পরাশ নাথ ইয়াদেভ, এফ এ কুলসাতি, রামস্বরূপ কলি ও চন্দ্র প্রতাপ সিং। অর্থের বিনিময়ে সংসদে প্রশ্ন করার অভিযোগে সিং অন্য ১০ জন সদস্যসহ সংসদ থেকে ইতিমধ্যেই বহিষ্কৃত হন। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় কমিটি অন্য চারজনকেও তিরস্কার এবং লোকসভা থেকে সাময়িক বহিষ্কারের সুপারিশ করে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত ভিপি সিংসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় এ স্কিমের প্রবল বিরোধিতা করে আসছেন। অনেকের মতে, এ স্কিম ভারতীয় সংবিধানের ওপর একটি নগ্ন হামলা। এটি ব্যবহার করা হয়েছে আইনসভার সদস্যদের স্থানীয় উন্নয়ন কাজে সরাসরি জড়িত হওয়া থেকে বিরত রাখার লক্ষ্যে উেকাচ হিসেবে। এমনকি ভারতের সাবেক প্রধান বিচারপতি ভেনকেটাচালিয়ার নেতৃত্বে গঠিত ‘সংবিধান পর্যালোচনা কমিটি’ও এটি বাতিলের পক্ষে সুপারিশ করেছে। স্কিমটির বিরুদ্ধে বর্তমানে ভারতে ব্যাপক জনমত গড়ে উঠছে।
স্থানীয় উন্নয়ন কাজে জড়িত হওয়ার মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের দুর্নীতিতে যুক্ত হওয়ার বহু দৃষ্টান্ত আমাদের দেশেও রয়েছে। গত জোট সরকারের আমলে, বিশেষত ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্যদের ব্যাপকভাবে স্থানীয় উন্নয়নে জড়িত করা হয়। এর ফলে তাঁদের অনেকেই বহু অপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়েন। বস্তুত অনেক এলাকায় সংসদ সদস্যরা তাঁদের দলীয়, নেতা-কর্মী ও নিজের প্রতি অনুগতদের নিয়ে উপজেলা পর্যায়ে এক ধরনের অনানুষ্ঠানিক ‘এমপি সরকার’ প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন, যাঁরা আমলাতান্ত্রিক কাঠামোকে পাশ কাটিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন।
এ ধরনের কার্যক্রমের ফলে সংসদ সদস্যদের অনেকেই অত্যন্ত বিতর্কিত হয়ে পড়েন, যার বিরূপ প্রভাব ব্যাপকভাবে পড়েছে গত নির্বাচনে চারদলীয় জোটের মনোনীত প্রার্থীদের ক্ষেত্রে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে আমরা সুজনের (সুশাসনের জন্য নাগরিকে) উদ্যোগে ৮৭টি নির্বাচনী এলাকায় ‘ভোটার-প্রার্থী’ মুখোমুখি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম, যার অধিকাংশেই চারদলীয় জোট প্রার্থীরা অংশগ্রহণ করতে সাহস পাননি। সামান্য যে কয়টি নির্বাচনী এলাকায় তাঁরা উপস্থিত ছিলেন সেগুলোতেও তাঁদের ভোটারদের কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে।
নবম জাতীয় সংসদের নির্বাচনী ফলাফল থেকেই সংসদ সদস্যদের স্থানীয় উন্নয়নে জড়িত হওয়ার চরম নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। আমাদের হিসাব মতে, অষ্টম সংসদের ৪১ জন আওয়ামী লীগদলীয় সদস্য গত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সবাই বিজয়ী হন। পক্ষান্তরে বিএনপির ১২৯ জন সাবেক সংসদ সদস্য ১৩৭টি আসনে বিভিন্ন টিকিটে গত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, যাঁদের মধ্যে মাত্র ১৪ জন বিজয়ী হন। জামায়াতে ইসলামীর ১১ সাবেক সংসদ সদস্যই নির্বাচনে পরাজিত হন। অর্থাত্ ব্যাপকভাবে স্থানীয় উন্নয়ন করেও তাঁরা নির্বাচনে কচুকাটা হন এবং আমাদের ধারণা যে, উন্নয়নের নামে অপকর্মে জড়িত হওয়ার ফলেই আধিকাংশ ক্ষেত্রে তা ঘটেছে।
সংসদ সদস্যরা আইনসভার সদস্য। সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, তাঁদের দায়িত্ব আইন প্রণয়ন করা। পক্ষান্তরে সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, স্থানীয় উন্নয়ন স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব। উল্লেখ্য, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো নির্বাহী বিভাগের অংশ। তাই সংসদ সদস্যদের স্থানীয় উন্নয়নে জড়িত হওয়া সংবিধানের ওপর নগ্ন হামলার শামিল। সংবিধানের অধীনে যাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাঁর সে দায়িত্ব পালনে নিবিষ্ট হওয়ার ওপর বাধ্যবাধকতা রয়েছে (অনুচ্ছেদ-৭)। এ ছাড়াও সংসদ সদস্যরা আইনানুযায়ী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য (৫৯ অনুচ্ছেদ) নির্বাচিত নন, তাঁরা জাতীয় দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে জাতীয় সংসদের জন্য নির্বাচিত।
সংসদ সদস্যদের স্থানীয় উন্নয়ন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে জড়িত হওয়া যে সংবিধানের বরখেলাপ তা ইতিমধ্যেই উচ্চ আদালত বলে দিয়েছেন। গত জোট সরকারের আমলে একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ‘জেলা মন্ত্রী পদ’ সৃষ্টির ফলে সংসদ সদস্য হিসেবে নিজ এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারছেন না, এ অভিযোগে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ২০০৩ সালে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। ২০০৬ সালের প্রদত্ত রায়ে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ও বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর সুস্পষ্টভাবে বলেন, ‘মন্ত্রী, হুইপ এবং অন্যান্য কর্মকর্তা, যাঁদের কথাই উপরিউক্ত প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁদের কাউকেই উল্লিখিত কোনো জেলার জন্য নিয়োগ প্রদান করা যায় না। সংশ্লিষ্ট বিভাগের মন্ত্রী হিসেবে পুরো দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য দায়িত্ব ব্যতীত জেলাগুলোতে তাঁদের অন্য কোনো দায়দায়িত্ব নেই। একইভাবে সংসদ সদস্যদেরও জেলা বা অন্যান্য প্রশাসনিক একাংশে উন্নয়ন বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা ও দায়িত্ব নেই। অতএব, মামলার বাদী, যিনি একজন সংসদ সদস্য, পিরোজপুর জেলা সম্পর্কে তাঁর কোনো দায়দায়িত্ব নেই’ [আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বনাম বাংলাদেশ, ১৬ বিএলটি (এইচসিডি) (২০০৮)]।
ওপরের আলোচনা থেকে এটি সুস্পষ্ট, সংসদ সদস্যদের স্থানীয় উন্নয়নে জড়িত হওয়া সংবিধানের গুরুতর লঙ্ঘন। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ও বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবিরের রায়ের ফলে এ সম্পর্কে সব সন্দেহের অবসান ঘটেছে। তাই সংসদ সদস্যদের উপজেলা পরিষদের ওপর নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা প্রদান এবং স্থানীয় উন্নয়নের নামে তাঁদের ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হবে আইনের শাসনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। আর আইনের শাসন যেখানে থাকে না, সেখানে জঙ্গলের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সামরিক শাসকদের ক্ষমতা দখলের পথ সুগম হয়।
আমাদের আশঙ্কা, সংসদ সদস্যদের স্থানীয় উন্নয়নে জড়িত করার পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। এর মাধ্যমে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে। অতি ক্ষমতাধর সংসদ সদস্যদের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষমতাধর স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকা সম্ভব নয়। উপজেলা নিয়ে গত এক বছরের অভিজ্ঞতা যার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। প্রসঙ্গত, সংসদ সদস্যদের প্রতেককে ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদানের প্রস্তাব করা হলেও, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো সরকার থেকে সামান্য অর্থই পেয়ে থাকে। যেমন—প্রতি ইউনিয়ন পরিষদ সরকার থেকে বার্ষিক পাঁচ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকার বেশি এডিপি বরাদ্দ পায় না।
সংসদ সদস্যরা স্থানীয় উন্নয়নে জড়িত হলে আমাদের সংসদও অকার্যকর হয়ে যাবে। কারণ, সংসদীয় দায়িত্ব পালনে সংসদ সদস্যদের তেমন কোনো আগ্রহ থাকবে না। ইতিমধ্যেই সংসদে আমরা কোরাম সংকট দেখছি। অনেকের নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা, স্থানীয় পর্যায়ে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ এবং বিভিন্ন তদবিরে সময় ব্যয়ের পর সংসদীয় দায়িত্বে মনোনিবেশের জন্য তাঁদের সামান্য সময়ই হাতে থাকবে। ফলে সংসদীয় কমিটিগুলোর মাধ্যমে সরকারের স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজটি চরমভাবে ব্যাহত হবে। এভাবে একটি কার্যকর সংসদ প্রতিষ্ঠার সার্বজনীন আশা দুরাশাতেই পরিণত হবে।
এ ছাড়া, সরাসরি বরাদ্দ না পেলেও এমপিএলএডি স্কিমের অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যরা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়তে পারেন। যেমন ঘটেছে প্রতিবেশী দেশ ভারতে। এসব বরাদ্দ ফায়দা হিসেবে ব্যবহূত হতে পারে, যার বিরূপ প্রভাব আগামী নির্বাচনে পড়তে বাধ্য। তাই সংসদ সদস্যদের স্থানীয় উন্নয়নে জড়িত করে ভবিষ্যতে তাঁদের পুনর্নির্বাচন নিশ্চিত করার আকাঙ্ক্ষায় গুড়ে বালি পড়তে পারে। নবম জাতীয় সংসদের নির্বাচনের অভিজ্ঞতা অন্তত তা-ই বলে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।

No comments

Powered by Blogger.