ছাত্ররাজনীতি-প্রশ্নটি মূলত আইন প্রয়োগের by মশিউল আলম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত নিরীহ সাধারণ ছাত্র আবু বকর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ-ছাত্রশিবিরের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হোসেন বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতির থাকা না-থাকার যুক্তি ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কারণ হয়েছেন।
প্রথম আলোর ‘টেলিফোনে নাগরিক মন্তব্য’ আয়োজনে অনেক পাঠক সরাসরি ও প্রকারান্তরে মত দিয়েছেন ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা উচিত। মা-বাবারা দেশে ছাত্ররাজনীতি থাকল কি থাকল না তা নিয়ে মাথা না ঘামালেও মনেপ্রাণে চান, তাঁদের নিজের সন্তান যেন ওসবে না জড়ায়। নাগরিক সমাজের অনেকেই মনে করেন, ছাত্ররাজনীতি যেভাবে ধ্বংসাত্মক ও রক্তক্ষয়ী হয়ে উঠেছে, এতে তা এখন বন্ধ করে দেওয়াই ঠিক হবে। কিন্তু সমাজের বড় বড় মানুষ সবাই তেমন কথা বলছেন না। গত রোববার প্রথম আলোয় দুজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ ও অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার ভাবনাটিকেই নাকচ করে দিয়েছেন। এমাজউদ্দীন আহমদ বলেছেন, শিক্ষাঙ্গনগুলোতে ছাত্ররাজনীতি থাকতে হবে; ‘যে রাজনীতি প্রচলিত থাকলে ছিনতাই, রাহাজানি, টেন্ডারবাজি ইত্যাদি সচেতন ছাত্রছাত্রীদের কাছে অরুচিকর বলে পরিত্যাজ্য হবে, যে রাজনীতি প্রাণবন্ত থাকলে ভর্তি-বাণিজ্য, আসন-বাণিজ্য বা শিক্ষকদের সঙ্গে অসদাচরণ ঘৃণ্য ও জঘন্য কাজ বলে ধিক্কৃত হবে, সেই রাজনীতি আজ বেশি করে প্রয়োজন।’ আনিসুজ্জামান ছাত্ররাজনীতি কলুষিত হয়ে গেছে মন্তব্য করে বলেছেন, ‘সন্ত্রাস বন্ধ করতে গিয়ে যদি আমরা ছাত্ররাজনীতিকে বন্ধ করতে চাই, তাহলে তা হবে স্নানের জলের সঙ্গে শিশুকে ফেলে দেওয়ার সমতুল্য।’ তিনি ছাত্ররাজনীতিকে কলুষমুক্ত করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
শ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদদের এসব কথাকে তাত্ত্বিক কথা বলে মনে হতে পারে। শুধু শিক্ষাঙ্গনে নয়, ছাত্ররাজনীতি যে দেশজুড়েই একটা বড় জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে—তা থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোনো বাস্তবিক পথের দিশা এ থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। নিকট-ভবিষ্যতে, অল্প কয়েক বছরের মধ্যে ছাত্ররাজনীতিকে কলুষমুক্ত করে তার আগের ঐতিহ্যে ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব—এমন দুরাশা কেউ করেন বলে বিশ্বাস হয় না। কিন্তু সমস্যাটির সমাধানের উদ্যোগ অবশ্যই নেওয়া উচিত। এভাবে আর চলতে পারে না, চলতে দেওয়া যায় না।
সমস্যার মূলে আছে বল-প্রয়োগ। প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনগুলো বা একই ছাত্র সংগঠনের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যকার বিরোধ নিষ্পত্তির কৌশল হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে বল-প্রয়োগ বা সন্ত্রাসকে। সংঘাত-সংঘর্ষ ছাড়া অন্য কোনো উপায় তারা দেখে না। মারাত্মক ধারালো অস্ত্রপাতি, আগ্নেয়াস্ত্র, বোমা ইত্যাদির ব্যবহার ছাত্র সংগঠনগুলোর তত্পরতাকে প্রাণঘাতী ও ধ্বংসাত্মক করে তুলেছে। এটা তাদের নিজেদের জন্যই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু এত বড় ঝুঁকি তারা নেয় কেন? বড় বড় প্রাপ্তির লোভে। অনেক ছাত্রনেতা ছাত্ররাজনীতি করতে করতেই কোটিপতি হয়ে যায়। ছাত্রত্ব থাক না থাক, ছাত্রসংগঠনের পদ তারা আঁকড়ে থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার, বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন এলাকার দোকানপাটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংগঠনের নামে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি শুধু শিক্ষাঙ্গন ও তার সংলগ্ন এলাকাগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। পাড়ায়-মহল্লায়, মার্কেটে, সরকারি দপ্তরে যেখানেই কোনো না কোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলে, সেখানেই তাদের তত্পরতা থাকে। এটা জেলা-উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যন্ত বিস্তৃত। সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা এমনকি পাড়ায়-মহল্লায় লোকজনের ঘরবাড়ি বানানোতেও বাধা দেয়, যদি তাদের চাঁদা দেওয়া না হয়।
অর্থাত্ ছাত্র সংগঠনগুলোর চেহারা কার্যত দাঁড়িয়েছে সংঘবদ্ধ অপরাধীচক্রের মতো। পার্থক্য এই, পেশাদার সংঘবদ্ধ অপরাধীদের বিরুদ্ধে দেশের আইন কমবেশি কাজ করে, ছাত্র সংগঠনগুলোর ক্ষেত্রে তা করে না। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ছিনতাই, অপহরণ, অবৈধ অস্ত্র রাখা ও ব্যবহার করা, মানুষ হত্যা করা—এসব অপকর্ম কি নিষিদ্ধ নয়? দণ্ডনীয় অপরাধ নয়? অবশ্যই গুরুতর দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু ছাত্র সংগঠনের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে এসব অপরাধ করলে বিচারের মুখোমুখি হতে হয় না। বরং সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন এসব অপকর্মে সরকারের নীরব প্রশ্রয় পায়। আর যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তখন প্রজাতন্ত্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সরকারি ছাত্র সংগঠনের সহযোগী বাহিনীর ভূমিকা নেয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটা আরেকবার দেখা গেল: ছাত্রশিবিরের সঙ্গে ছাত্রলীগ গুলিগোলায় পেরে উঠছিল না, পুলিশ বাহিনী ছাত্রলীগের সহযোগী হয়েছিল। একপর্যায়ে ছাত্রলীগ রণে ভঙ্গ দিয়ে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যায়, তখন ছাত্রশিবিরের সামনে থাকে শুধু পুলিশ বাহিনী। দুই সশস্ত্র বাহিনী রাতভর গোলাগুলি চালায়, প্রায় পাঁচ শ রাউন্ড গুলি ফোটে। এটা রাজনীতি? না। এটা রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘবদ্ধ সশস্ত্র দুর্বৃত্তচক্রের বন্দুকযুদ্ধ। ছাত্রলীগের বেলায়ও একই কথা। ওই সংঘর্ষে তাদের হাতেও আগ্নেয়াস্ত্র ছিল।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষের ঘটনার পর দেশজুড়ে জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে যে ব্যাপক দমন-অভিযান শুরু হয়েছে, তা যদি রাজনৈতিক লক্ষ্যাভিমুখী হয়, তাহলে শেষ পর্যন্ত সুফল ফলবে না। তাদের রাজনীতি নির্মূল করা অসম্ভব। প্রয়োজন তাদের কৃত অপরাধের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করা। তারা যেসব ষড়যন্ত্রমূলক ও নৃশংস কৌশলে নিজেদের রাজনৈতিক শক্তি ও প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে, সেই খুন-সন্ত্রাস, হলে হলে দখলদারি, সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর জবরদস্তি—এই সব দণ্ডনীয় অপরাধের আইনানুগ বিচার করাই সরকারের যথার্থ দায়িত্ব।
কিন্তু শুধু জামায়াত-শিবির বা প্রতিপক্ষ বিএনপি-ছাত্রদলের অপরাধ-অপকর্মের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করলেই তা নৈতিকভাবে নায্য হয় না, যদি ছাত্রলীগের যেসব নেতা-কর্মী সন্ত্রাসসহ নানা অপরাধ-দুষ্কর্মে লিপ্ত, তাদেরও একইভাবে আইনের আওতায় আনা না হয়। ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি, আত্মঘাতী সংঘাত-সংঘর্ষের ফলে সরকারের মানমর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে—এটাই মূল উদ্বেগের বিষয় হওয়া উচিত নয়। তাদের দ্বারা অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, এটাই প্রধান কথা। প্রধানমন্ত্রী খেদ-অসন্তোষ প্রকাশ করলেন, ছাত্রলীগের সাংগঠনিক প্রধানের পদটি ত্যাগ করলেন এবং অনেকবার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেন—কিন্তু ছাত্রলীগের একটুও বোধোদয় হলো না। কারণ এ রকম কথাবার্তার মধ্যে স্নেহ-প্রশ্রয়সুলভ মনোভাবের প্রকাশ ঘটে; বেয়াড়া ছেলেরা ঠিক তা ধরে ফেলতে পারে; এবং তারা জানে, তাদের বিরুদ্ধে আইন কাজ করবে না। তাই তো এত কথা, এত হুঁশিয়ারির পরও ছাত্রলীগের অপরাধকর্ম কমছে না।
ছাত্ররাজনীতির কথা বললে শিক্ষক-রাজনীতির কথাও এসে পড়ে—যেভাবে কান টানলে মাথা আসে। জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর কথাও বাদ যায় না। ছাত্রলীগ-ছাত্রদল-ছাত্রশিবির সন্ত্রাস-রক্তপাত করছে বলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি তুললে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী প্রভৃতি দলও নিষিদ্ধ করার দাবি কেউ তুলতে পারেন। কারণ এই দলগুলোও বেশ সন্ত্রাস করে, অনেক রক্তপাত ঘটায়। শুধু তা-ই নয়, দলগুলো দেশজুড়ে শান্তিভঙ্গ করে, মানুষের অবর্ণনীয় ভোগান্তির কারণ হয়, অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি করে।
ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করলে কাগজে-কলমে নিষিদ্ধ হতে পারে, বাস্তবে হবে না। সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ আইন অনুযায়ী ছাত্র সংগঠনগুলো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন নয়; কিন্তু তাতে কি ছাত্রলীগ, ছাত্রদল বা ছাত্রশিবিরের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সম্পর্কে কোনো হেরফের ঘটেছে? এটা একটা সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে যে ছাত্র সংগঠনগুলো বড় রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি করবে। দলগুলো এটা সহজে ছাড়বে না; ছাত্রসংগঠনগুলোও নয়। তাই অদূর-ভবিষ্যতে এ সংস্কৃতি বদলানো সম্ভব—এটা দুরাশা। কিন্তু আইন প্রয়োগ করা কোনো সংস্কৃতির ব্যাপার নয়। এটা সরকারের দায়িত্ব, খুব বাস্তব ব্যাপার, বিমূর্ত কিছু নয়। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, হল দখল, ক্যাম্পাসে আধিপত্য, সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর জবরদস্তি—এই সব অপরাধ করে ছাত্রলীগসহ কোনো ছাত্র সংগঠনের একটি ছেলেও আইনের হাত থেকে নিস্তার পাবে না, এটা নিশ্চিত করা হলে মাস্তান ছেলেরা ছাত্ররাজনীতি ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে।
শিক্ষাঙ্গনে দেশের প্রচলিত সব আইনকে কমবেশি অকার্যকর করে রাখা হয়েছে বলেই তরুণ-যুবক বয়সের সব ধ্বংসাত্মক প্রবণতা ও অপরাধবৃত্তি চেপে বসেছে ছাত্ররাজনীতির ওপর। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে আইন প্রয়োগের মধ্য দিয়ে ছাত্ররাজনীতির এই ‘কলুষ’ দূর করা সম্ভব। সরকারের আন্তরিক সদিচ্ছা থাকলেই এটা সম্ভব, এ ছাড়া আর কোনো পথ সম্ভবত খোলা নেই।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.