বংশগত রোগ থ্যালাসেমিয়া by মাহমুদ এ. চৌধুরী আরজু

৮ মে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার খসড়া রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে বিটা থ্যালাসেমিয়া (ইমোগ্গ্নোবিন-ই) এবং হিমোগ্গ্নোবিন-ই বিটা থ্যালাসেমিয়া রোগীর সংখ্যা বেশি। এ ছাড়া থ্যালাসেমিয়া ইন্টারমিডিয়া ও থ্যালাসেমিয়া মাইনর বা ট্রেইট অথবা এদের সংমিশ্রণে দেখা দেওয়া অন্যান্য রোগের প্রাধান্যও যথেষ্ট।


খুব অল্পসংখ্যক আলফা থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীর অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। তবে এ রোগে আক্রান্ত ও বাহকের সংখ্যা সঠিকভাবে বলা মুশকিল। মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকের কাছে এ রোগের প্রকোপ কিছুটা বেশি। কারণ এদের নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কটা অন্য সম্প্রদায়ের লোকের চেয়ে একটু বেশি। এ রোগটি বংশগত। ২০০৩ সালে থ্যালাসেমিয়া সেবাকেন্দ্র-বাংলাদেশ ও থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন কলকাতা যৌথভাবে প্রায় ২০০ জন থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীর বিভিন্ন ধরন চিহ্নিতকরণে যে অভিযান পরিচালনা করে তাতে দেখা যায়, তাদের মধ্যে ৫৮ জন বিটা থ্যালাসেমিয়া, ১২৩ জন ই-বিটা থ্যালাসেমিয়া এবং বাকি ১৯ জন অন্যান্য থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার কত লোক হিমোগ্গ্নোবিন-ই'র জিন বহন করছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪ শতাংশ অর্থাৎ ৫.২ মিলিয়ন লোক হিমোগ্গ্নোবিন-ই জিন বহন করে। বাংলাদেশে বিটা থ্যালাসেমিয়া থেকে হিমোগ্গ্নোবিন-ই বিটা থ্যালাসেমিয়ার সংখ্যা অনেক বেশি। গোটা বিশ্বে প্রতি বছর ২৫ লাখ শিশু জন্ম নিচ্ছে হিমোগ্গ্নোবিন-ই বিটা-থ্যালাসেমিয়া নিয়ে আর বাংলাদেশে প্রতি বছর জন্ম নিচ্ছে প্রায় ৫-৬ হাজার শিশু। বিশ্বে ১০০ মিলিয়নের বেশি লোক বিটা থ্যালাসেমিয়া জিন বহন করে জন্ম নিচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালিকা থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে ৪ শতাংশ লোক বিটা থ্যালাসেমিয়ার বাহক অর্থাৎ ৪.৫ মিলিয়ন লোক বিটা থ্যালাসেমিয়া জিন বহন করছে। অতএব দেখা যায়, বাংলাদেশে বিদ্যমান বিটা থ্যালাসেমিয়া এবং হিমোগ্গ্নোবিন-ই'র জিন বহনকারী লোকের মোট জনসংখ্যা ১০.৩ মিলিয়ন বা ৯৫ লাখ। বাংলাদেশে প্রায় ৭০ শতাংশ লোকই ক্রনিক প্রকৃতির অ্যানিমিয়া হবে। কিন্তু বাকি ৩০ শতাংশের ক্ষেত্রে অ্যানিমিয়াই ধরা পড়ে না। এরা প্রায় স্বাভাবিকের মতোই জীবনযাপন করে। এই ৩০ শতাংশ লোক সারাজীবন জানতে পারে না যে, তারা কোন ধরনের থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা ও রোগীর ব্যবস্থাপনা অনেক উন্নত। ফলে প্রতি ধাপে রোগীর ঠিকমতো যত্ন নেওয়া সম্ভব। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, আমাদের দেশে উন্নত চিকিৎসা তো দূরে থাক, এখনও পর্যন্ত থ্যালাসেমিয়া 'বাহক' চিহ্নিতকরণ অভিযান ঠিকমতো শুরু হয়নি। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব থ্যালাসেমিয়া বাহক চিহ্নিতকরণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে থ্যালাসেমিয়া হাসপাতাল ও রিসার্চ সেন্টার গড়ে তুলতে হবে। যদি এখন থেকে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয় তবে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের দেশে থ্যালাসেমিয়া রোগের প্রকোপ ঠিক আগের সাইপ্রাসের মতো হবে_ এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবসে আমাদের (অভিভাবক) সরকারের কাছে কিছু সুপারিশ করা হলো_ ১. থ্যালাসেমিয়া রোগীদের যেহেতু অন্যের রক্ত গ্রহণ করে বেঁচে থাকতে হয়, তাই স্বল্পমূল্যে পর্যাপ্ত পরিমাণ নিরাপদ রক্তের ব্যবস্থা করা। ২. দূষিত রক্ত সরবরাহকারী সব বাণিজ্যিক অবৈধ ব্লাডব্যাংক বন্ধ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং স্বেচ্ছা রক্তদানকারী সংস্থাগুলোকে সহযোগিতা ও উৎসাহিত করা। ৩. থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের জন্য গর্ভকালীন মায়েদের শনাক্তকরণের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনশক্তি কেন্দ্র স্থাপন করা। প্রি-নেটাল ডায়াগনোসিস ও ডিএনএ অ্যানালাইসিস সেন্টার স্থাপন করা। ৪. এবহবঃরপ ঈড়ঁহংবষরহম বিশেষ করে, বিবাহের আগে পাত্রপাত্রী থ্যালাসেমিয়ার বাহক কি-না তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিনামূল্যে বাধ্যতামূলক ঐন ঊষবপঃৎড়ঢ়যড়ৎবংরং পরীক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ৫. জনগণের মধ্যে এই রোগ চিহ্নিতকরণের জন্য স্ক্রিনিং টেস্টের ব্যবস্থা করা। ৬. হিমোগ্গ্নোবিন ডিসঅর্ডারের বাহক এবং আক্রান্ত রোগীদের বংশ বিষয়ক পরামর্শ দেওয়া। ৭. স্বল্পমূল্যে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের মধ্যে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস ভ্যাকসিন সরবরাহ করা।

প্রফেসর ডা. মাহমুদ এ. চৌধুরী আরজু
প্রধান ফিজিশিয়ান (অবৈতনিক)
থ্যালাসেমিয়া সেবাকেন্দ্র

No comments

Powered by Blogger.