মানুষের মুখ-কণ্ঠে মাটির কথা, মানুষের গান by বিশ্বজ্যোতি চৌধুরী

সংসারে তাঁর অভাব-অনটন লেগেই আছে। সহধর্মিণী আইরিন বেগম সব দিন সন্তানদের আহারের সংস্থান করতে পারেন না। এই নিয়ে খুব একটা ভাবেন না শাহ দরবেশ আলী বাউল। টুং-টাং শব্দে একতারা কিংবা দোতারা হাতে বিরহ-প্রেম-বিচ্ছেদ, মাটি-নদী-বৃক্ষ কিংবা মানুষের চলমান জীবন নিয়ে পদ্য রচনা করে তাতে সুর দেওয়াটাই দরবেশ আলী বাউলের কাছে মুখ্য। বাদবাকি সবই গৌণ।


মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার কালাপুর ইউনিয়নের কাকিয়াবাজার গ্রামে এই বাউলশিল্পীর নিবাস। ছন-বাঁশের কুঁড়েঘরের বৈঠকখানায় বসে তিনি গীত রচনা করেন আপনমনে। সমাজের, গ্রামের কিংবা পরিবারের বৈষয়িক বিষয়গুলো একেবারেই যে তাঁর নজরে আসে না এমন নয়।
পরিবার, সমাজ, গ্রামসহ নানা স্তরে পথ চলতে গিয়ে যেসব অসংগতি দাগ কাটে এই বাউলের বাউলা মনে সেখানেই তিনি থমকে যান। উত্তরণের পথ খোঁজেন। পেয়েও যান। রচনা করেন পদ্য। তাতে সুরের প্রলেপ দিয়ে মানুষের দরবারে পেশ করেন। সেসব গান শুনে গ্রামের মানুষ কখনো কাঁদে, কখনো হাসে, কখনো বা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। সেখানেই তো দরবেশ বাউলের সার্থকতা।
মৌলভীবাজার জেলায় যে কজন খ্যাতিমান বাউলশিল্পী আছেন শাহ দরবেশ আলী তাঁদেরই একজন। বাবা শাহ সুন্দর আলী বাউলের হাত ধরে তাঁর বাউল-জগতে পদার্পণ। প্রয়াত শাহ সুন্দর আলী বাউল ছিলেন আব্বাসউদ্দীনের ভাবশিষ্য। দেশখ্যাত বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের সমসাময়িক শাহ সুন্দর আলী বাউল সিলেট অঞ্চলের মানুষের কাছে একটি পরিচিত নাম। সিলেট বিভাগের আনাচকানাচে তিনি গান গেয়ে ফিরেছেন। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে দরবেশ আলীও গান গেয়েছেন বিভিন্ন আসরে।
বাবার প্রতি মানুষের ভালোবাসা দরবেশকে বাউলজীবনে আকৃষ্ট করেছে। পাঁচ ভাই, চার বোনের মধ্যে শুধু তিনিই একতারা-দোতারা হাতে সুরকে অবলম্বন করে জীবিকার সন্ধানে নেমেছিলেন—সেই কৈশোরে। কিন্তু জীবনের এই পর্যায়ে এসে মানুষের ভালোবাসার ওই মোহতে চিড় ধরেছে। গাঁও-গেরামে, শহর-গঞ্জে আগের মতো এখন আর পালা হয় না, বসে না আসর- আসে না ডাক। তবুও সহজ-সরল, মৃদুভাষী ও বিনম্র স্বভাবের এই বাউলের কণ্ঠে মাটির কথা, মানুষের গান। তিনি বলেন, ‘এই গানই আমার জান, এই সুরই আমার প্রাণ’।
শাহ দরবেশ আলী জানান, বাবা সুন্দর আলী ছাড়াও তিনি গান শিখেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্বনামধন্য বাউলকবি ঝাড়ু মিয়ার কাছে। তিনি বিভিন্ন ধরনের গান গেয়ে থাকেন—আঞ্চলিক, মুর্শিদি, মারফতি, দেহতত্ত্ব, বিচ্ছেদ প্রভৃতি।
দরবেশ আলী বলেন, ১৯৮২ সালের ২৭ জানুয়ারি বাবা মারা যাওয়ার পর তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘শাহ সুন্দর আলী বাউল শিল্পী গোষ্ঠী’র পরিচালনার দায়িত্ব তাঁকে নিতে হয়েছে। আসরে নিজের লেখা গান ছাড়াও বাবার লেখা গান তিনি গেয়ে থাকেন। এ ছাড়া রজব দেওয়ান, শাহ আবদুল করিম, জালাল উদ্দিন, খালেক দেওয়ান, রাধারমণ, দূরবীন শাহ, দ্বিজ দাশ ও রহমান মিয়ার গান পরিবেশন করে তিনি আসরে সুর ও তালের উন্মাদনা ছড়িয়ে দেন।
দরবেশ আলী জানান, বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় আসরে তিনি গান গেয়েছেন। এ ছাড়া ঢাকা, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ এবং ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের খোয়াই, ধর্মনগর ও কৈলাসহরে শ্রীহট্ট সম্মিলনীর মতো বড় আসরেও গান গেয়ে তিনি দর্শক-শ্রোতার প্রশংসা কুড়িয়েছেন।
দরবেশ আলীর গানে যেমন উঠে আসে বৈরী সমাজের শত টানাপোড়েনের কুিসত দিক। তেমনই এর বিপরীতে শব্দের গাঁথুনি দিয়ে তিনি রচনা করেন শাশ্বত প্রেমের পঙিক্তমালা, জীবনের জয়গাথা। আর তাতে হূদয় নিংড়ানো সুরসুধা মিশিয়ে পরিবেশন করেন মানুষের দরবারে।
দরবেশ বলেন, ‘এই সুরসুধা দিয়ে মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হতে পারলেই আমি পরিতৃপ্ত বোধ করি। আবারও নতুন গান বান্ধি।’ কথাগুলো বলেই তিনি হাতের দোতারায় টুং-টাং ধ্বনি তুলে সুর ধরলেন, গাইলেন—‘সংসারো বিদেশে বিদেশিনী বেশে মিছামিছি কষ্ট করি যাইরে...।’

No comments

Powered by Blogger.