চারদিক-‘ভাটাত কাম করি জীবনটা ফাটা-ফাটা’ by এম আর আলম

ভাটার মোখার (মুখ) কোনা দিয়া যখন হাউদাউ করি আগুন ব্যারে আইসে, তখন মন কয়, মোর মুখখান পুড়ি (পুড়ে) ছাই হইল। ছ্যাঁকা খ্যায়া অ্যানা সারি (সার) দাঁড়াইলে মহাজন চ্যাঁচে (চিত্কার) কয়, ওই হারামজাদা, সারিস ক্যানে, মার কয়লা।


শিকের হাতাটা (লোহার হাতল) মুখোত ডুবি (ঢুকিয়ে) দে!’ ভারাক্রান্ত মুখাবয়বে শিশু কুদ্দুস এভাবেই কথাগুলো বলল।
মাত্র ১০ বছর বয়স শিশুটির। মায়ের দুধের স্বাদ এখনো মুখ থেকে যায়নি ওর। বাড়ি নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার কামারপুকুর ইউনিয়নের নিজবাড়ী গ্রামে। ওই গ্রামের সরকারি স্কুলে ক্লাস টু পর্যন্ত পড়তে পেরেছে শিশুটি। কিন্তু সংসারে অনটন। আধাবেলা খাবারের নিশ্চয়তা যখন দিতে পারছিলেন না দিনমজুর বাবা, তখন কী আর করার? আদরের একমাত্র পুত্রসন্তানকে তিনি গ্রামের ইটাখোলায় কাজে ঢুকিয়ে দেন।
ইট বানায় শিশু কুদ্দুস। কিন্তু শিশু বলে তার মজুরি কম। কিন্তু তাতে কী আসে-যায়? জীবন বাঁচাতে টাকার প্রয়োজন অনেক। টাকা উপার্জন করে বাবার হাতে তুলে না দিলে খাবার জোটে না। আর উপোস করতে পারে না সে।
খুদে ইট-কামলা কুদ্দুসের সঙ্গে কথা হচ্ছিল নিজবাড়ীর ইটাখোলায়। সে জানায়, ‘মোর মার খুব অসুখ!’ মায়ের যে কী হয়েছে, তা চিকিত্সকেরাও বলতে পারেন না। সারা দিন শুয়ে থাকেন আর প্রলাপ বকেন। কৃষি-মজুর বাবা মাকে নিয়ে গিয়েছিলেন সৈয়দপুরের সরকারি হাসপাতালে। চিকিত্সকেরা কোনো রোগ ধরতে পারেননি। কুদ্দুসের আরও দুই বোন রয়েছে ঘরে। ওরাও লেখাপড়া শিখতে পারেনি। কারণ একটাই, আর সেটা হলো অভাব। তবুও কুদ্দুসকে ওর বাবা লেখাপড়া শেখাতে চেয়েছিলেন। বাবা নিজে অক্ষরজ্ঞানহীন হলেও ছেলের পাশে বসে কী পড়ছে, তা জানতে চাইতেন। সেটাও বছর দুয়েক আগের কথা। জানাল, তার স্পষ্ট মনে আছে, বাবা তাকে একদিন বলেছিলেন, ‘ব্যাটা, ভালো করি বই পড়। তোক মুই ডাকতোর বানাইম। গরু-ছাগল তো আর ডাকতোর হয় না। তুই তো মাইসের (মানুষের) বাচ্চা। পড়িলে আরও মানুষ হবু।’ বাবার সেই কথায় অনেক আস্থা খুঁজে পেয়েছিল। ভালো করে পড়েওছিল সে। তাই ক্লাসে প্রথম হয়েছিল কুদ্দুস। কিন্তু সেই বছরই মায়ের শরীরটা আরও বেশি খারাপ হয়ে যায়। দুই বোন খালেদা (১৪) ও মর্জিনা (১২) সারাক্ষণ মায়ের শিয়রে বসে কাঁদে। দূরে দাঁড়িয়ে কুদ্দুসও নীরবে অশ্রু বিসর্জন দেয়। ও সবই বোঝে। ধরে নেয়, মা হয়তো আর বাঁচবেন না। সারা দিন কামলা খেটে এক কেজি চাল, এক পোয়া ডাল আর চার-পাঁচটা আলু হাতে বাবা যখন ঘরে ঢোকেন, তখন কুদ্দুসের মনে চাপা কষ্টের মধ্যেও এক ধরনের আনন্দ উঁকি দেয়।
রান্না হয়। দুই বোন রান্নাবান্না করে মাকে খাইয়ে দেয়। তারপর বাবার সঙ্গে বসে পড়ে কুদ্দুস খেতে। সারা দিনের ক্ষুধা মনে করিয়া দেয়, ওরা দরিদ্র, ওরা আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো নয়, ওরা গরিব। আর গরিবের চিকিত্সক হওয়ার স্বপ্ন থাকতে নেই।
একদিন খুব সকালে বাবা কুদ্দুসের সামনে এসে দাঁড়ান। কী যেন বলতে চান তিনি, বলা হয় না। পরে নীরবতায় ছেদ টানে কুদ্দুসই। বাবাকে প্রশ্ন করে, ‘কোনো কবু (বলবে) বাবা?’ হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন বাবা। বলেন, ‘হয় বাপই, চল তোক মহাজন কাদের সরকারের ভাটাত কাম নিয়া দেও।’ দুই বছর ধরে কুদ্দুস আবদুল কাদের সরকারের ভাটাতে কাজ করছে। ওর কাজটা হলো ইট বানানোর। ইটাখোলায় একে ইট-কামলা বলা হয়। কাদামাটি ফ্রেমে এঁটে দিনে কমপক্ষে এক হাজার থেকে বারো শ ইট বানায় কুদ্দুস। এ জন্য সে ৮০ থেকে ১০০ টাকা মজুরি পায়। এ মজুরির পুরো টাকা বাবার হাতে তুলে দেয় কুদ্দুস। কিছুটা হলেও ভালোই আছে ওরা, ওদের পরিবার।
কুদ্দুসের মতো আরও ১৪ জন শিশু ওই ভাটায় কাজ করে। সে জানাল, ইট বানাতে অনেক কষ্ট, কিন্তু বিকেল হলে ভালোই লাগে। মনে হয়, সন্ধ্যা নামলেই তো মজুরিটা পাওয়া যাবে! তবে মাঝেমধ্যে যখন ভাটার চুল্লিতে কয়লা দিতে ডাকেন মহাজন, তখন কুদ্দুস শিউরে ওঠে। সে কষ্ট সহ্য করতে পারে না তার শিশু শরীর। বোবা কান্নায় তার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায় এ কথা বলে। সে বলল, ‘ভাটাত কাম করি মোর জীবনটা হয়া গেইল ফাটা-ফাটা। মুই আর কোনো দিন ডাকতোর হবার পাইম না। কী কয়ছেন তোমরা ভাইজান?’

No comments

Powered by Blogger.