আমার ভাষা আমার একুশ-বাংলা ভাষা গবেষণা: প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ প্রয়োজন by সৌরভ সিকদার

আঠারো শতকের শুরুতে ইউরোপীয় তথা অবাঙালিদের হাতে বাংলা ভাষাবিষয়ক গবেষণার সূচনা হলেও ক্রমে ক্রমে উনিশ শতকের শেষ দিকে এসে বাংলা ভাষা-চর্চা এবং গবেষণার দায়িত্ব নেয় বাঙালিরা। আর এ বিষয়ে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নিয়েছিল ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষত্’ ১৮৯৩ সালে।


১৮৭২ সালে জন বিমসের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়ন ও অনুশীলনের জন্য একাডেমি স্থাপনের যে প্রস্তাব ছিল, তারই ফল হচ্ছে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষত্’। বাংলা ভাষা-চর্চা ও গবেষণা বিষয়ে জন বিমস্ তাঁর উপলব্ধি সম্পর্কে এক প্রবন্ধে জানিয়েছেন, ‘অতএব বাংলা সাহিত্যে ভাষার স্থিরতা বিধান করার জন্য সকল বাঙালি মিলিত হইয়া সভা স্থাপন করত এ দ্বারা ভাষার উন্নতি সাধন করা আবশ্যক।’ আমরা জানি, আঠারো-উনিশ শতকে বাংলা ভাষার গবেষণা ছিল মূলত অভিধান-ব্যাকরণ-পরিভাষা প্রণয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ। উনিশ শতকের শেষভাগে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাংলা ভাষাবিষয়ক রচনায় (শব্দতত্ত্ব, বাংলা ভাষা পরিচয় প্রভৃতি) ভাষা গবেষকের মেধা ও মননশীলতার পরিচয় রাখেন।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৮৯৪ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষত্ পত্রিকা বাংলা ভাষা বিষয়ে সচেতনভাবেই নানা গবেষণা ও মননশীল রচনা প্রকাশ করতে থাকে। এই পত্রিকার লেখকেরা বিশুদ্ধ ভাষাতাত্ত্বিক না হয়েও বাংলা ভাষার নানামুখী বিশ্লেষণে তাঁদের আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার পরিচয় তুলে ধরেছেন। এ কাজে যাঁরা সম্পৃক্ত ছিলেন তাঁদের কয়েকজনের নাম না উল্লেখ করলেই নয়—দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এবং আরও পরে বিশ শতকের প্রায় মাঝামঝি সময়ে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ। পাকিস্তান আমলে এ দেশে বাংলা ভাষা-চর্চার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য পত্রিকা। সাহিত্য সমালোচনার পাশাপাশি এই পত্রিকা বাংলা ভাষাবিষয়ক অসংখ্য গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করেছে এবং এখনো করে আসছে।
প্রায় একই সময় বাংলা একাডেমী যাত্রা শুরু করে বাংলা ভাষাবিষয়ক গবেষণা ও গ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। এ পর্বে বাংলা ভাষা বিষয়ে গবেষণায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন—মুহাম্মদ এনামুল হক, মুহাম্মদ আবদুল হাই, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুুরী, মুনীর চৌধুরী, চার্লস ফার্গুসন, কাজী দীন মুহম্মদ, আফিয়া দিল, আনোয়ার এস দিল, আহমদ শরীফ, রফিকুল ইসলাম প্রমুখ। উল্লেখ্য, এ সময়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, ইংল্যান্ডের সোয়াস এবং আমেরিকার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়েও বাংলা ভাষাবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা হয়েছে। এ পর্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মূলত ইংরেজি ভাষায় বাংলা গবেষণা, যা বাংলার পাঠক ও ভাষা উত্সাহীদের মধ্যে কিছুটা হলেও ভাষিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রেখেছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বাংলা-চর্চা ও গবেষণায় তেমন উত্সাহ ও গতি সঞ্চারিত হয়নি। মূলত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ পত্রিকা, এশিয়াটিক সোসাইটি পত্রিকা, বাংলা একাডেমী গবেষণা পত্রিকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা এবং বাংলা ভাষা সমিতির উদ্যোগই ছিল এ দেশে বাংলা ভাষা গবেষণার প্রধান ক্ষেত্র্র। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর প্রায় চার দশকেও উল্লেখ করার মতো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, যা বাংলা ভাষা-চর্চা ও গবেষণাকে অগ্রসর করেছে বলে দাবি করতে পারে। মূলত বানান, লিপি সংস্কার, পরিভাষা প্রণয়ন, প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার প্রয়োগমূলক কিছু খণ্ড খণ্ড প্রয়াস পরিলক্ষিত হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন থেকে। তবে বাংলাদেশে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় অনেকে ভাষাবিষয়ক গবেষণা করেছেন, করছেন। এঁদের মধ্যে প্রয়াত ভাষাবিজ্ঞানী ও লেখক হুমায়ুন আজাদের নাম না উল্লেখ করলেই নয়। যিনি বিদেশ থেকে ভাষাবিজ্ঞানের উচ্চতর তত্ত্ব ও জ্ঞান আত্মস্থ করে বাংলা ভাষায় বাংলা নিয়ে গবেষণা প্রবন্ধ ও গ্রন্থ রচনা করে আমাদের বাংলা ভাষা গবেষণার অনুর্বর ক্ষেত্রকে চাষাবাদ উপযোগী করে তুলেছেন। এ ছাড়া রফিকুল ইসলাম, আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ, মনিরুজ্জামান, মনসুর মুসা, মুহম্মদ দানীউল হক, আজিজুল হক ও রাজীব হুমায়ুন বাংলা ভাষা গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন।
ভাষাবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও গবেষক জীনাত ইমতিয়াজ আলী জানান, ‘হাতের কাছে সহজে পাওয়া যায়, এমন সব গ্রন্থের একটি তালিকা তৈরি করতে গিয়ে দেখলাম, শুধু বাংলা ভাষা বিষয়ে গ্রন্থই রয়েছে ৪০টি। বিস্তৃত অনুসন্ধানে এ সংখ্যা অবশ্যই বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশে বাংলা ভাষা গবেষণার পরিচয়ে তাই আমি আশাহত নই মোটেও। বাংলা ভাষার সব বিষয়েই আমাদের গবেষকেরা কৌতূহলী এবং নিজেদের বিবেচনা উপস্থাপনে সনিষ্ঠ। গবেষকদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত ভাষাবিজ্ঞানীরা যেমন আছেন, তেমনি রয়েছে অনেক নবীন ও প্রতিভাদীপ্ত গবেষক। রাজধানী থেকে দূরে অবস্থান করেও অনেকে শুধু ভাষাপ্রেমের জন্য গবেষণায় চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে লক্ষণীয়, প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের বিষয়টি আমাদের গবেষকদের এখানো মনোযোগ কাড়েনি। ব্যক্তিগত কিংবা গোষ্ঠীগত বাণিজ্যবুদ্ধি-প্রণীত হয়ে অনেকে তা করেছেন বটে, কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। স্বীকার করতেই হবে, এ জাতীয় কাজ ব্যক্তিক উদ্যোগে সম্ভবপর নয়। এ জন্য সবার আগে দরকার প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা ও সহায়তা।’
বর্তমানে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভাষাবিজ্ঞান পত্রিকা’ এবং আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট পত্রিকা দুটি বাংলাদেশের শুধু ভাষাবিষয়ক গবেষণার নিয়মিত প্রকাশনা। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, পশ্চিমবঙ্গসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও বর্তমানে বাংলা ভাষা বিষয়ে গবেষণা হচ্ছে। এ কথা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত পরিতাপের যে ভাষার অধিকারের দাবিতে যে দেশের সৃষ্টি হয়েছে, সেই দেশে শুধু ভাষা-চর্চা বা গবেষণার জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গড়ে ওঠেনি, স্বাধীনতার চার দশকেও না। এমনকি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট জন্ম নিলেও নানা রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক কারণে দীর্ঘ ১০ বছরেও তা সচল করা সম্ভব হয়নি। বাংলা ভাষা নিয়ে এ দেশে গবেষণাকর্মের জন্য কোনো বৃত্তি বা অর্থ-অনুদান দেওয়ার কোনো সংস্থা নেই, নেই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা।
আজ ভাষা-চর্চা শুধু ভাষার অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নয়, মানব মস্তিষ্কের ভাষিক এলাকা থেকে শুরু করে ভাষাবৈকল্যের চিকিত্সা পর্যন্ত এখন এর আওতাধীন। কাজেই জ্ঞানের ক্রম সমপ্রসারণের এই বিশ্বে বাংলা ভাষা বিষয়ে নতুন নতুন গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করতে না পারলে আমরা আরও পিছিয়ে যাব। একুশ শতকে বাংলা ভাষা এবং প্রযুক্তিকে পরস্পরের সহযোগী করে তুলতেও বাংলা ভাষা নিয়ে ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলে আমরা মনে করি। এ বিষয়ে রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হতে হবে। না হলে রক্তের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের একুশের গৌরব এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সব অর্জন ম্লান হয়ে যাবে।
সৌরভ সিকদার: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.